১৯৪৩ সালে দেখা দেয় দেশ জোড়া দুর্ভিক্ষ। শতে শতে হাজারে হাজারে নয়– লাখে লাখে দুর্গত মানুষ পথে বেরিয়ে পড়ে। সমাজ সংসার ভেঙে যায়। সেই সময় 'স্বেচ্ছাসেবক' হয়ে দুর্গত মানুষদের সেবায় 'লঙ্গরখানায়' কাজ করি। দেশের– দেশের মানুষের চেহারাটা সেদিন থেকেই আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।- আবু ইসহাক।
সময়টা ১৯২৬ সাল।
তখনও ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়নি। দেশভাগও হয়নি। জর্জ বার্নার্ড শ’ নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন। ইন্তেকাল করেন উসমানী সাম্রাজ্যের ৩৬ তম ও সর্বশেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ওয়াহিদুদ্দিন। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো- মুসলিম সাহিত্য সমাজ। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’- এই বীজমন্ত্র নিয়ে সাহিত্য সমাজের যাত্রা হয়েছিল শুরু। যক্ষার ভ্যাকসিন বিসিজি আবিষ্কার হয়। ফিদেল কাস্ত্রো'র জন্ম হলো। অন্যদিকে মাদারীপুর বর্তমান শরীয়তপুরে জন্ম নিলো- আবু ইসহাক। তাঁরা ছয় ভাইবোনের আবু ইসহাক পঞ্চম। আবু ইসহাকের বাবা কাঠের ব্যবসা করতেন। গ্রামের পরিবেশে হেসে খেলে আনন্দ নিয়ে বড় হতে থাকলেন- আবু ইসহাক। স্কুলের শিক্ষকরা আবুকে ভালোবাসেন। সে লেখাপড়ায় বেশ ভাল।
আবু ইসহাক ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ।
গোয়েন্দা বিভাগের এই কর্মকর্তা দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি আশির দশকের শুরু থেকে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র টাইপ রাইটারে আর নববইয়ের দশকের শুরু থেকে নিজ হাতে কম্পিউটার কম্পোজ করতেন। তার স্ত্রী সালেহা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। তাদের তিন সন্তান। সত্যজিত রায় 'সূর্য দীঘল বাড়ি' উপন্যসটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সে কথা আবু ইসহাককে চিঠি লিখে জানিয়ে ছিলেন। এমন কি সত্যজিৎ এই উপন্যাস নিয়ে একটা মুভি করতে চেয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সেরা একটা উপন্যাস 'সূর্য দীঘল বাড়ি'। লেখক বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন এই উপন্যাস।
আবু ইসহাক মাত্র বিশ বছর বয়সে লিখলেন-
'সূর্য দীঘল বাড়ী' নামে একটি উপন্যাস। উপন্যাসের তুলে ধরেছেন- বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশ ভাগ। কিন্তু তার উপন্যাস কেউ ছাপায় না। অনেক প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দিলো। চার বছর পার হয়ে গেলো, কেউ ছাপালো না। অথচ এই উপন্যাসটি এখন বাংলা সাহিত্যের সেরা একটা উপন্যাস। লেখক নিজেই বলেছেন- ''আমি তখন সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করি, পোস্টিং নারায়ণগঞ্জ। তো মাঝে মাঝে ট্রেনে করে ঢাকায় আসার সময় দেখতাম ওরা ট্রেনের মেঝেতে বসে আছে। প্রত্যেকের হাতে থলি। কোথায় যাচ্ছে? যাচ্ছে ময়মনসিংহে, ওখান থেকে চাল কিনে নারায়নগঞ্জে কিছু বেশি দামে বিক্রি করে ওরা। এই ওদের পেশা।'' এই উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমা তৈরি করা হয়। সূর্য-দীঘল মানে সূর্যের দিকে লম্বালম্বি।
পাকিস্তান আমলে একবার জাল নোটের ছড়াছড়ি।
প্রশাসন আসামীদের ধরতে পারছে। তখন পুলিশের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন আবু ইসহাক। তিনি আসামীদের ধরলেন। এবং সেই ঘটনা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলেন- 'জাল'। ভাবলেন এই গোয়েন্দা উপন্যাস প্রকাশক অবশ্যই ছাপাবেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। কিন্তু এটা কোনো প্রকাশক ছাপাতে রাজী হয়নি। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই উপন্যাস ছাপা হয়। অবশ্য আবু ইসহাক তার লেখা গল্প উপন্যাস ছাপাতে তেমন আগ্রহ বোধ করতেন না। তার চিন্তা বা মনোভাব ছিলো এরকম- একসময় ছাপালেই হবে। 'জাল' উপন্যাসটি মূলত 'তদন্ত ও মস্তিকের খেলা'। যারা বোমকেশ বক্সি পড়েছেন, তাঁরা এই উপন্যাস পড়ে মজা পাবেন। স্কুলের বইতে আমরা সবাই আবু ইসহাকের 'মহাপতঙ্গ' কিংবা 'জোঁক' গল্প পড়েছি।
আবু ইসহাক ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ পাশ করেন।
১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। লেখাপড়া শেষ করেই তিনি সরকারী চাকরী পেয়ে যান। এই লেখক মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। যুদ্ধের সময় আবু ইসহাককে বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কারণ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বাঙালিদের পক্ষে কাজ করছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নানা ছলচাতুরি করে, গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে, চোরাচালানিদের সহায়তা নিয়ে পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং আফিগানিস্তান হয়ে, কলকাতা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটা গল্প লিখেছেন।
৬০- এর দশকে আবু ইসহাক বাংলা ভাষায় অভিধান তৈরি করেন।
সেই অভিধানে 'অন্ধকার' শব্দটার প্রতিশব্দ আছে ১২৭ টি। বিশ্বাস না হলে অভিধান খুলে দেখুন। সে যাক গে, আবু ইসহাক অনেক গুলো ছোট গল্প লিখলেন। প্রতিটা গল্পে আছে গ্রাম। দারিদ্রতা। প্রকৃতি। মানুষ। আবু ইসহাকের দ্বিতীয় উপন্যাস 'পদ্মার পলিদ্বীপ'। এটি একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। পদ্মা নদীকে বলা হয় কীর্তিনাশা। কারণ চাঁদরায়-কেদাররায়-রাজবল্লভ প্রমুখ বারভূঁইয়াদের কীর্তি এ নদী ধ্বংস করেছে। এ উপন্যাসে পদ্মাতীরবর্তী চর কেন্দ্রিক অধিবাসী, তাদের চরদখল, জীবন-সংগ্রাম মুখ্য। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া (যেমন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি) যে গ্রামীণ বা চরাঞ্চলের মানুষের উপরও পড়েছিল তা এ উপন্যাসে সেটাই দেখানো হয়েছে।
এযুগের লেখদের সাথে আবু ইসহাকের কোনো মিল নেই।
এ যুগের লেখকরা মূলত ধান্দাবাজ। বর্তমানের লেখকদের দেখা যায় ফেসবুকে এসে ছ্যাবলামি করছে। আবু ইসহাক, বিভূতি, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ইত্যাদি লেখকদের ব্যাক্তিত্ব ছিলো। এযুগের লেখকদের মধ্যে ব্যাক্তিত্ব দেখা যায় না। তাদের চোখে মুখে সব সময় লোভ চকচক করে। তাঁরা দাদালি ও চাটুকারিতায় বেশ পটু। আমার ধারনা ফেসবুক লেখকদের সর্বনাশ করেছে। ব্যাক্তিত্ব কমিয়ে দিয়েছে। এসব কথা বাদ দেই। আমি আবু ইসহাকের লেখার ভক্ত সেই ছোটবেলা থেকেই। আমার মনে আছে 'জোক' গল্পটা পড়ে আমার মন বেশ খারাপ হয়েছিলো। আরেকটা গল্প আছে সেটার নাম- 'মহেশ'। এটা অবশ্য শরৎচন্দ্রের লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১:৩৭