মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কি প্রস্তুত?
মুনীরুজ্জামান
***************************************************
গতকালের 'সংবাদ'-এ প্রকাশিত অনলাইন জরিপের ফলাফল দেখে সকাল বেলায়ই টেলিফোন করেছে স্কুলের বন্ধু মুস্তাফিজ। জরিপের প্রশ্নটি ছিল, 'সারাদেশে শিবিরমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই। রাবি শিক্ষক সমাজের দাবি। আপনি কি সমর্থন করেন?' বন্ধুবর প্রশ্ন দেখে ফোন করেনি, ফোন করেছে জরিপের ফলাফল দেখে। উলি্লখিত প্রশ্নের যে জবাবটি গতকালের 'সংবাদ'-এ প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, রাবি শিক্ষক সমাজের দাবিটির পক্ষে মতামত পড়েছে মাত্র ২১.১৪ শতাংশ। এর বিরুদ্ধে পড়েছে ৭৮.২৯ শতাংশ এবং মন্তব্য দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন ০.৫৭ শতাংশ মদদানকারী। বন্ধুর প্রশ্ন ছিল, 'সংবাদ'-এর মতো কাগজে এটা কী করে সম্ভব হলো? 'সংবাদ', যে পত্রিকাটি কত বড় ঝড়-ঝাপটার উত্থান-পতনের মাঝেও অসাম্প্রদায়িকতা আর ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের পক্ষে আপসহীন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াকু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেই 'সংবাদ'-এর অনলাইন জরিপে কী করে 'সারাদেশে শিবিরমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের' বিপক্ষে ৭৮.২৯ শতাংশ মত পড়ল? বন্ধুর প্রশ্ন 'সংবাদ'-এর পাঠকরা কি সব জামায়াত-শিবিরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে?
'সংবাদ' যারা নিয়মিত পড়েন, সংবাদকে যারা জানেন তাদের কাছে ব্যাপারটি বড় ধরনের একটা আঘাত বৈকি। কিন্তু আজকের ডিজিটাল যুগে এটা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। অনলাইন জরিপের মেকানিজম বা সিসটেম এ রকম যে, একটি কম্পিউটার থেকে একটি মাত্র মত দেয়া যায় এবং মত দেয়া হয়ে গেলে ওটা আর পরিবর্তন বা বাতিল করা যায় না। সুতরাং আলোচ্য অনলাইন জরিপটির ফলাফলের একটিই মাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে, 'সংবাদ'-এর অনলাইনে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপকসংখ্যক কর্মী বা ক্যাডার বা সমর্থক 'সারাদেশে শিবিরমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই'-এর প্রশ্নে 'না' মত দিয়েছে। এবং ফলাফলটি তাদের অনুকূলে নিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আরেকটি দিক রয়েছে। সেটা হলো_ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে যারা, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে যারা, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির এবং তাদের রগকাটা রাজনীতির বিরুদ্ধে যারা তারা অনলাইন জরিপে অংশ নেয়নি বা নিলেও তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। অন্যদিকে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে মতামতের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আরেকটি দুর্বলতা প্রকাশিত হতে দেখতে পেলাম। যেখানে জামায়াত-শিবির অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের মতামতটিকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ব্যাপক হারে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নিজেদের করণীয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঐতিহাসিক জনসমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পরও এ দেশে কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির তাদের তৎপরতা আবার চালাতে পারছে_ এ থেকে তার ধারণা পাওয়া যায়। অনলাইন জরিপকে ব্যর্থ করে দেয়ার জামায়াত-শিবিরের এ তৎপরতার পরিণতি হচ্ছে, জনমতের ভুল প্রতিফলন এবং হয়তো এক সময় পত্রিকাগুলো অনলাইন জরিপে জামায়াত-শিবির সম্পর্কিত প্রশ্ন করা থেকে বিরত হয়ে যাবে। অর্থাৎ জামায়াত-শিবির সাফল্যের সঙ্গে জরিপের মাধ্যমে তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবে। সন্দেহ নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির নিষ্ক্রিয়তা অথবা আত্মসন্তুষ্টির কারণে। এ থেকে বোঝা যায়, জামায়াত-শিবিরের মতো মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদের পৃষ্ঠপোষক দলগুলো কিভাবে সামগ্রিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে। শুধু টিকে থাকা নয়, বৈরী পরিবেশেও নিজেদের রক্ষা করে সহিংস ও রগকাটার রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে। এজন্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক রগকাটা সহিংসতার পর সরকারের ব্যাপক গ্রেফতার ও আটক অভিযানের পরও জামায়াত-শিবির তাদের আগ্রাসী-সহিংসতা থেকে পিছিয়ে যায়নি। জামায়াত-শিবির যতটা আগ্রাসী ও তৎপর, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ততটাই ডিফেন্সিভ, নিষ্ক্রিয় এবং অনেক ক্ষেত্রে অনৈক্যের জালে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। 'সংবাদ'-এর অনলাইন জরিপের ফলাফল তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের হামলার। যে হামলায় গণিত বিভাগের মেধাবী ছাত্র ফারুককে প্রাণ দিতে হয়েছে শিবিরের নৃশংসতার কাছে। এ হামলাটি যে পূর্বপরিকল্পিত এবং অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সমন্বিত ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমরা দেখেছি, এর আগে সপ্তাহ দুই ধরে নিজামী দেশবাসীকে নসিহত করছেন, 'ছাত্রশিবিরকে সমর্থন দেয়া ইমানি দায়িত্ব' বলে। আমরা দেখেছি, ছাত্রশিবিরের নেতারা হুঙ্কার দিচ্ছে, তারা নিজামীর হুকুমের অপেক্ষায় রয়েছে এবং নিজামীর হুকুম পেলে দুনিয়ার কোন অস্ত্রই তাদের রুখতে পারবে না। এর কয়েকদিন পরই নিজামী জনসভা করলেন রাজশাহীতে। জনসভায় প্রায় সারাদেশ থেকে শিবির ক্যাডার, কর্মী ও সমর্থকদের জড়ো করা হয়েছিল। এ জনসভার পরদিনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির হামলা করেছে এবং হামলার ধরন থেকে যে কোন মানুষই সহজে ধারণা করতে সক্ষম যে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এ বর্বর হামলাটি করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ হামলাটি কি শুধু হলের সিট নিয়ে মারামারি থেকে সৃষ্ট। না, এর পেছনে আরও গভীর কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে? এর জবাব পাওয়া যেতে পারে ঘটনা পরম্পরায় বিশ্লেষণ থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়ে গেছে এবং কারাগারে আটক যে কিলাররা ছিল তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়ে গেছে। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এরপর সরকারের সামনে যে এজেন্ডাটি রয়েছে সেটি হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এবং নির্বাচনে মহাজোট যে ভূমিধস বিজয় লাভ করেছে তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের ভোট। এবং তরুণ প্রজন্ম যে ভোট দিয়েছে মহাজোটকে তার কারণ হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করা হয়েছে নির্বাচনের আগে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে জামায়াত-শিবির অভিযুক্ত ছিল না; কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মূল আঘাতটিই যাবে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে। এবং এ বিচারটি করা সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক কারণে কঠিন হবে। ব্যাপক জনসমর্থন এবং জনমতের প্রবল ও সক্রিয় সমর্থনের সাহায্য ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সহজ হবে না। এসব প্রশ্নে সরকারকেই ড়ভভবহংরাব-এ যেতে হবে, যদি তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায়। আর ঠিক এ কৌশলটিকেই জামায়াত-শিবির গ্রহণ করেছে। সরকারের ড়ভভবহংরাব-এ যাওয়ার আগে তারাই ড়ভভবহংরাব-এ চলে গেছে। যার শুরুটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যুদ্ধের কৌশল বলে কোন কোন সময় 'অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স'_ জামায়াত-শিবির ঠিক এ কৌশলটিই গ্রহণ করেছে বলে আমার ধারণা।
একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, জামায়াত-শিবিরের সেটা নেই। তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারে। হাত-পায়ের রগ কাটতে পারে। হত্যা করে নিজেদের নৃশংসতায় উল্লাস করতে পারে ইসলামের নামে। সরকার ইচ্ছে করলেই যে কাউকে হত্যা করতে পারে না, রগ কাটতে পারে না, আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না; কিন্তু জামায়াত-শিবিরের সে আইনি বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতা নেই, সেটি তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বারবার দেখিয়েছে, যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যা, রগকাটা।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি বর্তমান বাস্তবতায় সক্ষম হবে আইনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে জামায়াত-শিবিরকে মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর থেকে সরকার শিবিরবিরোধী অভিযান শুরু করে সারাদেশে গ্রেফতার-আটক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সারাদেশেই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হচ্ছে। ছাত্রলীগ সংগঠনগতভাবেও শিবিরবিরোধী তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? যে পথে সরকার ব্যাপক চিরুনি অভিযান চালিয়ে শিবির (কোথাও কোথাও জামায়াত) গ্রেফতার করছে সে পথেই কি এ সহিংস রগকাটা দল ও তাদের নৃশংস ছাত্র সংগঠনটিকে দমন করা সম্ভব? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, যে প্রতিরোধের মুখে সরকার পড়ছে সেটি মোকাবেলা করার প্রস্তুতি কি সরকারের রয়েছে? সরকারের আইনি সীমাবদ্ধতার কথা হিসাবে নিলে বলতেই হবে, সরকারের প্রস্তুতি আমাদের কাছে যথেষ্ট নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
দাবার একবার চাল দিলে যেমন ফিরিয়ে নেয়া যায় না তেমনি মুক্তিযুদ্ধের এ অমীমাংসিত (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ) ইস্যুটির পক্ষে সরকারের পদক্ষেপটি ৫ম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর আর ফিরিয়ে নেয়ার কোন উপায় নেই। জামায়াত-শিবিরের যেমন পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, সরকারেরও তেমনি পেছানোর উপায় নেই। এবং মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় এ পর্বটিতেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য বিজয়ী হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তার জন্য যে ব্যাপক ঐক্য, জনসমর্থন, জনসমাবেশ এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রাষ্ট্রনৈতিক প্রস্তুতি দরকার সেটি আছে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এবং সেটি যে নেই তা 'সংবাদ'-এর অনলাইন জরিপ নিয়ে জামায়াত-শিবির সমর্থকদের তৎপরতা দেখেই আমাদের বুঝতে হবে। অথচ শেষ এ লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার ঝুঁকিও নেয়া চলবে না। সরকার কি এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পারছে?
[দৈনিক সংবাদ এর উপসম্পাদকীয় ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




