চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এরকম দুইটা ঘটনা দেখেছি,
একটু বলি,
একটা স্কুলে গিয়েছিলাম কোন এককাজে। স্কুলের প্রধান ও ম্যানেজিং কমিটির প্রধানের ছেলেই সব কিছু দেখভাল করে থাকেন। ওই লোক ভালো ভালো অনেক কথাই বলছিলেন। বলছিলেন এক শিক্ষা অফিসার কে কিভাবে তিনি জব্দ করেছেন, এখন কেন শিক্ষার মান খারাপ, কেন ছাত্রদের প্রাইভেট টিউটর দরকার নেই, বললেন যোগ্যতার কথা। আরও বললেন, তার সন্তানকে ডঃ জাকির নায়েকের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে কেন ভর্তি করাতে চান,ইহকাল, পরকাল, সত্যি মিথ্যা, বর্তমান রাজনীতির হালচাল {বুঝে নিলাম তিনি কাদের সমর্থক} ইত্যাদি ইত্যাদি। । আমি শুধুই শুনছিলাম, আর তার কথা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় তার কাছে ফোন এল। কথা বলার পর যা বললেন তা হল এই, ঢাকার একটা স্কুলে পড়েন তার কাজিনের ছেলে। তো টেস্ট পরিক্ষাতে ওই ছেলে সহ আরও প্রায় ২১ জন পরিক্ষাতে এলাউ না হওয়াতে তাকে বলা হল একটা ব্যবস্থা করে দিতে, ছাত্র প্রতি ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি। তিনি বললেন, তিনি এই ধরণের কাজ করেন না, আর করবেনও না । কিন্তু যারা করে থাকেন, তাদের কারও সাথে তার জানাশোনা আছে। এরপরে তিনি তার আরেক শিক্ষক কে দিয়ে গ্রামের এক স্কুলের প্রধানের সাথে যোগাযোগ করলেন। ওই গ্রাম্য স্কুল প্রধান জানালেন তিনি করে দিতে পারবেন এবং ছাত্র প্রতি ৩০ হাজার টাকা লাগবে। এই বলে সেদিনের মত কথা শেষ হল। চুপচাপ শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, একটু আগেই তিনি কিভাবে হাদিস কোরানের কথা বললেন?
এর পরেই দেখলাম, এক অভিভাবক বসে আছেন তার সামনে। তার দুই ছেলে মেয়ে এই স্কুলে পড়াশোনা করে থাকেন। ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে যথেষ্ট চিন্তিত। ছেলেমেয়ে দুটো অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের কথা উঠতেই দেখলাম তারা যথেষ্ট সঙ্কিত এটা নিয়ে। বাবা মা মাত্রই সন্তানের মঙ্গলের কামনা করে থাকেন। তো ওই অভিভাবকের ইচ্ছা এর পরে তার ছেলেমেয়ে দুটোকে ক্যাডেট কলেজে পড়াতে ইচ্ছুক। এবং এই কাজে তিনি যেভাবে পারেন ভর্তি করাতে চাচ্ছেন। এজন্য ১০ লাখ টাকা ডোনেশন বাবদ রেখে দিয়েছেন। তিনি তার সন্তানকে ভবিস্যতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান, আর তা যেভাবেই হোক। বুঝলাম বেশ সচ্ছল তারা। তাই ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাতে কোন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার লবিং চান। শোনার পর ওই লোক {স্কুল কমিটির প্রধানের ছেলে}, ওই অভিভাবককে বললেন তার পরিচিত একজন আছে। এভাবেই তাদের কথা এগুচ্ছিল। শুধুই চুপচাপ শুনলাম। তবে আশ্চর্য হলাম, তিনিই কিনা আবার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে চিন্তিত!
কয়েকবছর যাবত প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে অনেক কথা উঠছে। বলা হচ্ছে অনেক ধরণের আধুনিক দুর্নীতির কথা। সাম্প্রতিককালে দুর্নীতি তে ২ ধাপ অবনতি হয়ে আমাদের বর্তমান অবস্থান হচ্ছে ১৪। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্নীতি যে প্রায় সকলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেথে আছে তা অস্বীকার করা যাবেনা। যতটুকু শুনেছি, কানাডার আইনে দুর্নীতির পরিকল্পনা করাটাও হচ্ছে এক ধরণের অন্যায়। কিন্তু আমাদের দেশে পরিকল্পনা নয়, একবারে হাতে কলমে করলেই বলা হয় দুর্নীতি। আর এর ফলেই একই অপরাধে আমাদের দেশে, পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটেছে তাতে দুর্নীতি হয়নি বলা হয়েছে কিন্তু কানাডাতে এটা নিয়ে চলছে বিচার যা সবাই জানে। ভারতের শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানী কেও তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে তার ইন্টার্ভিউ দিতে হয়। কিন্তু আমরা চান্স পেলেই যে, এক গলা পানিতে কাপড় খুলে নামতেও দ্বিধা করিনা। অনেকেই ভদ্রবেশী হয়ে নিজে দুর্নীতি না করলেও আরেকজনকে দুর্নীতিতে উৎসাহ দিচ্ছি তার অনেক প্রমান আছে।কিভাবে বিচার করবেন এদের? এরা কানাডার আইনে দোষী নয়, এরা আমাদের দেশের ভদ্রবেশী। কি করতে পারি? এরা সমাজে পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাবান, ভদ্রলোক{আহমদ শরীফের ভাষায় ভদ্রলোক, কিন্তু ভালো লোক নয় }। এরাই শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলে। এরাই হয়তো হবেন জাতির মাথা, এরাই হয়তো দেশ চালাবেন। এরাই কুরবানি দেবেন অনেক টাকা খরচ করে। এরাই প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে খুব প্রতিবাদি, অথচ টাকার জোরে ভিন্ন উপায়ে অন্যায় করেই যাচ্ছেন। অনেকটা এরকম যে , “চালুনি কয় সুচ রে, তোর পেছনে একটা ছ্যাদা”। অথচ এরাই কিনা, ন্যয় অন্যায় সব কিছুর বিনিময়ে হলেও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে ইচ্ছুক। আবার এরাই পরের সন্তান নয়, তাদের নিজেদের সন্তান দিয়ে জাতির উন্নতি হবে বলে মনে করেন।
ন্যয় অন্যায় বোধ আসলেই আমাদের নেই। আর তাই নিজের অন্যায় কে বৈধ বা আইনসিদ্ধ অথবা জায়েজ বলে চালিয়ে দেয়াটা যে আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৭