somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সত্যকা
রাজু আহমেদ । এক গ্রাম্য বালক । অনেকটা বোকা প্রকৃতির । দুঃখ ছুঁয়ে দেখতে পারি নি ,তবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুভব করেছি । সবাইকে প্রচন্ড ভালবাসি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ করতে পারি না । বাবা এবং মাকে নিয়েই আমার ছোট্ট একটা পৃথিবী ।

যে বিজয়ের পিছনে দীর্ঘ শোষণের ইতিহাস

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতিটি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন থাকে । বাঙালি জাতির ইতিহাসে সেই স্মরণীয় দিনটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর । এই দিন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছিল । তাইতো প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেও ১৬ ডিসেম্বর পালিত হবে বাঙালি জাতির বিজয় উল্লাস । ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পালিত হবে দেশের ৪৪তম জন্ম বার্ষিকি । ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ কালের পরিক্রমায় অতিবাহিত করেছে ৪৩টি ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির জীবনে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় আপামর জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক চুড়ান্ত ও দুর্বার সংগ্রামই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ । পশ্চিম পাকিস্তানের ভয়াল থাবাকে উপেক্ষা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে লক্ষ কোটি জনতা । যুদ্ধে পাকিস্তানিরা সৈন্য, অস্ত্র ও শক্তির দিক থেকে শক্তিশালী থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের দক্ষ সংগঠন, নেতৃত্ব ও কৌশলের কাছে হিংস্র জানোয়ারেরা পরাজয় মানতে বাধ্য হয় । দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ তাজা প্রাণ ও ২ লাখ মা/বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি । বিশ্ব মানচিত্রে নতুন করে স্থান পায় বাংলাদেশ নামের সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্র। ব্রিটিশদের শো্ষণ থেকে মুক্তি পেয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার মাত্র ২৩ বছরের মাথায় কেন তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানকে মূল পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছিল ? বৃটিশদের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে না পেতেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা আবারও শোষণের স্টিম রোলার চালিয়েছিল পূর্ব পকিস্তানের মানুষের উপর । মানুষের সহ্যের সীমা থাকে । পূর্ব পাকিস্তানিরা সহাবস্থানের সকল পথ অনুসরণ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা মানবীয় কোন আচরণ করেনি । বরং পূর্ব পাকিস্তানিদের নমনীয়তাকে দুর্বলতা মনে করে এ বঙ্গের মানুষের কাঁধে চেপে বসেছিল । শাসনের নামে শোষণের মহড়া চালিয়েছিল । সুতরাং কাগজ-কলমের বিচারে বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ নয় মাসের হলেও মুলত বাঙালীকে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল দীর্ঘ ২৪ বছর ।

পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানের জন্ম হয় । ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিবেচনায় ভৌগলিক অবস্থানের ১৫’শ মাইল দূরবর্তী পুর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয় তবুও পুর্ব পাকিস্তানিদের আপত্তি ছিল না । শুধুমাত্র ধর্মীয় মিল ছাড়া দু’ই পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অন্য কোন মিল ছিল না । সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল নৈতিকতার প্রশ্নে । পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে পূর্ণ মুসলমানও মনে করত না । কেবল পশ্চিম পাকিস্তানি মহিলাদের মত পূর্ব পাকিস্তানি মেয়েরাও কাপড় পরিধান বলেই কিছুটা সহ্য করত । বৃটিশ কর্তৃক ১৯০ বছরের শাসন-শোষণের পরেও পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা ছিল কিন্তু বিপত্তিটা শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিন্তানকে শাসনের নামে শোষণের শুরু থেকে । পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থবাদী আচরণের কারণে দু’ই পাকিস্তানের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়তেই থাকে । পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারে পূর্ব-পাকিস্তানিদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন বাঙালীরা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে এবং এটা পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার মাত্র ৫ বছরের মাথায় অর্থ্যাৎ ১৯৫২ সালে । দু’ই পাকিস্তানের মধ্যে সর্বপ্রথম দ্বন্দ্ব বাঁধে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রশ্নে । গোটা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬.৪০ শতাংশের মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার পরেও মাত্র ৩.৭২ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা উর্দূকে পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রভাষা করার হীন ষড়যন্ত্র হয় । যা পূর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙালীরা মেনে নিতে পারেনি । এ নিয়ে বাঙালীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় । অবশেষে ভাষা আন্দোলন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তিবোধের পরিবর্তে সামরিক আয়োজন গ্রহন করে । বাঙালীর আন্দোলনকে বানচাল করার মানসে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে । সামরিক আয়োজনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পূর্ববাংলায় নুরুল আমিন সরকার ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারীর মধ্যরাত্রি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল প্রকার সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । কিন্তু সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে পূর্বনির্ধারিত ২১ ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান তুলে তদানীন্তন প্রাদেশিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলা সম্পর্কে তাদের হৃদয় নিংড়ানো অভিপ্রায় জানানোর চেষ্টা করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে । ফলে পুলিশের গুলিতে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক প্রমূখ অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ শাহাদাতবরণ করেন । এ সংবাদ মুহূর্তেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে পূর্ববাংলা বিপ্লবের আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়, যার লাভা চারিদেক ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রলয়ঙ্কারী গর্জনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । এভাবে ভাষা আন্দোলন এমনই দুর্বার আন্দোলনে পরিণত হয় যে, জনতার চাপে পাকিস্তান সরকারের সব অহমিকা ও শক্তি মুহূর্তের মধ্যে ধূলায় লুটিয়ে পড়ে এবং ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি ও মর‌্যাদা দিতে বাধ্য হয় । বাঙালীর প্রথম আন্দোলনে জয়ের প্রেরণাই ’৭১এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে ।

ভাষা আন্দোলনে ধাক্কা খাওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মারত্মক বিপর‌্যয়ে পতিত হয় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে । ’৫৪ সালের ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগেরে বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে । নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৯ টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট এককভাবে ২২৩টি আসন লাভ করে । অন্যদিকে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে জনধিক্কৃত হয় । এককভাবে ২২৩টি আসন জয়ের ফলে ২রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হলেও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সমূহ সম্ভাবনার সৃষ্টি হয় । এ ধারাবাহিকতায় ’৬২-র শিক্ষাবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যূত্থান সংগঠিত হয় । ’৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানিরা আবারও নতুন নাটকের অবতারণা করে । পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন । এ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৭টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে আবির্ভূত হয় । পক্ষান্তরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । নির্বাচনের ফলাফল অন্তত সুস্পষ্ট হলেও তা পাকিস্তানের রাজনীতিকে ঘোলাটে করে তোলে । ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো চক্রান্ত করে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে শুরু করে । আওয়ামী লীগ ও সকল বাঙালীরা পাকিস্তানিদের চক্রান্তের নকশা বুঝতে পারে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতারে ২৫ মার্চ অধিবেশন হবে বলে ঘোষণা দেন । তিনি তৎকালীন পরিস্থিতির আলোকে আরো বলেন, সশস্ত্র বাহিনী যেকোন মূল্যে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবে । ঐদিনই লেঃ জেনারেল বেলুচিস্তানের কষাই খ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেন । পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করায় শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যোগ না দেওযার সিদ্ধান্ত নেয় । এসবের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ওয়াকিং কমিটি ৬ মার্চ এক অধিবেশনে মিলিত হয় এবং সারারত সে অধিবেশন চলে । উক্ত বৈঠকে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ৭ মার্চের সে ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ১৮ মিনিট জ্বালাময়ী বক্তৃত দেন এবং মানুষকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তৈরি হতে দিক-নির্দেশনা দেন ।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে পূর্ব পাকিস্তানিরা চেয়েছিল সবাই মিলে মিশে থাকবে । কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসূলভ আচরণে তা সম্ভব হয়নি । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে কেবল শোষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং পেষণ করেছিল । ১৯৬১ সালের জরিপে দেখা যায়, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিচু আয় ৭.২ শতাংশ সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৩.৬ শতাংশ । পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আয়ের অনুপাত হওয়ার কথা ছিল ৫:৫ কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ১:৯ । শিল্প মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে ছিল ৯৫ ভাগ আর মাত্র ৫ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে । সমগ্র পাকিস্তানের আয়ের ৬৫ শতাংশ আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হত মাত্র ৩০ শতাংশ । ১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর‌্যন্ত পাকিস্তান সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার ফলে উভয় অঞ্চলের বৈষম্যের হার বৃদ্ধি পায় । প্রথম পরিকল্পনায় সমগ্র বিনিয়োগের মাত্র ২৬ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে । ২য় ও তয় পরিকল্পনায় যথাক্রমে ৩২ ও ৩৬ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয় । সবচেয়ে প্রকট বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে । পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙালীর সংখ্যা ছিল অতি অল্প । পাকিস্তানিরা তাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য গড়ে তোলেন । পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার ৪০ শতাংশ কোটা অনুযায়ী নিয়োগের কথা থাকলেও বাস্তবে সে অনুযায়ী হয়নি । ১৯৪৭-৬৯ সাল পর‌্যন্ত সচিব পদে পূর্ব পাকিস্তানের অংশগ্রহন ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশগ্রহন ৮৬ শতাংশ । অন্যান্য পদে যেখানে মাত্র ১৮ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানি সেখানে ৮২ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের । এভাবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বজায় রেখে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল । পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতার আসনকে চিরস্থায়ী করতে সামরিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক বৈষম্য গড়ে তোলে । দেশ রক্ষা বাহিনীর তিনটি সদর ও অস্ত্র কারখানাগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । দেশ রক্ষা বাহিনীর চাকরিতে একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অধিকারে ছিল । ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল ছিল মাত্র ১ জন অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জেনারেল ছিল ১৬ জন । ১৯৬৩ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহনের হার ছিল যথাক্রমে ৫ ও ৯৫ শতাংশ । পাকিস্তানের মোট আয়ের শতকরা ৬২ ভাগ খরচ হতো দেশরক্ষা খাতে এবং ৪২ ভাগ খরচ হত কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় । অর্থ্যাৎ মোট আয়ের শতকরা ৯৫ ভাগ টাকাই পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো । এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে বুঝা যায়, কি পরিমাণ বৈষম্যের সৃষ্টি তারা করেছিল ।

এভাবে চরম শোষণ সহ্য করতে করতে একসময় পূর্ব পাকিস্তানিদের ত্যাগ ও সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় । পূর্ব পাকিস্তানিরা মানসিকভাবে সকল প্রস্তুতি গ্রহন করলেও যুদ্ধ করতে যে অস্ত্র দরকার তা আদৌ বাঙালীদের কাছে ছিল না । এদিকে ইয়াহিয়া সরকারও বুঝতে পারে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সম্রাজ্যের দিন শেষ হয়ে এসছে । আলোচনার নামে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে এসে সারা বাংলায় গণহত্যা চালানোর কৌশল এঁকে যায় এবং ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন । ফিরে যাওয়ার আগে তিনি ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর ইঙ্গিত দিয়ে যান । বাঙালির দ্বারে নেমে আসে ২৫ মার্চ কাল রাত্রি, যে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা, অগ্নি সংযোগ ও নারী নির‌্যাতনে লিপ্ত হয় । বাঙালি জাতিকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমন করে । শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয় । শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ হওয়ার পূর্বক্ষণে সমস্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ জারি করেন । ২৬ মার্চ বাঙালি রেজিমেন্টের পক্ষে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার-কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । তখন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি রেজিমেন্ট প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় । অগণন ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-জনতা মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহন করে । মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার জন্য ১০ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলায় বর্তমান মুজিবনগরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল শপথ পাঠের মাধ্যমে এ সরকার ক্ষমতা গ্রহন করে । ’৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর‌্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি । স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বাংলায় পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং বাঙালি সত্ত্বার বিকাশের পথ সুপ্রশস্ত হয় । সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পরিচিতির সাথে সাথে বাঙালীর বিরত্ব প্রকাশ পায় ।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছরের সীমায় দাঁড়িয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ পায় । আমাদের পূর্বসূরীরা কি এই বাংলাদেশের জন্য নিজেদের জীবনকে বাজি ধরেছিলেন ? এই কি সেই বাংলাদেশ; যে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য শত্রুর বেয়নেটের সামনে অকুতোভয় বাঙালীরা দাঁড়িয়েছিল । স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে প্রায় ১৪টি বছর স্বৈরশাসকরা গণতন্ত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে । এখনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়নি । পাকিস্তান আমলে যেভাবে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভূগত তেমনি আজও মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে হচ্ছে । বিজয়ের ঠিক দু’দিন পূর্বে পাকস্তানি হানাদারেরা ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রায় সকল বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে । যা দু’একজ ভাগ্যক্রমে বেঁচে ছিল কিংবা এখন যারা দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে সেই তারাই আজ দেশের অবস্থা দেখে হতাশ । মনের কষ্ট প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ বলছেন, এবারের বিজয় দিবস শুয়ে-বসে কাটাব । এমন তো হওয়ার কথা ছিল না । তাহলে কি মেনে নিচ্ছি, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন-বাক্যকে । চাওয়া পাওয়ার মধ্যে বিস্তর গড়মিল থাকার পরেও বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক । এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে । সকল ভেদাভেদ ভূলে আমাদেরকেই আমাদের দেশটা সাজাতে হবে । দেশের তরে আমরা সকলেই যেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারি । সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]


৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×