somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যদি এমন একটা দুপুর আসে (ছোটগল্প)

০৫ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)

হাসপাতাল কোরিডোর পেরিয়েই মেইনগেট।
গেটে কেউ নেই।
রাত সাড়ে ১১টা।

অনু আজ একা।

ডিউটি শেষ হবার পরও থাকতে হলো। অপারেশন হয়ে যাওয়া কয়েকজন মুমূর্ষ রোগীর পোস্ট-অপারেটিভ ফলোআপের দায়িত্ব পড়েছিলো ওর উপর।
অন্য ইন্টার্নীরা ব্যস্ত ছিল অন্য রোগীদের নিয়ে।

কোরিডোর ধরে হাঁটছে অনু।
এক সময় হাঁটার গতি ধীর হয়ে এলো।
রাত সাড়ে ১১টার সময় হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার মাঝে অল্পবিস্তর ভয়ের উপাদান থাকাটাই স্বাভাবিক।

সাহস করে গেটের বাইরে এলো অনু। উদ্দেশ্য আশেপাশে চোখ ঘুরানো। তারপর উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা।

গেটে দাঁড়িয়ে মিনিট দশেক কেটে গেলো। অনুর হাতে অ্যাপ্রন। কালো রঙের জামা। লম্বা চুলগুলো ছাড়া। বাম হাতে একটা মোটা নীল চুড়ি। ছিপছিপে গড়নের অনু ওড়নাটা মাথায় দেবে কী দেবে না ভাবছিলো, হঠাৎ পেছনে কারো আসার শব্দ কানে এলো।

অন্ধকারের শব্দগুলো হয় ছুরির মতো। অল্প একটু শব্দও বুকে এসে বিঁধতে চায়।

অজানা শঙ্কায় অনু শক্ত হয়ে যাচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকানো দরকার। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। শব্দ ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে অনু পাশে এসেই থামলো।

- কোনদিকে তোমার বাসা?
- বামের রাস্তায় গিয়ে অল্পেকটু সামনেই।
- এসো আমার সাথে।

অনু আর কোন কথা না বলেই হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতোই তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে। মানুষটি সামনে হাঁটছেন। অনু পেছনে।

মানুষটি সার্জারীর নতুন সিএ ডা. অরিন্দম। মাস দুয়েক হলো তিনি এসেছেন অনুর হাসপাতালে। অনু অবশ্য অন্য ইউনিটের ইন্টার্নী। অনেকবার ডা. অরিন্দমের সাথে দেখা হলেও কথা হয়নি কোনদিনও।

অনু বুঝতে পারছে না কথা বলা ঠিক হবে না। এমনিতেই রাশভারী আয়তাকার চেহারা অরিন্দমের। লম্বা একটা শরীর। চোখে চারকোনা ফ্রেমের চশমা। শার্টের হাতা দু'টো খুব অযত্ন নিয়ে ভাঁজ করা। গায়ে এখনো অপারেশন থিয়েটারের গন্ধ।

রাস্তা ফুরিয়ে এসেছে। অনু বললো, আমার বাসা এখানেই দাদা।

অরিন্দম থামলো।
উলটো ঘুরে আবার হাঁটা শুরু করলো। দু'জনের আর কোন কথা হলো না।

অরিন্দমের সাথে অনুর পরিচয়টা এভাবেই।

(২)
অনুর আজ কোন ডিউটি নেই।

তবু ওটিতে একটু ঢুঁ মারলো। ভেতরে সার্জারীর ডিপার্টমেন্টাল হেড প্রফেসর রতন স্যার ছাড়াও আরো দু'একজন মেডিকেল অফিসার আছেন। ডা. অরিন্দমকেও দেখা গেলো। অ্যাসিস্ট করছেন রতন স্যারের সাথে।

ডিপার্টমেন্টাল হেড স্যারকে সবাই বেশ ভয় পান। তার সাথে অ্যাসিস্ট করার সাহস সবার হয় না। অরিন্দমকে সেই দুরুহ কাজে। অবশ্য অরিন্দমও কিছুটা ঐ টাইপেরই।

দুই রাশভারীতে মিলে ওটি করছে। কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছে না। কী না কী ভেবে, মনে মনে হাসি পেলো অনুর।

ওটি শেষ।
সার্জন বেরিয়ে গেলেন। অরিন্দম ক্লোজ করছেন।

অনু এগিয়ে গেলো। ওদিনের জন্য একটা থ্যাঙ্কস দেওয়া দরকার।

অনু কথা শুরু করার আগেই অরিন্দম বললো,
"এই তুমি ওয়াশ নাও। ওয়াশ নিয়ে এখানে আসো।"

অনু বাধ্য মেয়ের মতো ওয়াশ নিয়ে ওটি গাউন গ্লাভস পড়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।
- আমাকে একটু হেল্প করো, প্লিজ। রেকটাসটা ভালো করে দিতে হবে। কারসিনোমার রোগী। বার্স্ট অ্যাবডোমেন হবার পসিবিলিটি আছে।

অরিন্দম বলছে আর অনুও নিতান্ত অনুগতের মতো সব শুনে যাচ্ছে।

'ধন্যবাদ'টা রেকটাসের নিচে কোথাও চাপা পড়ে গেলো।

(৩)

ওটি চলছে। অরিন্দম সার্জনের ভূমিকায়। অ্যাসিস্ট অনু।

- আপনি এতো লম্বা। আপনার সাথে অ্যাসিস্ট করা তো কষ্টের।
- হুম কিছুটা।

- রতন স্যারের সাথে যখন অ্যাসিস্ট করেন ভয় লাগে না
- লাগে।

- তাহলে কীভাবে করেন?
- অভিনয় করি, ভয় না লাগার।

- আপনি তো অনেক কাজ পারেন। এতো ওটি অ্যাসিস্ট করেন। স্যার তো আপনাকে ছাড়া কিছু বোঝেই না। এতো কাজ শিখলেন কীভাবে?
- আমি তখন থার্ড ইয়ারে। সার্জারী ওয়ার্ড চলছিলো, ওটিতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।

- তারপর কী জেদ ধরলেন, সার্জারীতেই ক্যারীয়ার গড়বেন?
- অনেকটা।

- বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। দারুন একটা দুপুর।
- হুম

- বৃষ্টি দুপুর এগুলো ভালো লাগছে না?
- না।

- কেন বলবেন?
- কোন এক দুপুর আমাকে অনাথ করে দিয়েছিলো।

অপারেশন চলতে থাকে। সাথে অ্যানাটমী রিলেটেড আরো কিছু কথা।

অনুর চোখে মুগ্ধতা গাঢ় ছাপ।

অরিন্দমের মুখে একটা দুপুর। বৃষ্টির দুপুর।

দুপুর কখনো কারো আপন হয় না - অরিন্দম ভাবছে এসব। দুপুর আসলে একটা ঘন্টা। কতোটা পথ চলা বাকী, তার সমীকরণ।

অনু লুকিয়ে লুকিয়ে অরিন্দমের ভাষাহীন চোখে তাকাচ্ছে।

(৪)

তিন চার মাস কেটে গেলো।

অনু ইদানিং সুযোগ পেলেই অরিন্দমের গল্প করে অন্য ইউনিটগুলোতে।

ও কীভাবে কথা বলে, কীভাবে ইন্সট্রুমেন্ট চায়, স্যারদের সাথে কীভাবে কথা বলে- সব অনু জানে।

অরিন্দমকে মুখস্ত করে ফেলেছে অনু।


এর মধ্যে বড় কিছু ইমারজেন্সী অপারেশন নিজেই করে ফেলেছে অরিন্দম। স্যারেরাও খুশি। নিশ্চিন্তে ভরসা করার মতো একজন জুনিয়র সার্জন পেয়েছেন তারা। অরিন্দম ওয়ার্ডে থাকলে যে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হয় না।

অরিন্দমের সাথে অ্যাসিস্ট করার সুযোগ পেলে অনু আর ছাড়ে না। চোখে মুখে অবাক বিস্ময় নিয়ে অরিন্দম এর কথা শোনে ও।

মুগ্ধতা একটা সংক্রমন।
মেয়েরা একবার মুগ্ধ হলে বার বার হতেই থাকেই।
মুগ্ধতার সাথে ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, মুগ্ধতাকে পুঁজি করেই হেঁটে চলা যায় বহুদূর।

- "এই অনু ... ফ্রী থাকলে ওয়াশ নাও"।

এই লাইনটি এখন অনুর সবচেয়ে প্রিয় বাক্য।
মানুষ সারাজীবনে সবথেকে বেশী বার বোধহয় নিজের নাম শোনে। অনু অদ্ভূত এক ভালোলাগা নিয়ে ওর নামটা শোনে অরিন্দমের মুখে।

হঠাৎই অরিন্দম বলে বসলো,
- আর ভালো লাগছে না অনু এখানে।
- কী বলেন এসব? সবাই কতো পছন্দ করে আপনাকে।

- হয়তো
- তাহলে কী সব বলছেন এগুলো? পাগলামী ঢুকছে নাকি মাথায়?

- হয়তো।


(৫)

একটা এসএমএস এলো অনুর মোবাইলে।
"চলে যাচ্ছি অনু। আমার অর্ডার হয়েছে"

অনু যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তবে কী এভাবেই...?

অনু ছুটে বেরিয়ে গেলো ওয়ার্ড থেকে। প্রায় এক দৌড়ে মেইন গেটে।

এখানেই একদিন অরিন্দম বলেছিলো "এসো আমার সাথে"।

গেটে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে অনু।
বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি।
স্যাঁত স্যাঁতে একটা দুপুর।

একটা দুপুর যেন হঠাৎ করেই বুকের পাঁজরগুলো ভেঙ্গে দিচ্ছে।
এমন একটা দুপুর কোনদিন চায় নি অনু।

সত্যি দুপুরগুলো কারো আপন হয় না।

দুপুরগুলো কেবল দুপুরই থেকে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×