‘ঢাকা চলো' কর্মসূচিতে আরব বসন্তের ধ্বনি১২ মার্চ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের ‘চলো চলো, ঢাকা চলো' কর্মসূচিতে গণতন্ত্র ও অধিকার আদায়ের জন্য আরব বসন্তের জেসমিন আন্দোলনের মতো ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। উত্তেজনা, উৎকণ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এ কর্মসূচিকে ঘিরে দেশ-বিদেশের মনোযোগ ও আগ্রহেরও কমতি নেই। ১২ মার্চ দেশের রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট'। তারা কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানানোর সব আয়োজন সম্পন্ন । জনগণ যে ঢাকায় আরব বসন্তের মতো গণতন্ত্র, অধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে ধ্বনি উচ্চারণ করতে চায়- সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে। অন্যদিকে শাসক আওয়ামী লীগ প্রচার করছে, এই সমাবেশ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য' করা হচ্ছে। আওয়ামী প্রপাগান্ডা-প্রচারণাকে ছাপিয়ে ঐদিন প্রকৃতপক্ষে কোন সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক মেসেজ দেশবাসীর কাছে বড় হয়ে ওঠে- সেটাই দেখা হচ্ছে।
বর্তমান আওয়ামী শাসনামলে আসন্ন ১২ মার্চকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রচন্ড উত্তাপ ও শিহরণের সঞ্চার হয়েছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বনদ্ব-সংঘাত-সঙ্কট নিরসনের পন্থা যথাসময়ে অনুসরণ করা হলে দেশের বৃহত্তর জনগণ উন্মুক্ত রাজপথে চলে আসতে পারতো না। সংসদে বা সংসদের বাইরে আলোচনার সুযোগ থাকলেও সে সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি। কেউ কারো সঙ্গে সামান্যতম আলোচনার প্রয়োজনবোধ করে বলেও মনে হয় না। সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই রাজপথেই শক্তি ও কৌশলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে সম্মিলিত চারদলীয় বিরোধী জোটকে। এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ভয়ের বিষয় এবং মানুষের সাধারণ জীবন-যাপনের জন্যেও নানা হুমকি ও দুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করতে পারে। অনেকেই এমন উত্তেজক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আবার ১/১১-এর আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন। বলেছেন, হানাহানি ও রক্তপাতের কথাও। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল ও সংযমী ভূমিকাই শান্তি বজায়ে সক্ষম হবে। অতীতের মতো নানা কর্মসূচির সময় যেভাবে সরকারের পক্ষে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে, এবারও তেমন কিছু করা হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিই মুশকিল হবে। সব মিলিয়ে ১২ মার্চই ইঙ্গিত পাওয়া যাবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির আগামী দিনগুলোর চেহারা কেমন হবে এবং রাজনীতির মাঠ কার কব্জায় থাকবে।
দাবিগুলো হলো: ১. নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণের উপযুক্ত ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান; ২. নির্বাচনে দলীয় নিরপেক্ষ তা বজায় রেখে সরকারি দলের সেনাবাহিনী মোতায়েন; ৩. নির্বাচনে বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতি বাতিল। এসব গণদাবিকে কোনো ধরনের গুরুত্ব না দিয়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র' বলে এক কথায় উড়িয়ে দেয়াই যে যথেষ্ট নয়, ১২ মার্চ সরকারকে সেটা বুঝাবার চেষ্টাও করবে বিএনপিসহ চারদল।
বিরোধীদলীয় ‘ঢাকা চলো' কর্মসূচির ব্যাপারে আওয়ামী লীগও বসে নেই। ১২ মার্চের আগে-পরে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দীর্ঘদিনের পুরাতন রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ সাধারণত রাজনৈতিক ইস্যু রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত। যে কারণে তারা রাজপথ দখল করে রাখতে চায়। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত শক্তি ও কৌশলের রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার দিকে এগুচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সকলেই যে দলীয় প্রাধান্য ও স্বার্থ বজায় রাখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশের বিচিত্র ধরনের যে নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে, তাতে এমন যুদ্ধংদেহী অবস্থা নতুন বা অভিনবও নয়। মামলা, হামলা, মিছিল-মিটিং-সমাবেশে বাধাদানসহ খোদ কার্যালয়ের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখা হলেও চারদলের প্রধান শরিক বিএনপি ও জামায়াত সংঘাতের পথে যায়নি। আক্রমণ সহ্য করেছে। এর ফলে অতিদ্রুত তাদের প্রতি জনসহানুভূতি ও জনমত গড়ে ওঠেছে। তদুপরি, জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অভূতপূর্ব সাফল্যে সমগ্র দেশ সফর করে একটি বিস্ফোরণোন্মুখ গণজাগরণের পূর্ব-প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছেন। বিরোধী দলের এহেন গণমুখী ও গণসম্পৃক্ত কার্যক্রমের বিপরীতে সরকারের মুখপাত্রগণ যেসব ভাষায় জবাব দিয়েছেন, তাতে উস্কানি ও স্পর্শকাতরতা থাকলেও বাস্তবতা বলতে কিছুই নেই। অন্যদিকে, সাংবাদিক দম্পতি হত্যা রহস্য উঘাটনসহ অনেক অপরাধ, শেয়ার কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ইত্যাদির সুরাহা না করে কেবল বাক্য-বাণী-ভাষণ-বর্ষণ তাদেরকে ক্রমে ক্রমে খেলো ও কাগুজে-ব্যাঘ্রে পরিণত করেছে। এইসব নর্দন-কুর্দনের সঙ্গে জনগণের বাস্তব সমস্যার সমাধানের কোনোই সম্পর্ক নেই। সরকারের পক্ষে যত বেশি কথা বলা হচ্ছে, ততই তাদের কথা ও কাজের ফারাক বাড়ছে।
সাধারণত যে কোনো সরকারের শেষ দিকে জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে। এমন সময় সরকার পক্ষ থেকে কাজের কাজ না করে শুধুই কথা বলা হলে বা কেবল শক্তি প্রয়োগের পথ অবলম্বন করা হলে পরিস্থিতি যে আরো অবনতির দিকে যাবে, তা আর বিচিত্র কি! লক্ষ্যণীয়, এমন নাজুক সময়ে বেগম জিয়া ঢাকায় দেশবাসীকে সমবেত করার কৌশলপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত আপোষহীন নেত্রী বেগম জিয়া জানেন, কখন মোক্ষম আঘাতটি করতে হয়। বিরোধী দলের কৌশলী আঘাতের জবাবে সরকার পক্ষ যদি তাদের চিরাচরিত অভ্যাসে দম্ভ ও জোশের চোটে শক্তির মদমত্ত প্রকাশ ঘটায় তাহলে শক্তির বিরুদ্ধে যে কৌশল বিজয়ী হবে, সেটা তো জানা কথা। সেই বিজয়ের পথেই এখন পর্যন্ত হাঁটছেন বেগম জিয়া এবং তার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
গত কয়েক মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জনসংযোগের পর আসন্ন ১২ মার্চের ‘ঢাকা চলো' কর্মসূচি যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে, তাতে সেদিন লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে আরব বসন্তের জেসমিন বিপ্লবের মতোই একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে বাধ্য। চারদল যদি তাদের তিনটি দাবির সঙ্গে সরকার পতনের এক দফা দাবিটিকেও যুক্ত করে দেয়া দরকার।, তাহলে সরকারের কোণঠাসা অবস্থা সুতীব্র হবে। তখন রাজনীতির মাঠ ও ইস্যু চলে আসবে বেগম জিয়ার হাতে। সঠিক সময়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হলে হয়ত পরিস্থিতি এমন চরম আকার ধারণ করতো না। এখন সরকার সমাধান চাইলে এবং সংযমী হলে হয়তো শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক উত্তরণের কোনো পথ খুলে যেতে পারে। কিন্তু শক্তি ও দম্ভ নিয়ে এগুলে সেটার সম্ভাবনাও নস্যাৎ হবে। বিরোধী দলের আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকাই সঙ্কটকে বৃদ্ধি না করে কমাতে পারবে। এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের বোধোদয় এবং প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহানুভূতিশীল-আইনানুগ আচরণ। শুধু হামলা-মামলা-আক্রমণ-অফিস ঘেরাও করে জনবিক্ষোভকে দমানো যায় না। এতে বরং সহিংস ও দূরত্বই বৃদ্ধি পায়। বিরোধী দল অভিযোগ করেছে, তাদের আসন্ন কর্মসূচিতে ইতোমধ্যেই বাধা দেয়া ও শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত বৈ শান্ত হবে না।
১২ মার্চ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় নতুন গতিবেগ ও অর্জন আসুক, এটা যেমন মানুষ চায়; তেমনি কোন সংঘাত ও রক্তপাত না হোক, সেটাও চায়।
আর এই গতিবেগে নতুন মাত্রা দেবে সর্বহারা বেগম, বটতলার কথিত উকিল, হাইব্রিড নেতা খ্যাত হানিফ, সাথে অলস ২ মন্ত্রী দের অতি কথন। আসুন বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য এই নব বসন্তের আন্দোলনে যোগ দিয়ে তাবেদার সরকার হটিয়ে দেশের জন্য সরকার গঠন করতে এগিয়ে যাই।