'...শুন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর ।
তোমরা আমায় চিনোনি ... '
শশীভূষন অবাক! সত্যি সত্যি দেশটা ভাগ হয়ে গেল।
তার বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তার মেয়ে অলকা লেখাপড়া শেষ করে আমেরিকা থেকে কবে ফিরবে কে জানে! দেশভাগ হয়ে ভালো হলো কি মন্দ হলো তিনি কিছুই ঠাওর করতে পারছেন না। দেশভাগ কি জরুরি ছিল? আর সেই চিন্তা তিনি এই বয়সে করতে চান না। তিনি জানেন, বিপুল সমুদ্রের মধ্যে নেমে পড়লে পথভ্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও ব্রিটিশ আসার আগে হিন্দু মুসলিম তো একই দেশে ছিল পাশাপাশি। ধর্মীয় ব্যাপারটা এত প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি। পলাশীর যুদ্ধে মুসলিম নবাবের হয়ে হিন্দুরাই তো মরণপণ লড়েছিল। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? দেশভাগের পর যা রইল, তা কি একটি জাতি নয়? আমরা কি অনেকগুলি গোষ্ঠীর একটি সমষ্টি? নাকি জিন্নার কথামতো, অনেকগুলি জাতির সহাবস্থান মাত্র?
মুসলিমরা শিক্ষায় ও চাকুরিতে পিছিয়ে পড়েছে, দোষ হয়েছে হিন্দুদের।
সেই অবস্থা কাজে লাগিয়েছে শাসক। মুসলিম কৃষকেরা ব্রিটিশ করের বোঝা বয়েছে; দোষ হয়েছে হিন্দু জমিদারদের। ব্রিটিশ শাসক সেটাকেও কাজে লাগিয়েছেন নিপুনভাবে। কার লাভ কার ক্ষতি কে তার বিচার করে? একটি দেশ ভেঙে তিনটি দেশ। ফলাফল সন্ত্রাস, দারিদ্র, রাজনৈতিক ওলট- পালট, দুর্নীতি! দেশভাগে যা হওয়ার কথা ছিল, হল ঠিক তার উলটো। দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ দূর করার চাইতে বরং হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি পরিচয় আরও উসকে দিল।
অলকা তার বাবাকে চিঠি লিখেছে।
ডাকপিয়ন সকালে চিঠি দিয়ে গেছে। অলকা'র চিঠি পেলেই শশীভূষনের মনটা খুশিতে ভরে যায়। তিনি ডাকপিয়নকে বখশিস দেন। তিনি দিনের মধ্যে অনেকবার করে মেয়ের চিঠি পড়েন। অলকা চিঠিতে তার বাবাকে লিখেছে-
প্রিয় বাবা আমার,
কিছু ঘটে গেলে তা সহজ ভাবেই মেনে নেয়াই ভালো। গতমাসে তোমার চিঠি পড়ে মনটা ভীষন খারাপ হয়েছে। দেশভাগ ব্যাপারটা কেন তুমি মেনে নিতে পারছো না? কেন এক আকাশ সৃতি বুকে ধরে রেখে কষ্ট পাচ্ছো? তুমি দেশভাগ নিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছো। তাই বলি- আমার মতে দেশভাগের মূল কারণ ছিল ধর্ম। হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি। তারা দুই পৃথক জাতির মতই ছিল। ইংরেজদের কোনো দোষ নেই। তারা যেমনভাবে হিন্দু আর মুসলমানকে দেখেছিল, তেমনভাবেই তারা ইতিহাস লিখেছে। ধর্ম পৃথিবীতে না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।
বাবা ভুলে গেলে চলবে না, মুঘল আমলে সামান্য কারণে দাঙ্গা হত।
যদিও তখন দাঙ্গা গুলো একতরফা হত। হিন্দুদের বিরুদ্ধে। কারণ তখন মুসলিম আমল। ১৭২০ সালে কাশ্মিরে এক মুসলমানের প্রতিহিংসাবশত দাঙ্গা হয়। ১৭২৯ সালে দিল্লিতে এক মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হয়। ১৭৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামে মুসলিমরা হিন্দুদের মহরমের সময় তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলে, হিন্দুরা অসম্মত হয়- পরিনামে দাঙ্গা। ১৭৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ার জেলায় মুসলিমরা হিন্দু ধর্মীয় উত্সবে সশস্ত্র হামলা করে। ১৮০৯ সালে বারানসিতে হিন্দুরা একটা বাড়ি বানাচ্ছিল মসজিদ আর বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের মাঝে- তাই নিয়ে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে বোম্বেতে এক পার্সি প্রফেটদের উপর এক বই লিখে, সেই বই নিয়ে দাঙ্গা।
তারপর, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মুসলিমদের জমানা গেছে। তাই এবার দাঙ্গা গুলোর চরিত্র কিছুটা বদলেছে। এবার একতরফা হিন্দুরা মার খেল না। তারা পাল্টা মার দিতে শিখলো। ১৮৮৯ সালে দিল্লিতে এক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে তখন ১৮৯১ সালে কলকাতায় মসজিদ বানানো নিয়ে দাঙ্গা লাগে। ওই একই বছরে পলাকাদে হিন্দু ধর্মীয় মিছিলের উপর মুসলিম আক্রমন হয়। ১৮৯২ সালে প্রভাসপাতনে মহরম নিয়ে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগায়। ১৮৯৫ সালে পোরবন্দর-এ হিন্দুর ঘরের পাশ দিয়ে মুসলিম ধর্মীয় মিছিল বেরোলে হিন্দুরা আক্রমন করে। এইরকম হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বহু দাঙ্গা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বাবা, আমি আমেরিকা আসার দুই বছর পর বহু মানুষ ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় নিহত হয়। এদের ঘৃণা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে মুসলিম প্রধান এলাকায় হিন্দুদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো আর হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলমানদের দেখামাত্র হত্যা করা হতো।
ইংরেজরা এইসব দাঙ্গা দেখে হিন্দু আর মুসলিমদের দুই পৃথক জাতি ভেবে নিল।
ভাবাটাই কি স্বাভাবিক নয় বাবা? এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের আর্থিক ক্ষতি হলে তারা ভারত স্বাধীন করার কথা ভাবতে থাকে। এতে ব্রিটিশদের দোষ কোথায়? অতএব দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা কোনভাবেই দায়ী নয়। দেশভাগের প্রধান কারণ যে ধর্ম সেটা অনেকে মানতে চায় না। একবার ভেবে দেখো বাবা, কাদের স্বার্থে ব্রিটিশরা দেশভাগ করলো? দেশভাগের সময় কিন্তু কোনো হিন্দু বাধা দেয় নি বরং গান্ধীজি বাধা দিয়েছিলেন বলে নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করেছিলেন। এর থেকে কি প্রমান হয়? হিন্দুদেরও দেশভাগে মৌন সম্মতি ছিল। এই রকম বহু উদাহরণ আছে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়াতে এখন যদি দাঙ্গা হাঙ্গামা কমে।
বাবা তুমি জানতে চেয়েছিলে- ইংরেজরা কাশ্মিরের সমাধান কেন করে যাননি সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল।
সেই বিষয়ে পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাবো। এখন আমি বের হবো। ফ্রিজে কিছু নেই। বাজার করবো। তুমি ভালো থেকো। সুস্থ থেকেও। মন খারাপ করে থেকো না। আমি বেশ ভাল আছি। জয় বাংলা। বাবা ওমর আলীর চাচার কি কোনো খোজ পেয়েছো?
বিঃ দ্রঃ আমি তোমার কাছে নেই। তাই নিজের যত্ন নিও।
সময় মতো খেও, ঘুমিয়েও। আর তোমার ডায়েরী লেখা শেষ হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। হাতী ঘোড়া কি লিখেছো- আমি পড়তে চাই। আচ্ছা, বাবা একটা কথা বলি? না থাক বলব না। আচ্ছা, বলেই ফেলি- বাবা আমি কি নিজের পছন্দ করা কাউকে বিয়ে করতে পারি? ভয় পেও না, আমার পছন্দের কেউ নেই। কথাটা এমনি এমনিই বললাম। হা হা হা।