বলা চলে হেরেও অনেকটা জয়ী হয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে জিতেও পরাজয়ী হয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ।
বিএনপির মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান গুলোকে বিতর্কিত করা। এই একচেটিয়া পরাজয় এবং কেন্দ্র দখল সহ নানা অনিয়মের ঘটনাতে বিএনপির সেই লক্ষ্য মোটামুটি সিদ্ধ হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের দাবীকে আরো পোক্ত করেছে। যার ফলে বিএনপির কর্মী সমর্থকরা মোটামুটি চাংগা।
একমাত্র আওয়ামী লীগ ব্যতিরেকে অন্য একটি দলও এই নির্বাচনকে গ্রহনযোগ্য মনে করেনি, এমনকি এরশাদের জাতীয় পার্টিও নয়। যার দায়ভার পড়ছে নির্বাচন কমিশনের উপরে। নির্বাচন কমিশন এই কারনে চারিদিক থেকে ধিকৃত হয়েছেন। বিশেষত সিইসি রাকিব উদ্দিন সমালোচিত হয়েছেন বেশী। খালেদা জিয়া উনাকে "লাট সাহেব" বলে অভিহিত করেছেন। এলডিপি নেতা অলি তার বিচার করবেন বলে দাবী করেছেন। এদিকে নিউজ২৪ এর খবরে দেখলাম সিইসি রাকিব উদ্দীন সস্ত্রীক ভারত যাচ্ছেন সেমিনারে যোগ দিতে। এই শেষ বয়েসে অফিসিয়াল ট্যুরেও বৌ সংগে নিয়ে যাবার সংবাদটি পড়ে ভাল লাগল। যাকে বলে একেবারে আদর্শ প্রেমিক স্বামী। বয়েস তার রোমান্টিক ভাবালুতাকে মোটেও ভারাক্রান্ত করতে পারেনি। বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন না করতে পারলেও স্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই তিনি মহান। যাই হোক, প্রকৃত সত্য হল, এই ধরনের নির্বাচন সাধারন মানুষের অপ্রত্যাশিত ছিল না। বাংলাদেশে প্রশাসনের প্রতিকূলে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কোন নির্বাচন কমিশনই সেটা পারেনি। শামসুল হুদা নির্বাচন কমিশনের একজন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত। তিনি এবারের পৌরসভা নির্বাচনে অস্বাভাবিক ভোট পড়া নিয়ে আর্টিকেল লিখেছেন প্রথম আলোতে। কিন্তু তার সময়ে ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনে যে পরিমান ভোটের হার ছিল তা কি স্বাভাবিক ছিল? সেই নির্বাচন নিয়ে এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের জলিল কি বিরূপ বিবৃতি দেন নি? হিলারী ক্লিনটনের ফোন সংলাপ কি পত্রিকায় ছাপা হয় নি? মোদ্দা কথা হল, বাংলাদেশে যতদিন আইনের শাসন আর জবাবদিহিতা অনুপস্থিত, ততদিন শাসক দলের চোখ রাংগানিকে সবাই ভয় পাবে। কোন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। একমাত্র প্রশাসন সহযোগিতা দিলেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। স্বল্পমেয়াদী নির্দলীয় সরকার যেহেতু নির্বাচনকেই ধ্যান জ্ঞান ভেবে ক্ষমতায় আসে, তাই তার পক্ষেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এই দেশে।
আরো ছোট্ট একটা উদাহরন দেই। বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের পরিচালনায় ৯১তে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন। যা একটি মডেল নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনের দুর্বল দিক, ভোটার লিস্ট ছিল ত্রুটিযুক্ত। সময়ের স্বল্পতার কারনে এই দুর্বলতাকে মেনে নিয়ে নির্বাচন করতে হয়। এর পরে দলীয় সরকার আসে যায়, কিন্তু ভোটার লিস্ট আর ঠিক হয় না। শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত ফখরুদ্দিন মইনের সরকারের আমলে এসে সেটি ঠিক হয়। সুতরাং বাংলাদেশে দলীয় সরকারের নির্বাচন পরিচালনার ব্যর্থতা সূর্যালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
যা বলছিলাম। পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন নিয়ে। অনেকেই দাবী করেন ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। এমনকি বিএনপির কিছু সুবিধাবাদী নেতারাও এর মধ্যে রয়েছেন। অথচ তারা ভুলে যান যে নির্দলীয় সরকারের দাবী ছিল সাধারন মানুষের। প্রথম আলোর জরিপে ৯০ ভাগ মানুষ নির্দলীয় সরকারের পক্ষ্যে ছিল। এরকম আরো জরিপ রয়েছে। নির্দলীয় সরকারের দাবীতে আন্দোলন করে দাবী আদায় করতে যদি ব্যর্থও হয়, তবুও তো এই দাবী বিসর্জন দেয়া যায় না। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন বর্জনই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন বর্জনের ফলে বিএনপি জনগনের কাছে যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার কিছুটা লুন্ঠিত হয়েছে গত বছরের অবরোধ নামক দ্বিতীয় অন্দোলনের কারনে। যার ফলাফল হিসেবে নেমে আসে সরকারের খড়গ হস্ত এবং বিএনপির তৃনমূল মোটামুটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। সেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সাংগঠনিক কাঠামো থেকে বের হয়ে আসার অনুঘটক এই পৌরসভা নির্বাচন। এখন বিএনপিকে নিজের দলের ভেতরে গনতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। তৃনমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রত্যক্ষ্ ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হবে। বিএনপি নিজে সুষ্ঠু নির্বাচন দাবী করবে, অন্যদিকে নিজ দলের ভেতরে এই নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকবে না - বোধগম্য কারনেই তা মেনে নেয়া যায় না। একমাত্র অভ্যন্তরীন গনতন্ত্রের মাধ্যমেই বিএনপি নিজের সাংগঠনিক শক্তি ধরে রাখতে পারবে।
এও সত্য যে আগের চেয়ে আওয়ামী লীগ এখন কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধায় রয়েছে। হেফাজত সহ নানা সরকার বিরোধী গ্রুপগুলো এখন সরকারের সাথে আপোষ রফায় থাকার কারনে ভোটের ময়দানে আওয়ামী লীগ আর ততটা বেকায়দায় নেই। কিন্তু তা দীর্ঘ মেয়াদে সহায়ক হবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার যে নিকৃষ্ট উদাহরন স্থাপন করেছে, তা বাকশালের মতই শেকড় গেড়ে বসে থাকবে। বিএনপির সেই বোঝা নেই, তাই সামনে এগোতে বাধা নেই কোন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:১০