জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' কবিতাটি পড়েননি- এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে।
অদ্ভুত সুন্দর একটা কবিতা। এই কবিতায় একটা লাইন আছে- 'হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা '। এই লাইনটা বলা যেতে পারে- ধার্মিকদের জন্যি লেখা। ডারউইন বলেছিলেন- 'Survival of the fittest'. সমস্ত প্রানী কুলের মধ্যে অবিরাম জীবন যুদ্ধ চলছে। যারা জয়ী হয়, শুধু তাদেরই অধিকার আছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার। এই ধারণা মানুষ বেশ দ্রুতই গ্রহণ করেছে, শুধু ধার্মিকরা ছাড়া। সেই সময়ে ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ বাইবেলের বর্ণানুসারে 'ঈশ্বর ৭ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেন' বলে বিশ্বাস করত। ডারউইন সাহেব ধার্মিকদের এই ধারনায় আঘাত করলেন। মানুষের উদ্ভব সম্ভবত 'এপস' (লেজবিহীন বানর) থেকে, যা পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কিত প্রচলিত বিশ্বাসকে বিনাশ করে দিলো। এখনো পর্যন্ত যত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তার কোনটাই বিবর্তনতত্ত্বকে অযৌক্তিক প্রমাণিত করে না। অর্থ্যাত ডারউইন সাহেব সঠিক কথাই বলেছেন।
ডারউইন লিখলেন- 'অরিজিন অব স্পিসিস' বইটি।
তিনি বললেন- 'এই যে জীবজগৎ, এই যে সব গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ এর কিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেন নি। মুসলমানরা মনে করেন আল্লাহ, হিন্দুরা মনে করেন ভগবান আর খ্রিস্টানরা মনে করেন গড। তিনিই সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু ডারউইন বলেছেন, কোনও পরমেশ্বরই এসব সৃষ্টি করেন নি। প্রকৃতির সব কিছুই নিজস্ব সৃষ্টি। ডারউইন হুট করে এই কথা বলেননি। তিনি ২০ বছর তাঁর তত্ত্বের উপর গবেষণা করেন।
বিবর্তনবাদ কি? যে প্রক্রিয়ায় কোনো জীব বেঁচে থাকার জন্য, প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজের পরিবর্তন ঘটায়, তাকে বিবর্তন বলে। অথবা, যে প্রক্রিয়ায় সহজতর জীব জটিল জীবে পরিণত হয় অনুন্নত জীব আরো উন্নত হয়, তাকে বিবর্তন বলে। বিজ্ঞানে কোনো হাইপোথিসিসকে এমনি এমনি থিওরি বা তত্ত্বের মর্যাদা দিয়ে দেওয়া হয় না। এজন্য হাইপোথিসিসটিকে কঠোর পরিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিনা দ্বিধায় বলা যায়- ডারউইন সাহেব সঠিক।
ডারউইনও জন্মসূত্রে মেধাবী ছিলেন।
তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করুক। কিন্তু রুপকথার দুনিয়া বুদ্ধিমান মানুষের জন্য নয়। তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ গুলোর ভুল সকলের সামনে নিয়ে এলেন। ডারউইন এর যখন ২২ বছর বয়স, তখন তিনি একটি জাহাজে ঘোরার আমন্ত্রণ পান। সেই জাহাজে নানান রকম লোকজন ছিল। ডারউইন কে নির্বাচন করা হলো প্রকৃতি বিজ্ঞানী হিসেবে। জাহাজ টা সমদ্রে ভাসবে দীর্ঘ পাঁচ বছর। বহু দ্বীপ ঘুরে ঘুরে ডারউইন অনেক জন্তু-জানোয়ার, পোকা-মাকড়, লতা-পাতা সংগ্রহ করে আনেন। তারপর সেগুলো নিয়ে গবেষনা করতে করতে অনেক বছর পরে একটা বই লিখেন। সেই বইটির নাম- 'দা অরিজিন অফ স্পিসিজ'। এখন ধার্মিকদের সমস্যা হলো- ধর্মের বইতে যেহেতু বিবর্তনবাদের কথা লেখা নেই, আছে আদম হাওয়ার রুপকথার গল্প তাই বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক সত্য নয়, আদম হাওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সত্য। ১৪ শ' বছর আগের ধ্যানধারনা নিয়ে ধার্মিক লোকজন মত্ত হয়ে রইলেন। অর্থ্যাত তাঁরা ভুলের মধ্যে রইলেন।
বিবর্তন সত্য, মিউটেশন ঘটে, প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়, জীবন সবসময় বিকশিত হয়।
এটা বিজ্ঞান, এটাই সাইন্স। কিছু লোকের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাস্তবতার কিছু দিক লুকিয়ে রাখা বা মিথ্যা বলা সমর্থন করা বিরাট আকারের ভুল। ইউরোপে যখন শিল্প বিপ্লব শুরু হয় তখন চার্চ ধীরে ধীরে বুঝতে পারে মানুষকে আর বাইবেলের অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা যেগুলো বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যায় সেগুলো গেলানো সম্ভব নয়। 'বিবর্তনবাদ' বেশিরভাগ ধর্মগুলোর মুখোশ খুলে দিয়েছে। বিবর্তনবাদ মতে নতুন প্রাণীর উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়। এছাড়া মানব বিবর্তনের ব্যাপারে বলতে গেলে প্রথম মানুষ আদম এবং হাওয়ার কাহিনী মিথ্যা হয়ে যায়। তাই ধর্ম কে বাঁচাতে বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করা জরুরী হয়ে দাঁড়ালো ধার্মিকদের কাছে। অল্প বয়সী ছেলে গুলো পুরো কোরআন মুখস্ত করে বসে আছে। তাঁরা হাফেজ হয়ে গেলো। অথচ তাঁরা জানে কোরআনে কি লেখা আছে। এই লেখা গুলো দিয়ে তাঁরা জীবনে কতদূর যেতে পারবে। কোরআন মুখস্ত করা সহজ। বিজ্ঞান মূখস্ত করার বিষয় নয়।
১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন মারা যান।
বিজ্ঞানী জন হার্শেল ও আইজ্যাক নিউটনের সমাধি পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আফসোস এই যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিবর্তনবাদ নিয়ে সন্দেহজনক কথা শুনতে হয়! মনে প্রশ্ন এসে যায়- আদম মাটি থেকে ও হাওয়া হাড় থেকে জন্ম নিলেও তাঁদের সন্তান 'জন্ম দিতে হলো কেন? তাঁরা আরবী ভাষায় কথা বলতেন। তাহলে পৃথিবীর প্রাচীন লিপিগুলি আরবী হল না কেন? বিজ্ঞানকে আঘাত করা হয় ধর্ম দিয়ে, ধর্মের কারণে যিনি বিবর্তনকে অস্বীকার করেন, তিনি বিজ্ঞানের ব্যখ্যাকে ভুল প্রমাণ করেন ধর্মের যুক্তি দিয়ে। জাকির নায়েক আর ডারউইনের জ্ঞান কি এক? মহামতি এরিস্টটল আর নবী রাসূলের জ্ঞান কি এক? কোথায় আগরতলা আর কোথায় চোকির তলা? এই বিশ্বে কাদের অবদান বেশি? আরবের ধর্মগুরু শুধু সস্তা ও ভুলভাল বলে গেছেন। আর জ্ঞানীরা করে দেখিয়েছেন।
তথ্যসুত্রঃ
বিবর্তনবিদ্যা- প্রফেসর ড.নিশীথ কুমার পাল
ডারউইন : বিগল যাত্রীর ভ্রমণকথা- দ্বিজেন শর্মা
বিবর্তনবাদ ও ইসলাম- মোহাম্মদ সিদ্দিক।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:০৬