somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফতোয়ার নানা রূপ - ৪

২৪ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার হরতাল নিয়ে ফতোয়া দেয়া হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে ৷ একথা সত্যি যে, গণবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহারে হরতাল এদেশে আজ গণমানুষের সংগঠিত প্রতিবাদ প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না ৷ তা আজ ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থসিদ্ধির অপকৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ৷ তবে এটা নিতান্ত সাময়িক ৷ যে কোনকিছুর অপব্যবহার মাত্রই অসফল এবং অস্থায়ী ৷ দেশে দেশে যুগে যুগে গণতান্ত্রিক ধারায় সংগঠিত মানুষের সর্ববিধ মুক্তি আন্দোলনে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হরতালের হাতিয়ার পালন করেছে উপযোগী ভূমিকা ৷

সেই হরতাল যদি 'গুণাহ' এবং 'নাজায়েজ' হয়, তবে আমাদের ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদিতে সকল সফল হরতালই হয়েছে 'গুণাহ এবং নাজায়েজ'!
প্রগতিশীল রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও কবি-সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধেও ফতোয়াবাজি কম হয়নি ৷ মুসলিম ঐতিহ্যের সমান্তরাল হিন্দু পৌরাণিক ঐতিহ্য নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা-গান রচনা করে ছিলেন বলে এককালে কবিকে কূপমণ্ডূক মৌলবাদী গোষ্ঠী 'কাফের' আখ্যা দিয়েছিল ৷

মুক্তবুদ্ধি, মানবতাবাদ ও অসামপ্রদায়িক চেতনার আলোকে নজরুল হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের পুনর্মিলন ঘটিয়ে প্রকৃত বাঙালীত্বের সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তা মৌলবাদীদের মনঃপূত হয়নি ৷ তাই এই মহাপ্রাণ বাঙালী কবি হয়েছিলেন ফতোয়াবাজির শিকার ৷ সর্ববিধ কুসংস্কার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিজ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তিবাদী মন নিয়ে যাঁরা লেখনি ধারণ করেছেন, তাঁরাও ফতোয়াবাজদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন ৷

সত্যসন্ধানী আরজ আলী মাতুব্বরের মনে জগত্‍, জীবন ও জীবনদর্শন সম্পর্কে অসংখ্য 'না-বুঝের প্রশ্ন' জমা হয়েছিল যার উত্তর তিনি আত্মদর্শনে খুঁজে পাননি ৷ উত্তর নেই, আছে প্রশ্নের পর্বত ৷ এ সম্পর্কে তাঁর উক্তি : '...দীর্ঘ ১৮ বছর কঠোর সাধনা করে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে দর্শনের উত্তাপে গলিয়ে তা বিজ্ঞানের ছাঁচে ঢেলে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করি প্রশ্নাকারে ১৯৫৭ সালে ৷ এ-সময় গোঁড়া বন্ধুরা আমাকে ধর্মবিরোধী ও নাস্তিক বলে প্রচার করতে থাকে ৷' (আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র)

প্রসঙ্গত লেখকের 'রচনাসমগ্র' সম্পাদক আইয়ুব হোসেন লিখেছেন : "করীম সাহেব (বরিশালের তত্‍কালীন জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট) প্রশ্ন জানতে চাইলে তিনি তা তুলে ধরেন ৷ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে প্রস্থান করেন ৷ বরিশাল গিয়ে আরজ আলীর নামে নাস্তিক ও কমিউনিস্টের অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ৷" (প্রথম আলো, শুক্রবারের সাময়িকী, ১৩-৪-২০০১)

সম্পাদকের এই উক্তির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তানে যুক্তিবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবী মানেই 'মুরতাদ' এবং 'কমিউনিস্ট' অপবাদে নিগৃহীত হতেন। এটি পাক-ঔপনিবেশিক আমলে ফতোয়াবাজির এক নতুন রূপ।
আমাদের উপমহাদেশের সামাজিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বৃটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি শিক্ষা-শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজি কম হয়ন। উপমহাদেশে ইংরেজ আমলের প্রথম যুগে পাশ্চাত্যের সবকিছু ইসলাম পরিপন্থী ঘোষণার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষালাভকে তত্‍কালীন গোঁড়াপন্থী মুসলিম নেতৃবৃন্দ 'নাজায়েজ' ঘোষণা করেছিলে। এর ঐতিহাসিক কারণ এই যে, মুসলিম শাসকদের পরাজিত করে ইংরেজরা ক্ষমতা দখল করেছি।

বিজয়ীর প্রতি বিজিতের ঈর্ষা, ক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহাবশত সেকালে ইংরেজি শিক্ষাসহ পাশ্চাত্যের সবকিছুই ধর্মবিরোধী বলে ঘোষিত হয়েছিল। সঙ্গীতচর্চা ইসলামে নিষিদ্ধ কিনা তা ব্যাপক গবেষণার বিষয়। সেই তর্কে না গিয়েও লক্ষ্য করা যায়, ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞরা, যাঁরা সুর সাধনায় বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই ধর্মে মুসলমান এবং ইসলামি জীবনাদর্শে ও আচরণে একান্ত নিষ্ঠাবান।

সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, একদা অনেক মুসলিম চলচ্চিত্র শিল্পীকে নাম পাল্টিয়ে অভিনয় জগতে আসতে হয়েছি। ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেতা দিলীপ কুমার এঁদের অন্যতম। সেকালে মুসলিম অভিনেতাদের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটি একমাত্র কারণ ফতোয়াবাজির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ।
পাকিস্তান আমলে একবার মাইক ব্যবহার করে আযান দেয়াকে 'না-জায়েজ' ঘোষণা করেছিল ফতোয়াবাজরা। একথা আজ হাস্যকর মনে হলেও সত্যি যে, শব্দবর্ধক যন্ত্রকে 'শয়তানের মুখ' বলে ফতোয়া দিয়ে তারা 'হারাম' ঘোষণা করেছিল মাইকের ব্যবহারকে। কিন্তু সেই ফতোয়া ধোপে টেকেনি।

এদেশে ফতোয়াবাজির আরেকটি বিষয় হল, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও মনুমেন্ট শিল্পকে হিন্দুয়ানি পৌত্তলিকতার দোষে অভিযুক্ত করে 'বেশরিয়তি' কাজ বলে আখ্যা দেয়া। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এসব স্থাপত্য-ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ওদের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে ওরা কেবল ফতোয়া দিয়ে আপাত ক্ষান্ত থাকে। কিন্তু অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ পেলে এসব ব্যাপারে তারা যে আফগানিস্তানে বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের মত এদেশেও ভাস্কর্যবিনাশে লিপ্ত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া সংস্কৃতিবিরোধী ফতোয়াবাজির অন্যতম ঘটনা ঘটেছে একুশের শহীদ মিনার নিয়ে ধর্মীয় 'রায়' ঘোষণার মাধ্যমে।

চলবে.....
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×