
চারপাশ নিরব, শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া।
এক আধদিন পাখির কিচিরমিচির শুনতে ভালো আগে। দূরে পাহাড় স্পর্শ করেছে আকাশ। সূর্য যে কোনো সময় ডুবে যাবে। নাকি সূর্য উঠবে! এই সময়টা বড় অদ্ভুর লাগে। বড় পবিত্র মনে হয়। বড় মায়াময় লাগে! অদ্ভুত ও পবিত্র মনে করার কোনো কারন নেই। ঈশ্বর বলে কি কেউ আছেন? থাকলে দেখতে কেমন? ঈশ্বরকে দিয়ে কি হয় মানুষের? কত মানুষ তো ঈশ্বর, খোদা, ভগবান না মেনে দিব্যি হেসেখেলে বেঁচে আছে। তাহলে কি সব মানুষের ঈশ্বরের দরকার হয় না? না মানলেও চলে? একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো ভালো লোক। প্রচুর ধনী। স্বাস্থ্যবান মানুষ। পারসোনালিটি আছে, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবই আছে আপনার। এখন আপনার ঈশ্বর বিশ্বাসের দরকার কি? ঈশ্বর বিশ্বাস তো ধান্ধাবাজি। ইশ্বরকে পটিয়ে-পাটিয়ে নিজের আখের গোছানোর দরকার কি?
আস্তিক হওয়া সহজ।
কোরআন পড়ো, হাদীস পড়ো আর মেনে চলো। মৃত্যুর পর বেহেশত নিশ্চিত। বরং নাস্তিক হওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার। নাস্তিক হতে গেলে জ্ঞানী হতে হয়। কোরআন হাদীসের বাইরেও অনেক বই পড়তে হয়। জীবন তেজপাতা হয়ে যায়। বিজ্ঞান, দর্শন, টেকনোলজি, শাস্ত্র, ধ্যান ইত্যাদি সব গুলে খেতে হয়। আসল নাস্তিকরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে- সব ধর্মের কিতাব পড়েছি। ধর্মকর্মও করেছি। সব ভুগিচূগি। সব মিলিয়ে নাস্তিক হওয়া বিরাট দিকদারি। এরচেয়ে আস্তিক হওয়া সহজ। আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, ঈশ্বর আছেন, এ বিশ্বাস যদি হাইপথেটিক্যাল হয় তাহলে ঈশ্বর নেই, এই বিশ্বাসও হাইপথেটিক্যাল। কিছু মানুষের মধ্যে আমি ঈশ্বরের ছায়া দেখেছি। এ কথাও সত্য কিছু মানুষের মধ্যে শয়তানের ছায়াও দেখেছি। আসল কথা হচ্ছে, মানুষ'ই ঈশ্বর। মানুষ'ই শয়তান। একটা জীবনযাপন করার জন্য ইশ্বর না হলেও চলে। ইশ্বর সবচেয়ে বেশি দরকার অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের জন্য।
আমার এক শিক্ষকের কথা বলি-
একদিন স্যার আমাদের পড়ানো বন্ধ করে দিলেন। কলেজেও আসা বন্ধ করে দিলেন। মাসের পর মাস স্যারের কোনো খোজ খবর নেই। একদিন টেকেরহাট বাজারের স্যারের সাথে দেখা। স্যারকে দেখে প্রথমে আমি চিনতেই পারি নি। মুখ ভরতি দাঁড়ি, মাথা ভরা এলোমেলো চুল। কেমন পাগল পাগল চেহারা হয়েছে। নখের মধ্যে ময়লা জমে আছে। আমি বললাম, স্যার আপনি এখানে কেন? স্যার বললেন, নিজেকে খুঁজতে বের হয়েছি ব্যাটা। এই যে মাটির পথ, চারিদিকে এত এত গাছপালা, এই যে সবুজ মাঠ, মস্ত বড় দীঘি, মায়ান খাল- এঁর মধ্যেই ছড়িয়ে আছি আমি। সময় বলে কিছু নেই রে ব্যাটা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছুই অলরেডি ঘটে গেছে। একদিন ঠিক আমার সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে। স্যারের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, স্যার ঢাকা চলেন। আপনার চিকিৎসা দরকার। বিশ্রাম দরকার। স্যার বললেন, সময় শেষ রে ব্যাটা। চলি। কেমন!
এই স্যার একদিন ক্লাশে আমাকে বলেছিলেন-
কমিউনিস্ট হয়ে যাও রাজীব। আমি বললাম, কমিউনিস্ট হওয়া কি সহজ কথা স্যার? আমার ক্যারিয়ার গুছাতে হবে। টাকা কামাতে হবে। সংসার করতে হবে। আমার বাবা, মা আছেন। আমার অনেকে পিছুটান আছে। আমি পারবো না কমিউনিস্ট হতে। স্যার আমার কথা শুনে আহত হলেন। বললেন, ঠিক কথাই বলেছো। হাফ কমিউনিস্ট হয়ে লাভ নাই। আমার স্যারকে বলতে ইচ্ছা করছিলো- আপনি কমিউনিষ্ট হলেন না কেন স্যার? দুনিয়াতে তো আপনার কেউ নাই। আপনি একা। আপনি ভালো একজন কমিউনিস্ট হতে পারতেন। আদাজল খেয়ে নামতে পারতেন। কিন্তু বেয়াদবি হবে ভেবে স্যারকে কিছু বললাম না। স্যার আমাকে জোর করে অনেক রকমের বই পড়াতেন। বিবর্তনবাদ শিখিয়ে ছিলেন স্যার।
বিশ বছর পর গতকাল রাতে স্যারকে স্বপ্নে দেখলাম-
স্যার আমার ঘরের জানালার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, কে? স্যার সামান্য কাশলেন। কাশির আওয়াজ শুনেই স্যারকে চিনতে পারলাম। আমি বললাম, স্যার আপনি এখানে? স্যার বললেন, হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রে। স্যার বললেন, আমাকে দেখে ভয় পাসনি তো ব্যাটা? আমি বললাম না। স্যার বললেন, জানো আমাকে কেউ পছন্দ করে না আজকাল। কারো কাছে গেলে বিরক্ত হয়। আমি বললাম, স্যার ঘরে এসে বসুন। গরম এক কাপ চা খান। স্যার বললেন, কিছু খাবো না রে ব্যাটা। খাওয়া বারন। স্যারকে খেয়াল করে দেখলাম- টেকেরহাঁট বাজারে স্যারকে যেরকম দেখেছিলাম, স্যার ঠিক সেরকমই আছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




