কানাডার মত দেশ খাদ্যের জন্যে অন্যের দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতছে, আর আমাদের দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নেদারল্যান্ডের মানুষ এখন আমাদের দেশের আলু খায়। কানাডা আমাদের দেশের মাঠের ভুট্টা দিয়ে খাবার তৈরি করে। এখন আর আমাদের দেশের মানুষ না খেয়ে মরে না। আমাদের দেশের মানুষ রাতে রাস্তায় ঘুমায়, কিন্তু তবুও পেটে একমুঠো ভাত হলেও পড়ে। এতসব অর্জন কাদের জন্য সম্ভব হয়েছে। আমরা তাদেরকে ভুলে যাই। আমাদের দেশের একজন দুর্নীতিবাজ লোকের খবরের নায়ক হতে সময়ই লাগে না। কিন্তু একজন কৃষক কখনও খবরের শিরোনাম হয়না।
ধান উত্পাদনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন মৌসুম হচ্ছে ইরি মৌসুম। বাংলাদেশের চালের চাহিদা মেটানোর পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ইরির। ইরি সম্পূর্নভাবে কৃত্রিম সেচের উপর নির্ভরশীল। ডিজেলে চালিত শ্যালো মেশিন অথবা বিদ্যুত্ চালিত মোটরের মাধ্যমে এই সেচ দেয়া হয়। সরকার কৃষকদের কথা না ভেবে এই দুটিতেই বার বার হাত দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ৮ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে । কৃষকদের নতুন সংযোগ দিচ্ছে না ।আর লোডশেডিং তো আছেই!
বিদ্যুৎ আবার সবার ভাগ্যে জোটেও না। আমরা এটা বিশ্বাসই করি না। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নাই এই কথা একবার আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোন এক ক্লাসে বলেছিলাম। আমার বন্ধুরা সবাই হেসে ফেলেছিল। আমার কথা আমাদের স্যার পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চায় নি। খোদ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে বাংলাদেশের মাত্র ৫৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। বাকি ৪৫ ভাগ মানুষ আসলে গ্রামের মানুষ। যাদের উৎপাদিত খাদ্য খেয়ে আমরা বেঁচে আছি।
একটি বাস্তব তথ্য চিত্র। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার একটি গ্রাম চৌহাটি। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি কৃষক তাদের বেঁচে থাকার সর্বশেষ সম্বলটি হারিয়েছে। সর্বশেষ সম্বল বলতে তাঁদের আবাদি জমি। যে জমিতে চাষ করে তাঁদের দুবেলা খাবার জুটত। দেশের মানুষের উন্নয়নের উদ্দেশে তৈরি হওয়া বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কয়লা খনির জন্য তাঁদের ফসলী জমি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ডুবে গেছে খনির আশে পাশের ফসলী জমি। অত্তন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় এই ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামটিতে বিদ্যুৎ নেই। যাদের অন্ন সমতুল্য ফসলী ক্ষেত নষ্ট করে ২৫০ মেঃ ওঃ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তাঁদের ঘরেই আলো জ্বলে না। তাঁদের ছেলে মেয়েরা রাতে কুপির আলোতে লেখাপড়া করে। সেই কুপির তেলের দামও আমাদের সরকার বাড়িয়ে দিয়েছে। আর আমরা শহরের লোকজন লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া বিদ্যুৎ ব্যবহার করি। এই ভর্তুকির টাকা কি এতটুকু তাঁদের প্রাপ্য নয় ? এভাবে দুই দিক দিয়েই কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এক শ্রেণীর মানুষকে গরিব থেকে গরিবতর বানাচ্ছি। আর অন্য শ্রেণীর মানুষ এই গরিবদের চুষে বড়লোক হচ্ছে।
দুর্নীতিবাজ বড়লোকদের কথা লিখতে গিয়ে একটা রগুড়ে গল্প মনে পড়ে গেল।
একবার দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের এক মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন দূর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে।
দুদক: আপনি যে কোটি টাকার হামার গাড়িটি ব্যবহার করেন সেটার টাকা কোথায় পেলেন ?
মন্ত্রী: আমার মার্সিডিজটা বিক্রি করে তার সাথে কিছু টাকা যোগ করে কিনেছি।
দুদক: তা মার্সিডিজটা কিভাবে কিনলেন ?
মন্ত্রী: আমার পাজেরোটা বিক্রি করে তার সাথে কিছু টাকা যোগ করে কিনেছি।
দুদক: পাজেরোটা কিভাবে কিনেছিলেন ?
মন্ত্রী: আমার টয়োটাটা বিক্রি করে তার সাথে কিছু টাকা যোগ করে কিনেছি।
দুদক: কিন্তু টয়োটাটা কিভাবে পেলেন?
মন্ত্রী: যত্তসব, ওটার জন্য তো আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার জেল খেটেছি আবার ওটা নিয়ে টানাটানি করছেন কেন ?
দুদক বিবৃতি দিল: " শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধ তদন্তে খুজে পাওয়া যায়নি "
এভাবেই দুর্নীতিবাজ বড়লোকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর কোন কৃষক ৫০০০ টাকা কৃষি ঋণ শোধ করতে না পারায় জেল খাটছে।
বিনামুল্যে সারের দাম দেয়ার কথা বলে সরকার আগের থেকে সবচেয়ে বেশি রেকর্ড পরিমান দামে সার বিক্রি করছে। যে ইউরিয়ার বস্তা পূর্ববর্তী সরকারের সময় ৬৫০ টাকা ছিল তা এখন ১১০০ টাকা । দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষিশ্রমিকের মুজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে । বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। সরকার বিদ্যুত ,ডিজেল ,সারের দাম বৃদ্ধি করে ধানের উত্পাদন ব্যয় বাড়িয়েছে। উত্পাদন ব্যয় বাড়িয়ে সরকার ক্ষান্ত হয়নি। সরকার তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছে (কম দামে চাল খাওয়ানো এই সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল)।
কৃষকরা হয়েছে বলির পাঁঠা। তাঁদেরকে বেশি দামে কৃষি উপকরন কিনতে হচ্ছে, অথচ বাজারে ফসল নিয়ে গিয়ে ফিরছে হতাশ হয়ে। কারন এই উদ্রিত ফসল বিক্রি করে তাদের খাদ্যের অন্যান্য উপকরন কিনতে হয়। দুর্নীতিবাজদের মত তাঁদের তো কোন পার্শ্ব আয় নাই। পরনের কাপড়, খাদ্য উপকরন কিনতে হলে ক্ষতি করে হলেও ফসল বিক্রি করতে হবে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে আমাদের সরকার। সরকার নিজেদের নাম কামাতে কৃষকদের ব্যবহার করছে। তারা বলে বেড়াচ্ছে আমাদের দূরদর্শিতার জন্যই আজ চালের দাম কম। এই অবস্থায় কি করবে অসহায় কৃষকেরা ? তারা দলবেঁধে আন্দোলনও করতে পারে না। তাদের কোন সংগঠন নাই। তাদের মুখে তো আন্দোলনের ভাষাও নাই।
কৃষকরা দিনে দিনে ধানচাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তারা ধানচাষ না করে উর্বর আবাদী জমিতে ইউক্লিপটাসের মতো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছ লাগাচ্ছে। অনেকে জমির মাটি ইটের ভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে । আর যারাও করছে শুধু তাদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে। এ ছাড়া অন্য উপায় তো নেই। এভাবে চলতে থাকলে টনে টনে চাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। তখন আমাদের রাজনীতিবিদরা কিভাবে কম দামে চাল খাওয়াবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৩:৫৭