অফিসের অডিটের কাজে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় । কিন্তু চট্টগ্রাম যাওয়া এই প্রথম। ওখানেই এবারের অডিট। ট্রেনে যাব এবার। কখনও যাওয়া হয়নি বলেই, একটু বেশি এক্সাইটেড ছিলাম । বিগত চার বছরের চাকরিতে, প্রথম প্রথম অডিটে যাওয়া ভালো লাগলেও, এখন সে ভালো লাগা মরে এসেছে। এবার যেতে চাইছিলাম না। তবুও জয়েন্ট সেক্রেটারি সাহেব বললেন “মিস্টার তারেক, পরের বার আপনাকে ছাড় দেব। এবার চলেন। এই অডিট আর মিটিং টা একটু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ”। অগত্যা রাজি হলাম, তাছাড়া কিছু এক্সট্রা আয় পাওয়া যায়। তবে এবার যেহেতু চট্রগ্রামে অডিট, প্রথম যাচ্ছি, তাই একটু বেশি ফুরফুরা লাগছে।
“চিটাগাং মেইল” এর টিকেট কেটেছি।শনিবার রাত সাড়ে দশটায় আমার ট্রেন। যেতে যেতে পরের দিন সকাল সাড়ে আট টা বাজবে। অফিস থেকে ট্রেনে আমি একাই যাচ্ছি , জয়েন্ট সেক্রেটারি আজিজুর রহমান সাহেবও যাবেন, তবে বিমানে। বড় বাঁচা বেচে গেছি। তিনি আমার সাথে গেলে আমার ভ্রমণটাই মাটি হয়ে যাবে। উপরি সিগারেট টানতে যে কত কষ্ট হত টা ভেবেই মনে মনে স্যার কে ধন্যবাদ দিলাম।
রাতে একটু তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে কমলাপুর যখন যাব, ঠিক তখনই ছোট বোন রেশমার ফোন এল । এমনি এমনি। টুকটাক কথা বলার পরে, রেখে দিল। বলল “সাবধানে থাকিস, ভাইয়া”।
স্টেশনে সাড়ে নয়টার দিকে এসে পৌছুলাম , তখন ট্রেনের অনেক যাত্রী এসে পড়েছে। রাতে আরও একটা ট্রেন আছে, “তূর্ণা এক্সপ্রেস” । ওটাতে যাবনা। কীসব ভয়ের ব্যাপার স্যাপার ঘটেছিল শুনেছি। অনেকেই এডভেঞ্চারের জন্য যায়। আমার অত সাহস নেই। তাছাড়া দরকার কি শুধু শুধু ফাও ঝামেলায় যাওয়ার। আমার জার্নি টা ভালো হলেই হয়।
একটু খুজেই যখন নিজের কামরা খুঁজে পেলাম, দেখলাম আমার সিট একেবারে জানালার পাশেই। ভালই হয়েছে। তবে এটুকু শুনেছি, জানালার বাইরে থেকে ছিনতাই তিনটাই নাকি হয়। ধুর । ফাও চিন্তা মাথায় আনার দরকার নেই। ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেক আগে আমার বিপরীত দিকের সিটে যে এসে বসলেন তাকে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলাম। একেবারে শুকনা একজন লোক, যার গাল ভাঙ্গা, চোখের কোটর অনেক গভীর। হাতে একটা ব্যাগ, তবে ছোট । আমার দিকে তাকিয়ে শুকনা একটা হাসি দিয়ে বলল “ ভালো আছেন ? ” “হু ” জবাব দিতেই তিনি চুপচাপ হয়ে গেলেন। আমিও আপাতত আর কথা বাড়াতে চাইছিলাম না। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম , আমরা দুজন ছাড়া এই কামড়ায় আর কেউ নেই । কি জানি, সবাই কি তূর্ণাতেই যাবে হয়তো। তাই এটাতে যাত্রী একটু কম হয়তো।
ট্রেন ছাড়ার পর একটা সিগারেট না হলেই না। তাই সিগারেট মুখে নিয়ে ম্যাচের কাঠি বের করতেই, সামনের লোকটি বলে উঠল “ভাইজান, আমি এটা সহ্য করতে পারিনা।” “কি সহ্য করতে পারেন না” জিজ্ঞেস করতেই আমার হাতের দিকে ইশারা করে বলল “ওটা”। “মানে ?” খানিক টা বিরক্তি নিয়েই মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল। কি মসিবত ! যে কারণে আজ স্যার আমার সাথে না আসাতে খুশি হলাম , সেই ঝামেলা আমার সামনে বসে আছে ! এখন কি যে করি । এই ভেবে কামরা থেকে বের হয় সিগারেট টেনে যখন রুমে আসলাম, তখন দেখি ব্যাটা মুচকি মুচকি হাসছে। রাগে গা জ্বলছে, তবুও কিছু বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর সে নিজ থেকেই বলল “আপনে চিটাগাং এই প্রথম যাবেন বলে মনে হয় ”। কিছুটা অবাক হলাম তার প্রশ্ন শুনে। “আপনি কিভাবে বুঝলেন ? ” জিজ্ঞাসা করলাম। “আমি অনেক বছর, এই রুটে আসা যাওয়া করি। নতুন আর পুরান যাত্রীর চেহারা দেখলেই বুঝি” বলেই আবার মুচকি মুচকি হাসল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ মেরে রইলাম।
তবু জার্নি তো আর ছোট না, কি করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। কিছু পরে ব্যাগের ভেতর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট আর পানি বের করে খেতে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। খুবই অস্বস্তি লাগে এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে। তবুও এই তাকিয়ে থাকা থেকে বাঁচতেই বিস্কিটের প্যাকেট ছিরে তাকে দুইটা সাধলাম, কিন্তু তিনি আমাকে বললেন “আমি এসব খাইনা”। “কেন?” জিজ্ঞেস করতেই বললেন,”না এমনি”। অস্বস্তি কেটে যেতেই , একটু হাল্কা মনে হল নিজেকে। আবার সিগারেট ধরাতে গিয়েই, লোকটার দিকে তাকালাম। ব্যাটা তখনও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। তাই কামরা থেকে বের হয়ে সিগারেট শেষ করে আবার ঢুকলাম। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে আমিই তাকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কি করেন?” জবাবে বললেন “আগে ব্যবসা করতাম, এখন করিনা । ঘোরাঘুরি করতে ভালো লাগে ”। তাহলে আপনার খরচ বা পরিবারের খরচ চলছে কিভাবে ? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও মুখে আটকে গেল কথাটা। এটা অভদ্রতা। তবে জানতে চাইলাম পরিবারে কে কে আছে ? লোকটা বললেন “বাবা, স্ত্রী, আর দুই ছেলে মেয়ে”। “তারা থাকেন কোথায়? মানে আপনার বাসা কোথায়? ” এতক্ষণ বাদে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। “দমপাড়া , ওয়াসা মোড়, ”। এরপর কি বলব খুঁজে পাচ্ছি না। তাই চুপ করে রইলাম, এভাবে কতক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। তবে যখন চোখ খুললাম তখন বাইরের আলো আর কোলাহল শুনে বুঝলাম এসে পড়েছি। সারারাত এভাবে মরার মত ঘুমালাম আমি, ভাবতেই অবাক লাগছে। সামনের সিটে চোখ পরতেই দেখি ফাঁকা সিট। লোকটা নেই। হয়তো আমি ঘুমিয়ে রয়েছি বলেই আর জাগায়নি। কিন্তু তার সীটের পাশে যে ব্যাগটা রাখা দেখলাম, তা গত রাতে ওই লোকটির বলেই মনে হল। আশ্চর্য হলাম! তবুও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে, ওই ব্যাগটা হাতে নিয়ে বুঝলাম হালকা একটা ব্যাগ। ভেতরে তেমন কিছু নেই হয়তো। তবুও ব্যাগের চেন খুলে ভেতরে একটা শার্ট, একটা প্যান্ট আর একটা ডায়েরি চোখে পড়লো। ডায়েরি খুলে ঠিকানা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। পেলাম ঠিকই তবে কাল রাতে ওই ঠিকানা লোকটি আমাকে দিয়েছিল । তবে আরও আশ্চর্য লাগলো, কোথাও কোন ফোন নাম্বার না পেয়ে।
তবুও ব্যাগটা পৌঁছে দেব ভেবেই নেমে পড়লাম। নেমে একটা সিএনজি ঠিক করেই চলে গেলাম রেস্টহাউসে। ওখানে অফিস থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছিল। কোন বিশ্রাম পেলাম না সারাদিন। রেস্টহাউসে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম মিটিঙে। এভাবে দুইদিনে কাজ শেষ করার পর যখন ফ্রি হলাম, তখন ব্যাগটার কথা মনে পড়লো। ব্যাগটা পৌঁছে দেবার জন্য ছুটলাম দমপাড়ার দিকে। রিক্সা নিয়ে ওয়াসা মোড়ের সাথে মসজিদের পাশের গলি দিয়ে কিছুটা গিয়ে নামলাম এক জায়গায়। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে যে বাসাটার নিচে এসে দাঁড়ালাম, তা দেখে অনেক পুরনো বাড়ি মনে হল। জিজ্ঞেস করে বাসার তিনতলার দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপ দিতেই দরজা খুলে দিলেন বয়স্ক এক মুরুব্বি। “কাকে চাই?” জিজ্ঞেস করতেই বললাম “কবির সাহেব আছেন ? ” “আসুন”। ভেতরে ঢুকে একটা সোফাতে বসলাম। একটু পরে এক মহিলা এসে বসলেন আমার সামনাসামনি। তাকে বিস্তারিত বললাম। কিন্তু খেয়াল করলাম তিনি অবাক হননি। একটু পরে একটা মেয়ে ট্রেতে চা নাস্তা আর পানি নিয়ে এলেন। দেখলাম দু গ্লাস পানি। আবারও অবাক হলাম ! তবুও কোন কিছু প্রকাশ করলাম না। এক গ্লাস পানি খাওয়ার পরে চা মুখে নিয়ে কথা বলতে বলতেই আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম তার কথা শুনে। তিনি বললেন “ব্যাগটার তার হাজবেন্ডের। তিন বছর আগে চিটাগাং মেইলে করে আসার সময়, ট্রেনে ডাকাতের হাতে পরে মারা গেছেন। শুনেছি এক ডাকাত ওর ব্যাগটা নেবার সময় ওর সাথে ধস্তাধস্তি হয়েছিল । তাতে ধস্তাধস্তি করার সময় ছুড়ির আঘাতে ডাকাত মারা গেছেন। এরপর অন্য ডাকাত ওকে গুলি করে দিয়েছিল। তাতে ও মারা গেছে। এরপর থেকেই এর মধ্যে অন্তত সাত আটবার এই ব্যাগটা কেউ না কেউ বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন। আবার কয়েক দিন পরেই আবার কিভাবে যেন ব্যাগটা বাসা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর যারা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন তারা প্রত্যকেই ঢাকা থেকে চিটাগাং নতুন এসেছেন। আপনিও এই শহরে নতুন এসেছেন মনে হয় ?” কথা শুনেই আমার গলা শুকিয়ে গেল, আরেক গ্লাস পানি নিলাম গলা ভেজাতে। এরপর তেমন কোন কথা না বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার সময়ের পর থেকে আর মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন নিজেকে আবিস্কার করলাম সাদা শুভ্র বিছানায়। চোখ খুলে দেখলাম, আমার পাশেই আজিজুর রহমান স্যার বসে আছেন। “আমি এখন কোথায়” জিজ্ঞেস করতেই স্যার বললেন আমি এখন চিটাগাং হাসপাতালে। গতকাল এক মহিলা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন। কোন খোঁজখবর না পেয়ে, খুজতে খুঁজতে থানা পুলিশ করে, এখানে খবর পেয়ে এসে আমাকে তিনি দেখেছেন। তার মানে পুরো একদিন আমি জ্ঞানহীন ছিলাম। এরপর একটু সুস্থ হয়ে জানতে পারলাম, যে মহিলা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি আর কোন খোঁজখবর নেননি। আবারও ওই বাসায় গিয়ে বিস্তারিত জানার আগ্রহ হল। রেস্টহাউসে ফিরে এসে আবারও যখন দমপাড়ায় গিয়ে ওই বাসা খুঁজতে গিয়ে আমি চরম অবাক হলাম। দেখলাম ওখানে কোন বাড়ি নেই! কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে আসে পাশে দুই একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন “এখানে কোন বাড়ি নেই। তবে পুরনো একটা বাড়ি ছিল যা দুই আড়াই বছর আগে ভেঙ্গে ফেলেছে। ওখানে নতুন বিল্ডিং উঠবে বলে”।
নিজের চোখ কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না! নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম আমি ! এখন যা শুনছি সেটা সত্যি তো !
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫২