বর্তমানে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে যদি একটা জনমত তৈরী হয়, আপনি যদি নিরপেক্ষ কোন মতামত দেন আর তা যদি ঐ জনমতের পক্ষে না যায় তাহলে আপনাকে দালাল বলে সিল মেরে দেয়া হবে। আর এই কারণে কোন বিষয়ভিত্তিক লেখার কোন ইচ্ছা থাকে না। তবু কিছু কিছু বৃহৎ মস্তিষ্কের লোক যখন লেখা শুরু করেছে তখন আমার মত ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের লোককে আর চুপ থাকা মানালো না।
প্রথমত গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কাঠামো নিয়ে কথা বলি। কারণ এটাই এখন বড় ইস্যু। বলা হচ্ছে ন্যুনতম বেতন হতে হবে ৮০০০ টাকা। খুব ভালো। আসুন দেখি ৮০০০ টাকা ন্যুনতম বেতন হলে কি কি ঘটবে...
একজন ওয়ার্কার যদি দিনে ন্যুনতম ২ ঘন্টা করে ওভার টাইম করে, তার হাজিরা বোনাস যদি ৪০০ টাকা হয়, সে যদি মাসে অন্তত ১৫ দিন টার্গেট বোনাস পায়, তার গড় বেতন দাঁড়াবে ১০৪০০ টাকা। এখন আসুন দেখি এর কি প্রভাব আসবে।
১। মালিকের উপর প্রভাব, আমার কাছে ডিটেইল হিসাব আছে, এই মুহুর্তে আমাদের এখানে সি-এম (কাট-মেক) প্রতি মিনিট ০.০৫৬ ডলার। এর ভিত্তিতে সাধারণত প্রোডাক্টের দাম এস-এম-ভি (স্টান্ডার্ড মিনিট ভ্যালু) এর হিসাবে নির্ধারিত হয়। এটা মুলত কোম্পানির খরচের বিপরিতে হিসাব করা। এখন শ্রমিক মজুরি যদি এক লাফে দ্বিগুন হয়, সে ক্ষেত্রে হয় বায়ারের কাছ থেকে বেশি টাকা পেতে হবে (যা খুব-ই কঠিন কাজ), নতুবা মালিকের লভ্যাংশ্য কমাতে হবে (কোন মালিক কি রাজি হবেন?) কিংবা কোম্পানিকে খরচ কমাতে হবে এবং কার্য দক্ষতা বাড়াতে হবে।
২। শ্রমিকের উপর প্রভাব, প্রথম প্রভাব সম্ভবত পড়া শুরু করেছে। কারণ আমি দেখেছি যখনই বেতন বাড়ানোর কথা ওঠে বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়ায় সবার আগে। বেতন বাড়ার আগেই বাড়ে। আপনি চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এটা কিন্তু কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
এলাকার দোকানদার থেকে শুরু করে সব দিক দিয়েই তারা এই সমস্যার সম্মুখিন হয়। আমি দেখেছি যে বেতন বাড়লেও শ্রমিকদের সঞ্চয় বাড়েনি। যা হোক এটা অবশ্য খুব একটা জরুরী বিষয় নয় আমার আলোচনায়।
বেতন বাড়লে কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগে তেমন কেউ উৎসাহী হবে না। অদক্ষ বলতে হেল্পার শ্রেনীর শ্রমিক অবস্থা হবে শোচনীয়। ৮০০০ কেন ৫০০০ টাকায় একজন সুতা কাটা শ্রমিক কেউ নিয়োগ দেবে না।
দেখুন, আমি আলাপ করছি একটা বাস্তব ও নিরপেক্ষ স্থান থেকে। আমি জানি আমার কথা গুলা মালিক পক্ষের বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা জেনে রাখুন, আগে মালিক পরে শ্রমিক। আমরা যতই বলি না কেন, শ্রমিক না থাকলে মালিক থাকবে না। একটা বিষয় ভেবে দেখুন, আজ এক স্থানে ১০০০ অতি দক্ষ শ্রমিক এক হলে কিন্তু একটা মালিক ব্যতিত সেটা প্রতিষ্ঠান হয় না। কিন্তু একজন মালিক এসেই একটা প্রতিষ্ঠান দেন আর শ্রমিক এসে সেটার পূর্ণতা দেয়। আর তাই, আমার লেখায় আগে মালিক চলে আসছে।
আমি নিজেও চাই শ্রমিকের বেতন বাড়ুক। কিন্তু এই অর্থে নয় যে মাস শেষে তারা বেশী অঙ্কের টাকা হাতে পাক আর বাড়িওয়ালা-দোকানদার এই সকল সম্প্রদায় নিজেদের পকেট ভারী করুক। আমি চাই শ্রমিকের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত হোক, শ্রমিকের প্রতিটা দিন সুন্দর হোক, তাদের কাজের পরিবেশ সুন্দর হোক।
প্রথমত, প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে হাজিরা বোনাস (ন্যুনতম ৪০০ টাকা) নিশ্চিত করতে হবে। এতে এবসেন্টিজম কমবে। যেটা প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি লাভবান করে। দেখা যায় আমাদের বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠানে এবসেন্টিজমের হার ৮~ ১০ %... যার কারনে প্রয়োজনের তুলনায় ১০% লোক বেশি নিয়োগ দিতে হচ্ছে। ধরুন কোন প্রতিষ্ঠানে ২০০০ কর্মী দরকার। তাদের এবসেন্টিজম ১০%। তারমানে এবসেন্টিজমের অনিশ্চয়তা এড়াতে তাদেরকে ২০০ লোক বেশী রাখতে হচ্ছে। তারমানে গড়ে ৪০০০ টাকা বেতন হলে কতটা অতিরিক্ত খরচ হয় তা সকলেই সহজেই হিসাব করতে পারবেন। এখন হাজিরা বোনাসের কারনে এবসেন্টিজম ৪ % কমলেও ৮০ জন লোক কম নিয়োগ দিতে হবে। খরচ কমবে এভাবেই...
দ্বিতীয়ত, টার্গেট বোনাস থাকাটা খুব জরুরী। এস-এম-ভি-এর বিপরিতে ইফিসিয়েন্সি হিসাব করে প্রতি লাইনে সপ্তাহ ভিত্তিক টার্গেট বোনাস দিলে শ্রমিকের আয় বাড়বে। আর যেহেতু সপ্তাহ ভিত্তিক টার্গেট তাই এবসেন্টিজম-ও কমবে। সাধারণ এক সপ্তাহের প্রোডাকশান টার্গেট অর্জন করলে প্রতি শ্রমিক ১০০ টাকা পায় এবং টার্গেট-এর বেশি যেটা অর্জিত হয় প্রতি এসএমভি-এর জন্য ৫০ ~৭৫ পয়সা করে যা হয় সেটা সবার মাঝে ভাগ হয়। এক্ষেত্রে মাসে ৪০০ টাকা বেশি আয় সম্ভব। যেহেতু এস-এম-ভি-র বিপরিতে টার্গেট দেয়া তাই কোন রকম টেম্পারিং সম্ভব না।
তৃতীয়ত, শ্রমিকের দুপুরের খাবার প্রতিষ্ঠান থেকেই সরবরাহ করতে হবে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান দুপুরে শ্রমিকের খাওয়ার ব্যবস্থা করে না। আমি দেখছি যে দুপুরে শ্রমিকেরা বাসায় খেতে যায়, আর প্রতিদিন ০.২৫% থেকে ১ % ওয়ার্কার লাঞ্চের পরে আসে না আর আরো বেশি ২~১০ মিনিট দেরি করে। এর ফলাফল যদি আমরা সংখ্যা প্রকাশ করি তাহলে দেখা যায়, ঐ শ্রমিকদের বদলে অন্য কাউকে ম্যানেজ করতে ১ ঘন্টা নষ্ট হয়। একটা শার্টের লাইনে এক ঘন্টার কাজের পরিমান ১০০ থেকে ১১০। এখন প্রতি শার্টের দাম ১১০ টাকা হলে এক ঘন্টায় ক্ষতি ১১০০০ টাকা। তো এমন যদি আরো কয়েক লাইনে হয় তাহলে হিসাব সহজেই অনুমেয়। এখন একটা মেসে প্রতি বেলা খাওয়ার খরচ ২৫ টাকা মত। ২০০০ লোককে একবেলা খাওয়াতে খরচ ৫০,০০০ টাকা। মাসে ১৩ লাখ টাকা। এখন সহজে হিসাব করুন ১ টা শ্রমিক যদি লাঞ্চের পর না আসে তাহলে ক্ষতি কতটুকু, এমন যদি আপনার ৫ লাইনে ঘটে তাহলে? আর তাছাড়া লাঞ্চ যদি অফিসেই দেয়া হয় তাহলে লাঞ্চ টাইম আধা ঘন্টা যথেষ্ট। সে ক্ষেত্রে দিনের আলো সংরক্ষন থেকে কিছুটা খরচ কমানো সম্ভব।
চতুর্থ অবস্থানে আমার প্রস্তাব থাকবে শ্রমিক যেদিন থেকে স্থায়ী হবে (সাধারণত ৩ মাস) সেদিন থেকেই তার প্রফিডেন্ট ফান্ড চালু করে দিতে হবে। শ্রমিকের ভবিষ্যত নিশ্চয়তায় এটা খুব গুরুক্তপূর্ণ। সাধারণ দেখা যায় প্রফিডেন্ট ফান্ড থাকা মানে মোটামুটি ৪ বছরের জন্য একজন শ্রমিক একটা প্রতিষ্ঠানে থাকার চিন্তা করে।
পঞ্চম অবস্থানে অবশ্যই গ্রাচুইটি আসবে। একজন শ্রমিক প্রফিডেন্ট ফান্ডের কারনে ৪ বছর মেয়াদে চিন্তা করবে আর গ্রাচুইটির কারনে আজীবন।
বেতন ভাতা বাড়ানোর আন্দোলনের চেয়ে এই বিষয় গুলা নিশ্চিত করা আগে জরুরী। জানি আমি নতুন কোন কথা এখানে লিখিনি। কিছুটা গানিতিক হিসাব দেখানোর চেষ্টা করেছি মাত্র। এই গানিতিক হিসাবের বাইরেও অনেক কথা আছে যা কিনা কমন সেন্স-এ বোঝা যায়।