somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিমফুল, নাকফুল (রোম্যান্টিক ছোট গল্প)

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাই বর্ষা বলে ডাকলেও, ওকে আমি নিমফুল বলেই ডাকি। সেই ছোটবেলা থেকেই । যখন ওর বয়স দুই বছর, তখন থেকেই। আগেই একটু বলে নেই, গ্রীষ্মে নিমফুল ফোটে। ফুলগুলো ছোট ছোট,রঙ নীল বেগুনি আভাযুক্ত সাদা । ফুল ফোটার সময় গাছের তলায় প্রচুর ফুল ঝরে পড়ে। ফুল ফোটে থোকা ধরে। একটি থোকায় প্রচুর ফুল ফোটে। গ্রীষ্মের রাতের আধারে যখন ফুলগুলো ফোটে , তখন এই গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় মিহি কিন্তু বেশ মিষ্টি ঘ্রান নাকে লাগে। প্রথম যখন এই ফুলের ঘ্রান বুঝতে পেরেছিলাম তখন আমি বেশ ছোট। ছোটছোট চার/পাঁচটা পাপড়ি নিয়ে ফোঁটা এই নিমফুলই আমার প্রিয় ফুল। আর বর্ষা ছোট বলেই ছিল সবার প্রিয়, আমারও। তাই আমি আমার প্রিয়ফুলের নামানুসারে ডাকতাম “নিমফুল” বলে।
সে সম্পর্কে আমার কাজিন। মেজ চাচার বড় এবং একমাত্র মেয়ে। আমার বয়স যখন ছয় কিংবা সাত, তখন নিমফুলের জন্ম। তবে ওকে আমি নিমফুল বলে যখন প্রথম ডেকেছিলাম তখন ওর বয়স দুই কিংবা তিন, আর আমি আট/নয় বছরের নাদান বালক। আমিই ওকে সবসময় কোলে করে, কাঁধে চড়িয়ে রাখতাম বলেই আমার পিছু পিছু ছুটতে শিখেছিল তখন থেকেই। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে যে বড় নিমগাছ ছিল, ওই গাছেই ফুটত নিমফুল । গ্রীষ্মের সকালে, প্রায় প্রতিদিন আমি ফুলগুলো কুড়িয়ে নিতাম, আর ফুলগুলোর মধ্যে তাজা ঝরে পরা ফুলগুলো একেবারে ছোট করে ছিরে ওর নাকে, নাকফুলের মত করে লাগিয়ে দিতাম। ও খুব খুশি হত, আর আমারও খুব ভালো লাগত। সেই থেকেই ওকে আমি নিমফুল বলেই ডাকি। তবে নিমফুল বলে ডাকতাম ব,লেই কিনা জানিনা, ও আমাকে ডাকতো “জোড়া শালিক” বলে । ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কারন টা। তবে ওর সামনেই একদিন জোড়া শালিক পাখি দেখে্‌ আমি, আমার হাতের ডান হাতের পিঠে চুমু দিয়েছিলাম। তখন ভাবতাম, জোড়া শালিক দেখলে দিন ভালো যায়। যাহোক , এমনও দিন গিয়েছে, নিমফুল ওর নাকে লাগিয়ে দিতাম আর ও অনেকক্ষণ সেটা ধরে রাখার জন্যই মাথা কাত করে রাখত যাতে নাক থেকে নিমফুলের নাকফুল যেন পরে না যায়। কতই না হেসেছি ওর এই কাজ দেখে ।
তখন থেকেই মাঝে মাঝে এসে আমার কাছে বায়না ধরত নিমফুলের নাকফুল পরিয়ে দেবার জন্য। এমন কি প্রতিবছর।আমি ইন্টার পাশ করার পর ঢাকায় চলে আসার পরেও, প্রতি বছর গ্রীষ্মে যখন নিমফুল ফুটত, তখন বাড়িতে না গেলে আমার হতই না। এমনও হয়েছে, ভার্সিটিতে পরিক্ষা শুরু হবে তিন চারদিন পরে, তবুও এক দিনের জন্য হলেও ওই নিমফুলের ঘ্রান আমাকে নিতেই হবে, আর নিমফুলকে অন্তত একবার নাকফুল পরিয়ে দিতেই হবে বলেই চলে যেতাম বাড়িতে । আর যদি কোনরকমে একটু দেরি হত, অমনি নিমফুলের ফোন চলে আসতো , বলতো “জোড়া শালিক, সব কি ভুলেই গেছিস? নিমফুল ফুটছে তো। আসবি না বাড়িতে ? ” । ও হ্যাঁ, নিমফুল আমাকে তুই ব,লেই সম্বোধন করে।
আমাকে যেতেই হত ওই সময় টাতে আর এভাবেই হত প্রতিবছরের নিয়মিত আসা যাওয়া। নিমফুল এরই মাঝে ইন্টার পাশ করে, আমাদের এলাকার এক কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। ছোট্ট নিমফুল আজ কত বড় হয়েছে ! যদিও আমিও তো একটু বড় হয়েছি।
সারাদিন বাদে মেসে ফিরে, টেবিলের ওপর রাখা চিঠি দেখে, বেশ অবাক হলাম ! ডিজিটাল যুগে, চিঠি! তবে আরও বেশি অবাক হতে হল চিঠির প্রেরক দেখে । “নিমফুল” চিঠি পাঠিয়েছে। এই প্রথম। ফোন না করে, চিঠি !
“পরে পড়বো ” ভেবে বইয়ের ভাঁজে রেখে বাথরুমে ঢুকলাম , সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে নিতে। অনার্স শেষ হয়েছে, মাস্টার্স শেষ হবার পথে । সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরা আর চাকরির বিজ্ঞাপন দেখেই দিন পার। হিস্ট্রিতে গ্রাজুয়েশন করা, তাতে কি আর চাইলেই ভালো চাকরি জোটে ! কোম্পানিতে যেসব পদের জন্য অফার করে, তা করতে মন চায়না। আর আমি যা চাই তা পাইনা। আর সরকারি চাকরি তো এত সহজে হবে বলে মনে হয়না। সন্ধ্যায় দুটো টিউশানি করে যা পাই, তাতে টেনেটুনে নিজের চলে যায়। বাবার আয় আছে বলেই, বাড়িতে টাকা দেয়ার প্রয়োজন হয়না। এই যা রক্ষা । তবুও তো আশাতেই আছি, ভালো একটা কিছু করবো বলে। এরকমই আশা নিরাশার মাঝে থেকেই চিঠির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। রাতের খাওয়া দাওয়া করে যখন ঘুমাতে যাব, ঠিক তখনি মনে পড়ে গেল নিমফুলের চিঠির কথা । কি যে হয়েছে আমার ? এত ভুল হয় কেন? খাম ছিড়ে যে নীল কাগজ বেড়িয়ে এল, তাতে দেখলাম নিমফুলের বেশ সুন্দর হাতের লেখা । সেখানে কালো কালিতে গোটাগোটা লেখা ভেসে উঠলো চোখের সামনে।

প্রিয় জোড়া শালিক ,
কেমন আছিস ? ভালো আছিস নিশ্চয়ই। অনেক দিন হল, বাড়িতে এলি না। আমরা কেমন আছি, তারও কোন খোঁজ খবরও নিস না । খুব শহুরে হয়ে গেছিস, তাইনা? তাইতো ছোটবেলার সেই গ্রাম্য নিমফুলকে কখনই মনে করিস না, শুধু মাত্র তোর প্রিয় নিমফুল ফোটার সময় ছাড়া। আচ্ছা, এত কঠিন হয় কিভাবে ছেলেরা? নাকি শহরের ইটপাথরের মাঝে থাকতে থাকতে মন পাথরের মত এমন হয়ে যায় যে, কোন কিছুতেই আর কোন অনুভূতি হয়না ? জানিনা। তবে আমি এতটুকু জানি, যে সেই ছোটবেলা থেকেই, নিমফুল ডাক শুনে বড় হয়েছে, সে এমন পাথরের মত নয়। সে ফুলের ঘ্রান ক্ষণিকের ঠিকই কিন্তু তবে আনন্দে ভরিয়ে দিতে জানে, আনন্দ ভাগ করে নিতে জানে। আর অকালেই ঝরে পরতে জানে। আর সকালবেলা তা হয়তো কেউ কুড়িয়ে মালা গাঁথে, কারও পায়ের নিচে চাপা পরে।
যা হোক, অনেক দিন বাড়ি আসিস না। একটা কলও করিস না বলেই, আমিও কল করবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। কিন্তু কথাগুলো তো জানাতে হবে, তাই এই লেখা। বাবা মা আমাকে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পরে লেগেছেন, আর তাই আগামী সোমবার পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে বলেছে। এখন কি করবো ? যার কাছ থেকে নিমফুলের নাকফুল পরতে শিখেছি, তার কাছ থেকে একটা সোনার নাকফুল দাবী করাটা কি খুব অন্যায় হবে ? তার কি সেটুকু পুরন করার ইচ্ছা, ক্ষমতা, কিছুই নেই ? সে কি কিছুই বোঝেনা ? এমনি পাথর সে ?
অবশেষে কোন উপায় না দেখে, চাচির কাছে নিমফুলের সবকথা বলেছি। সে বলেছে “জোড়াশালিকের” আপত্তি না থাকলে, সে রাজী। এখন জোড়া শালিকের কি মতামত , তা জানতেই এই লেখা। আশা করি চিঠি পড়া মাত্রই উত্তর পাবো।
ইতি
তোমার নিমফুল ।

চিঠিটা পড়ার পর, বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা টান লাগলো। ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, খেলাচ্ছলে যে নিমফুলের নাকফুল দিয়ে তাকে সাজিয়েছিলাম, তা যে এক সময় সোনার নাকফুলের চাহিদায় এসে দাঁড়াবে, বুঝিনি। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, তাকে একটা সোনার নাকফুল পরিয়ে না দিতে পারলেই যে নয়। হঠাৎ মনে হল, নিমফুলের ঘ্রান পাচ্ছি ! পরেই বুঝলাম, সবই কল্পনা। ভাবতে ভাবতে মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে সেভ করা কন্টাক্ট নাম্বার খুঁজে বের করলাম , চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার প্রিয় ফুলের নামে যার নাম, সেই “নিমফুল”।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×