somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালামের কথা

০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভোর পাঁচটার মতো হবে৷ কলিং বেলটা বেজে উঠলো৷ বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে৷ এই বৃষ্টির মধ্যে এত ভোরে কে এলোরে বাবা! ঘুমে ভরা চোখে উঠে গেলাম দরজা খুলতে৷ দেখি কালাম দাঁড়িয়ে আছে৷ ভিজে একেবারে চপচপ৷
'কি ব্যাপার! এই ভোর বেলা কোথা থেকে ভিজতে ভিজতে উদয় হলে? বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন? ভিতরে এসো৷'
'ঢাকা এসেছি কাল রাতেই৷ যাত্রাবাড়িতে প্রায় দু'ঘণ্টা যানযটে আটকে ছিলাম৷ তাই দেরি হয়ে গেলো৷ ধানমন্ডি আসতে আসতে দেখি রাত প্রায় বারোটা বাজে৷ ভাবলাম এত রাতে আর আপনাকে বিরক্ত করি কেন৷ লেকের পাড়েই রাতটা কাটিয়ে দি৷ কিন্তু ভোরের দিকে হঠাত্‍ করেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর থাকতে পারলাম না৷'
কালামটা বরাবর এরকমই পাগল৷
'তা কাল রাতে যখন বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না, তখন এত ভোরেই বা করতে গেলে কেন? আর একটু সকাল হলেই না হয় বেল বাজাতে', আমি বলি৷
গায়ের আর জামার পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কালাম একটা বোকা বোকা হাসি দিল৷
'সে বয়স কি আর এখন আছে ভাই৷ সে সব দিনে সারারাত বৃষ্টিতে হেঁটেছি৷ ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়েছে৷ এখন আর শরীরে কুলায় না৷'
সত্যিইতো৷ বয়সতো আর বসে থাকে না৷ সময় কত তাড়াতাড়ি বয়ে যায়৷ তিরিশ বছর আগের ঘটনা৷ অথচ এখনো চোখের সামনে ভাসছে৷ মনে হয় এই সেদিনের কথা৷
কালামের বয়স এখন পঞ্চাশ হবে৷ চুলে পাক ধরেছে৷ মুখে বলিরেখা খুব স্পষ্ট৷ চোখে চশমা লেগেছে৷ তিরিশ বছর আগে সে ছিল টগবগে এক যুবক৷ এক জঙ্গী যোদ্ধা৷ কিছুটা খ্যাপাটে৷ নভেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা৷ যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে৷ শিবপুর হানাদার মুক্ত হয়েছে৷ নরসিংদী জয়ের প্রস্তুতি চলছে৷ সে-রাতে আমাদের একটা দল চলেছে নরসিংদীর কাছাকাছি একটা আর্মির ক্যাম্প আচমকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিয়ে, পথে একটা খাল৷ পানি বেশি না৷ মাঝখানে কোমর পর্যন্ত হবে৷ প্রায় সবাই লুঙ্গি পরে আছে৷ আমি লুঙ্গি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না৷ দৌড় ঝাঁপের সময় প্যান্টই বেশি সুবিধাজনক মনে হয়৷ ভাবছি, এই শীতের রাতে প্যান্ট ভিজালে কি অবস্থা হবে৷ আমার আবার শীত খুব একটা সহ্য হয় না৷ আমার মনের অবস্থা কেমন করে যেন কালাম বুঝে গেলো৷
'আপনি কিছু চিন্তা করবেন না৷ আপনাকে আমি কাঁধে করে পার করে দেব৷'
আমার কোন আপত্তিই সে শুনলো না৷ অনেকটা জোর করেই সে আমাকে কাঁধে তুলে নিল৷
'আরে আপনার যে হালকা শরীর৷ খাল পার করানো কোন ব্যাপার নাকি! আমরা গ্রামের ছেলে৷ এর চেয়ে কত ওজন কাঁধে নিয়ে হাটে যাই৷'
'দেখো কালাম, এত কথা বলোনা, সাবধানে পার হও৷'
'আরে ধূর৷ আপনি চুপচাপ বসে থাকেন তো৷ আমরা গ্রামের ছেলে৷ আমাদের জন্য এটা কোন...'
কালাম কথাটা পুরো শেষ করতে পারলো না৷ তার আগেই সে একটা হোচট খেয়েছে৷ দু'জনেই পানির মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে ভিজে চুপচুপ হয়ে কোনমতে খাল পার হলাম৷

কালামকে ধোয়া পায়জামা পাঞ্জাবী দিলাম৷ গোসল সেরে নাস্তা খেতে বসলো৷
'তারপর বলো দেখি কি কাজে ঢাকায় এসেছো?'
'আরতো পারা যাচ্ছে না৷ একটা চাকুরি চাই৷'
কালাম বেশ অনেকক্ষণ ধরে নাস্তা খেলো৷ তারপর আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে৷ কালাম ডান পা-টা একটু টেনে টেনে হাঁটে৷ গোড়ালির কাছে হাড় একটু ভাঙা৷ অনেক চিকিত্‍সা করানো হয়েছে৷ দু'বার অপারেশনও করা হয়েছে৷ কিন্তু সম্পূর্ণ সারেনি৷
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের কথা৷ নরসিংদী হাসপাতালে ওকে দেখতে গিয়েছিলাম৷ তখন ও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে৷ সারা শরীরে বহন করছে স্বাধীন দেশের রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন৷
আমাকে দেখে কালাম একটু ম্লান হেসে বললো, 'যেসব মুক্তিযোদ্ধারা বর্ডারের ওপারে থেকে যুদ্ধ করলো, তারাতো যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে এলো৷ আর আমরা যারা দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি, স্বাধীন হওয়ার পর ঘর ছাড়তে বাধ্য হলাম৷'
বাংলাদেশের যে সব এলাকায় দেশের মাটিতেই সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে, শিবপুর তাদের মধ্যে অন্যতম৷ এখানকার মুক্তি যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল বামরা৷ সেজন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই এলাকায় রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারও হয়েছে বেশি৷ অস্ত্র খোঁজার নাম করে কতো ছেলেকে যে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছে, তার হিসাব নেই৷ রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে এলাকার অধিকাংশ নেতা কমর্ীই শিবপুর ছেড়ে ঢাকায় এসে আশ্রয় নেয়৷ কালামও ঢাকায় ছিল৷ এক রাতে শিবপুর গিয়েছিল মা'র সাথে দেখা করার জন্য৷ দুর্ভাগ্য কালামের৷ সে রাতেই সে রক্ষীবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়৷
ক্যাম্পে নিয়ে কোন প্রশ্ন করার আগেই প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চলে কিল-ঘুষি আর লাঠির বাড়ি, তারপর অশ্রাব্য কয়েকটা গালি দিয়ে ক্যাম্পকর্তা প্রশ্ন করে, 'বল শালা, তোদের অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?' সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা৷ গলা শুকিয়ে গেছে৷ ঠোঁট আর চোখের কোণ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে৷ তবু ক্ষীণ কণ্ঠে কালাম বলার চেষ্টা করে, 'অস্ত্রতো সবই জমা দেওয়া হয়েছে৷ আর অস্ত্র কোথায় থাকবে!'
পরের ঘটনা ওর খুব একটা মনে নেই৷ কে যেন চিত্‍কার করে বলেছিল, 'টাঙ্গা শালাকে৷'
কালামকে হাত পা বেঁধে টাঙানোর পরে ওর শরীরের উপর দিয়ে কি বয়ে গেছে, ও বলতে পাবে না৷ ক্যাম্পে কালামকে পাঁচ-সাতদিন রাখা হয়৷ ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদী হাসপাতালে৷
একটা এ্যামবুশে কালাম আমার পাশেই ছিল৷ শত্রু পক্ষের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে আমরা পিছু হঠছিলাম৷ বৃষ্টির মতো গুলি মাথার উপর দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছিল৷ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হামা দিয়ে পিছাচ্ছিলাম৷ পিছনে একটা খাদ মতো৷ সেখানে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একটা বাঁশের গিটে লেগে কালামের হাঁটু থেকে প্রায় ফুট খানিক উপর পর্যন্ত গভীর ভাবে কেটে গেলো৷ কাটা জাগায় শক্ত করে কাপড় বেঁধে আমরা দু-তিনজন কোন মতে ধরাধরি করে ওকে পিছনের একটা গ্রামে নিয়ে এলাম৷ অসম্ভব ওর সহ্য শক্তি৷ এত বড় একটা কাটা, কিন্তু একবারও ব্যথায় কাতরাতে দেখলাম না৷
বাঁশে কালামের পা কেটে যাওয়ার ঘটনাটা কিন্তু একটু অন্যভাবে রটলো৷ অন্যান্য ক্যাম্পে প্রচার হলো যে কালামের পায়ে 'ব্রাশ' ফায়ার লেগেছে৷ যখন কোন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে একবার ট্রিগার চাপলেই একাধিক খুলি বের হতে থাকে, তাকে বলা হয় 'বার্স্ট' (Burst)ফায়ার৷ কিন্তু বার্স্ট ফায়ারকে অনেকেই ভুল করে 'ব্রাশ' ফায়ার বলে থাকে৷ যা হোক, কালামের পায়ে 'ব্রাশ' ফায়ার লাগার কথা শুনে অনেকেই কালামকে দেখতে এলো৷ আর সে বিছানায় শুয়ে তার 'ব্রাশ' ফায়ার লাগার ঘটনা বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সবাইকে বর্ণনা দিতে লাগলো৷
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কালাম৷ সুদীর্ঘ তিরিশ বছরেও দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি সে৷ ছোট খাটো ব্যবসার চেষ্টা করেছে৷ চাকুরি করেছে৷ কিন্তু টিকতে পারেনি৷ বিয়ে করেছে৷ দুই মেয়ে আছে, বউ মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে৷ মেয়েদের বিয়ে দিতে পারেনি৷ পঞ্চাশ-উর্ধ কালাম৷ নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হয়৷ আজো মুক্তিযোদ্ধা কালাম নতুন করে মুক্তির স্বপ্ন দেখে৷ কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷


(পূর্ব প্রকাশিত)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×