সকাল থেকেই মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা আসা যাওয়া করছে। যেন কম হয় তাই, কত ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। কি জিজ্ঞাসা করবে, কি বলব, কিভাবে বলব এসব হাবিজাবি ভেবেই মাথা খারাপের মত অবস্থা। গত দুই বছর যাবত এই সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে।
ইন্টার্ভিউ, বিকেল চারটায় । তবুও আমার সময় ফুরাচ্ছে না। এমন না যে, এটা আমার জন্য প্রথমবার। কিন্তু ঐ যে বললাম, গত দুই বছর যাবত অন্তত দু ডজন ইন্টারভিউ ফেস করতে হয়েছে। তাই দিনে দিনে হতাশা এত বেশি গ্রাস করছে যে, কোন ভাবেই নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারছি না। প্রথম প্রথম ভাবতাম কোন দু নাম্বারি করে চাকরি নেব না। এখন এই ফাউল চিন্তাটা বাদ দিয়েছি ঠিকই তবে সুযোগের অভাবে দুনাম্বারি করে ঢুকতে পারছি না। মানে সুযোগের অভাবে সৎ। ভাগ্য এমনি ভালো যে, এমন কেউই নেই, যারা আমাকে রেফারেন্স দিয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন। আর যারা করতে পারবেন, তারা এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না।
পড়াশোনা শেষ করার আগে কত জন কত আশা দিয়েছিল, তা মধুর মত গিলেছি। এখন ওসব বমি করে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে । বদ হজম হয় এসব আশার কথা আবার কারও মুখে শুনলে। ফার্স্ট ক্লাস তো পরের কথা অন্তত প্রাইভেট ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার নিয়োগেই যে দু নাম্বারির সীমা নেই, তা তো চোখের সামনে দেখেছি। তবুও আশা ধরে রেখেছিলাম অনেকদিন, এখন ওসব আমার কাছে কল্পনা মনে হয়। মেধা কি একেবারেই কম আমার ? মাঝে মাঝেই প্রশ্ন জাগে মনে। কিন্তু মেধাবী, ভাগ্যবানদের ১০ পারসেন্টের মধ্যে নেই হয়তো। কিন্তু তাই বলে কি মেধাহীন ! জানিনা, অন্যরা কেমন ভাবছে।
কোম্পানির কথা আর কি বলব। ওখানে চাকরি করা অনেকেই বড় মুখে বলে, ওখানকার চাকরির নিয়োগে কোন দু নাম্বারি নেই। আমিও তাই ভাবতাম। অথচ দেখলাম কি ?
এই যে গত সপ্তাহেও একটা ইন্টারভিউ তে জিজ্ঞাসা করল "এখানে আপনার কি কোন রেফারেন্স আছে ? "
বলেছিলাম "নেই"। আর মনে মনে বুঝে নিয়েছিলাম এখানে হবেনা।
তার আগের সপ্তাহে যেখানে গিয়েছিলাম , বলে " একাউন্টসে কাজ করবেন, অভিজ্ঞতা আছে ?"
"জী না , স্যার নেই"।
এক স্কুলের ভাইভা জিজ্ঞেস করল "ডোনেশন দিতে পারবেন? "
"জী না, স্যার"
আরেক স্কুলের আবাসিক শিক্ষকের জন্য গিয়ে পেলাম আরও ভয়াবহ অবস্থা । বলে "মাঝে মাঝে আবাসিক স্কুলের ছাত্রদের খাবারের বাজার করতে হবে ? কি পারবেন ?"
আঁতে ঘা লাগলো খুব । তবুও হেসে হেসে বলেছি "জী না, স্যার"।
প্রথম থেকেই জেদ টা মাথায় ছিল, মরে গেলেও মার্কেটিংএ চাকরি করবো না। ঘৃণা থেকে না। পছন্দ নয়। তাছাড়া একাউন্টিংএ পড়ে মার্কেটিংএ কাজ করবো কেন ? এটা এখনও আছে বটে। তবে আর কত দিন থাকবে কে জানে ?
এরকম হাজারও সমস্যা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, আবার কোথাও আমাকে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। একটা চাকরিই তো চেয়েছি, আর একটু সম্মান । খুব বেশিই কি চেয়েছি? জানিনা । তবে এখন ভাবছি "আগে তো বাঁচি"।
এদিকে মা বাবা বারবার তাগাদা দিচ্ছে "কিরে বাবা, কিছু হইল ?"
"এইতো , হয়ে যাবে। একজনের সাথে কথা হচ্ছে।"
"একটু ভাল কইরা চেষ্টা কর?"
"আচ্ছা" বলেই কেটে পরি । লজ্জায় । কি আর করতে পারি ? তাদের কে আশা দেই, কিন্তু আমাকে আশা দেবে কে ?
এদিকে বর্ষা মুখে কিছু বলছে না, ঠিকই তবে বুঝিয়ে দিচ্ছে কিছু একটা কর । এভাবে আর কত দিন ? বর্ষারও গ্রাজুয়েশন শেষ, চাকরিও করছে একটা । মাঝে মাঝে জোর করে যখন আমার মানিব্যাগ চেক করে, টাকা গোণার বাহানা করে । আমি বুঝি কেন করে । কিন্তু বারবার এরকম করতে আর ভালও লাগেনা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন । তবুও কিছু সময় বাধা দেই, কিছু সময় দেইনা।
ছোটবোনটাও ইদানিং পাল্টে গেছে অনেক । কিছু দিতে চাইলেও নেয়না। উল্টা মাঝে মাঝে সিগারেটের জন্য কিছু নিতে হয় ।
শুভাকাঙ্ক্ষী আপনজনের এসব আচরণ দেখি আর ভাবি "এসব কি দয়া , নাকি মায়া ?"
আর অন্য আত্মীয় সজনদের কথা না হয় বাদ দিলাম। তাদের মহামুল্যবান উপদেশ ! না শুনে তো আর উপায় নেই ! তাদের দোষ দিয়ে কি লাভ? আমিই কি এমন মহৎ। তবুও কি এতটা অহংকারী অথচ নির্দয় হতে পারতাম ? নাকি পারতাম না? জানিনা।
এসব চিন্তাই মাথায় ঘুরতে ঘুরতে সময় টা এগিয়ে এল। তাই শেভ করে, সেই এক শার্ট প্যান্ট, জুতা, বেল্ট পরে বেরিয়ে গেলাম। ওহো , ভাড়াও তো পকেটে কম। কোন রকমে বাসে কিছুটা গিয়ে, কিছুটা হেঁটে, যখন পৌঁছুলাম তখন বেলা পৌনে চারটা ।
১০/১৫ জন আগেই ওয়েটিং রুমে বসে ছিল। আমাকে দেখে তাঁদেরও চোখে মুখে উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ল, তেমনি তাদের দেখে আমারও উৎকণ্ঠা যেন একটু বেড়ে গেল।
"এতজনকে ডাকার দরকার ছিল কি?" মনে মনে তখন ভাবছিলাম।
তারাও কি আমার মত ভাবছে ? হয়তোবা ভাবছে , হয়তোবা ভাবছে না।
ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় বসে আছি। দুই একজনের সাথে টুকটাক কথা বলেছি । মাঝে অবশ্য এক কাপ চা দিয়েছে। বেশ ভালো চা বানায় অফিসগুলোতে । তাই কোনভাবেই মিস করিনা। চা খাওয়ার পর সিগারেট খাওয়ার নেশা বাড়ে। এখন কিছু করার নেই। পকেটে অবশ্য একটা সিগারেট আছে। সস্তা সিগারেট। "ডার্বি " দাম মাত্র তিন টাকা। একা থাকলে এটাই খাই। কেউ অবশ্য জানেনা। আর সবার সাথে থাকলে চুপচাপ থাকি। বন্ধুদের কেউ বেনসন বা গোল্ডলিফ ধরালে তখন মনের সুখে টানি। এছাড়া আর কিইবা করতে পারি?
আমাকে যখন ইন্টার্ভিউ রুমে ডেকে নেয়া হল, তখন বিকেল পাঁচটা । সালাম দিয়ে যখন ঢুকলাম, তখন বুকের ভেতরে ধুকপুকানি বেড়ে গেল। আমি নিশ্চিত , কান পাতলে কেউ শুনতে পারবে। বসতে বলার পর, বসলাম। একটার পর একটা কথা জিজ্ঞেস করছেন। কোনটা জবাব দিতে পারছি। কোনটা পারছি না।
তবে মনে হয়না খুব একটা খারাপ হয়েছে। একাউন্টিংএর যা জিজ্ঞেস করেছে, সবগুলোই তো পেরেছি। তবে তাদের অন্য কথার প্যাঁচে পরে যাচ্ছি বারবার। তবুও ঐযে একটা বড় দোষ "অভিজ্ঞতা নেই"। সেটাই যেন বড় হয়ে উঠলো আবারও । একজন আরেকজনকে তো বলেই বসলো "experience নেই। কাজ করতে গেলে কেমন করে ফেলে কে জানে? "
খুবই খারাপ লাগছিল তখন। কি আর করা। তবুও চেষ্টা করেছি, চেহারায় যেন টেনশন টা যেন না বোঝা যায়।
এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট পরে যখন বের হলাম তখন মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল "আমার চাকরিটা হবে তো ?"
অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই , দেখলাম আমার আগে ইন্টার্ভিউ দেয়া দুজন দাড়িয়ে আছে অফিসের একটু পাশের চায়ের দোকানে । আমি বের হতেই তাকালো আমার দিকে। আমিও তাকালাম ওদের দিকে। কোন কথা বললাম না। ওদের চোখের ভাষা আমি বুঝি, নিশ্চয়ই আমারটাও ওরা বুঝে ফেলেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৭