১
চিনি লাগবে?
প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে নীরা।তার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়।প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে।আজ কদিন থেকে বারবার এমন হচ্ছে।হঠাৎ করে নীরার সাথে কেউ একজন কথা বলা শুরু করে।প্রথমে নীরা কথাগুলো স্পষ্ট বুঝত না।মনে হত সুদূর কোন রাজ্য থেকে কিছু শব্দ এসে তার মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কিন্তু শব্দগুলোর কোন রকম অর্থ নীরা করে উঠতে পারত না।কিন্তু এখন খুব স্পষ্টভাবেই সে সবকিছু বুঝতে পারে।তবে নীরার জন্য সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে তার সাথে কথা বলা কণ্ঠস্বরটি একজন পুরুষের, যার সাথে নীরার পরিচিত কোন পুরুষ কণ্ঠের মিল নেই!
চারপাশের মানুষের মনের অলিতে গলিতে উঁকি মারার কৌতহল সবার মধ্যেই কমবেশী আছে।কিন্তু নিজের মনের দুয়ার খুলে তাকানোর মত সাহস খুব কম মানুষই করে।সিগমণ্ড ফ্রয়েড যে পদ্ধতিতে তার রোগীদের মনোঃবিশ্লেষণ করতেন, সেই একই পদ্ধতিতে কখনই নিজেকে বিশ্লেষিত হতে দেননি।কারন নিজের মনের অন্ধকার এবং অজানা দিকগুলো নিয়ে তিনি সবসময় ভয়ে থাকতেন।নীরাও তার মনের ঘরে প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে।তার ধারনা তার মনের ভেতর এমন কিছু ঘাপটি মেরে আছে যার জন্ম এই ভুবনে না।যা দেখামাত্র কিংবা অনুভব করা মাত্র নীরা আর নীরা থাকবে না।নীরা তখন অন্য কিছু একটাতে বিবর্তিত হয়ে যাবে।
তাই খুব কৌশলে নীরা নিজেই নিজেকে এড়িয়ে চলে।সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে সে ব্যাস্থ থাকে যেন কোন ভাবেই একাকীত্ব তার উপর ভর না করে।কারন মানুষ যখন একা হয়ে যায়, তখন মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব অব্যক্ত অনুভূতিগুলো ব্যক্ত হওয়ার জন্য পথ খুঁজে বেড়ায়।তখন মনের উপর ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি হয়।কিন্তু নীরা তার এই পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পারার কোন কারন খুঁজে পাচ্ছে না।নিজের ভিতর লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোকে সামলে নিয়ে খুব ভালো ভাবেই বেঁচে আছে সে।নীরা ভাবে এই পুরুষ কণ্ঠ তার অবচেতন মনের খেলা হতে পারে!কিন্তু অবচেতন মন তাকে নিয়ে এমন খেলা খেলবে কেন?তবে তার কি এমন কোন গোপন অপূর্ণতা কিংবা বাসনা রয়েছে যা সে নিজেই জানে না? মাঝেমাঝে নিজের কাছেই নিজেকে অচেনা মনে হয় তার।
২
-জানো, আজকাল এক অচেনা পুরুষ কণ্ঠ আমার সাথে কথা বলে!
বাহ! আজকাল দেখি ভুতেদের সাথেও প্রেম করছ খুব!
-তুমি কি?নিজেকে হঠাৎ মানুষ ভাবা শুরু করেছো নাকি!!!
আমি এমন একজন মানুষ, যে ভূতের মতই বেঁচে আছে।আমাকে মানুষভূত ভাবতে পার!
-এত ভাবাভাবির সময় নেই আমার!একটা মজার ঘটনা ঘটেছে।তোমাকে বলা হয়নি!বলবো?
বলে ফেল! মাঝেমাঝে মনে হয় তোমার গল্পগুলো শুনব বলেই আমি হাজার বছর ধরে বসে আছি-হাজার বছর ধরে-
-থাক! থাক! আর কাব্য করতে হবে না।তোমার ইচ্ছে হলে লক্ষ বছর ধরে বসে থাক।তাতে আমার কিছু যায় আসে না!
আমি কুরিয়ারে একটা নীল শাড়ি গিফট পেয়েছি।কে পাঠিয়েছে জানি না!শুধু একটা কার্ডে সুনীলের একটা কবিতার কয়েকটি লাইন লেখা আছে।
কি কবিতা?কোন লাইন?
-দাঁড়াও বলছি……
হুমম………..
-না, না, নীরা, ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি
তোমাকে আমার কিংবা আমাকে তোমার কোন
নির্বাসন নেই
ফিরে এস, এই বাহুঘেরে ফিরে এসো!
তুমি কি আসবে না নীরা? নীরার মুখে লেগে থাকা হাসি মুছে গিয়ে সেখানে ভয়ের চিন্হ ফুটে উঠতে থাকে।সেই অপার্থিব পুরুষ কণ্ঠ আবার ফিরে এসেছে।নীরা এক দৃষ্টিতে তার ডেক্সটপের স্ক্রিনের চ্যাটবক্সের দিকে তাকিয়ে আছে।সেখানে একের পর এক মেসেজ আসছে।কিন্তু নীরা সেসব কিছু দেখেও দেখছে না।কোন এক অভিশপ্ত চিন্তায় সে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।তার খুব ভয় করছে!খুব!
৩
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তরুন ডাক্তার হাসান তারেক কিছুটা বিচলিত বোধ করছেন।তার সামনে নীরা বসে আছে।একজন মনের ডাক্তার হিসেবে রোগীর সামনে এভাবে নিজের অস্তিরতা প্রকাশ করা ঠিক না।এতে করে ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা কমে যেতে পারে।কিন্তু নীরাকে দেখলেই তার এমনটা হয়।নীরা যখন তার চোখে চোখ রাখে তারেকের মনের মধ্যে একটা ঝড় চলতে থাকে।হোক সেটা কফি হাউজে কিংবা নিজের চেম্বারে!নীরা সেটা বুঝেও না বুঝার ভান করে বসে থাকে।তবে আজ নীরা তারেকের কাছে রোগী হিসেবে এসেছে।তাই তারেককেও ভুলে যেতে হবে নীরা তার পরিচিত কেউ।খুব দ্রতই নিজেকে সামলে নেয় হাসান তারেক।
তুমি ঠিক কখন তার কথা শুনতে পাও?
-ঠিক নেই।হঠাৎ হঠাৎ সে আমার সাথে কথা বলা শুরু করে।যেমন ধর, আমি চা খাচ্ছি।সে এসে বলবে চিনি লাগবে?
হুম……..বুঝলাম……তুমিও কি তার সাথে কথা বল?তার কথার উত্তর দিয়েছ কখনও?
-না উত্তর দেইনি।এখনও পুরোপুরি পাগল হয়ে যাইনি।পাগল হয়ে গেলে আমিও কথা শুরু করব।এ কথা বলেই হেসে দিল নীরা।
তারেক মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে।তার সবকিছু আবার উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।এই মুহূর্তে তার একটি কাজ করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু অসময়ে এসব ইচ্ছের জন্য নিজেকেই নিজের থাপ্পর মারতে ইচ্ছে করে তারেকের।
সে তোমার সাথে কি বিষয় নিয়ে কথা বলে……..মানে তার কথার গভীরতা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি!
-অনেক কিছু নিয়েই কথা বলে।তার সবকথা আমাকে নিয়েই।যেমন একদিন বাথটাবে শুয়ে ছিলাম…..তখন সে বলল তোমাকে……….বলা যাবে না………..লজ্জা লাগছে……… নীরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
এবার তারেকও হেসে ফেলে।নীরা শোন,
তুমি অনেকবছর ধরে একা থাকছ।হয়তোবা অনেক কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছ-কিন্তু মনে মনে সবসময় চেয়েছ কেউ একজন তোমার পাশে থাকুক।তুমি যখন খুব কষ্টে থাক তখন কেউ একজন তোমার সব কষ্ট তার আদর দিয়ে মুছে ফেলুক।এই চাওয়াটা অস্বাভাবিক না।বরং এটাই স্বাভাবিক।তাই তোমার অবচেতন মন তোমার মধ্যে এক ধরনের অবসেশন তৈরি করেছে।এই জন্য তুমি কাল্পনিক কারো কথা শুনতে পাও।প্রথমে ভয় পেলেও এখন তুমি আনন্দ পাচ্ছ।কয়েকদিন পর তুমি ব্যাকুল হয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করবে।তারপর হয়তোবা কোন একদিন তুমিও তার সাথে কথা বলা শুরু করবে।তোমার একাকীত্ব একমাত্র কারন না হলেও এই অডিটরি হ্যালুসিনেশান হওয়ার অন্যতম শক্তিশালী কারন।তাই বলছি, বিয়েটা এবার তুমি করেই ফেল।দেখবে সব রোগ সেরে যাবে।
-তুমি কি ডাক্তার নাকি ঘ্টক?নাকি চেম্বারে রোগীকে অসহায় পেয়ে নিজেই পাত্র হিসেবে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ?আর একটা কথা……..যেটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম-আমি একটা নীল শাড়ি উপহার পেয়েছি।কে কোথা থেকে পাঠাল জানি না।তবে……….
প্রেমিকের অভাব তোমার কখনই ছিলনা।তাদের মধ্যে কেউ একজন হবে হয়তো!আহা!আমার যদি এমন কেউ থাকত!!
-ওই শাড়ি পাঠানোর পর থেকেই আমার অডিটরি হ্যালুসিনেশান শুরু হয়।সে বারবার অনুরোধ করছে শাড়িটি পড়ার জন্য। এই শাড়িতে আমায় কেমন লাগে সেটা নাকি সে একবার দেখতে চায়!
নীরা, তুমি বিভিন্ন কারনে স্ট্রেস এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ।এবং একই সময়ে কিছু রহস্যময় ব্যাপার ঘটায় তোমার মধ্যে একধরনের ঘোরের জন্ম হয়েছে।তোমাকে কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি এবং তার সাথে ফ্রি হিসেবে একটা পরামর্শও দিচ্ছি।ছুটি নিয়ে কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে যাও।পাহাড় কিংবা সমুদ্র কিছু একটা দেখে আস।তবে একা যেও না!
-আমিও তাই ভাবছিলাম।অনেকদিন সমুদ্র দেখা হয় না।ভাবছি, কিছুদিনের জন্য চিত্তে সমুদ্রের হাওয়া লাগিয়ে আসব।তবে চিন্তা কর না।আমি একা যাব না!
একথা বলে নীরা তারেকের দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময় হাসি দেয়।নীরার হাসিতে এমন কিছু ছিল, যা তারেককে শিহরিত করে!
৪
কদিন থেকে মনে হচ্ছে সমুদ্র আমাকে ভীষণ ভাবে ডাকছে………
-ডাক্তার কি বলেছে?
সে আর কি বলবে? তারেক আমাকে দেখলেই অস্থির হয়ে যায়! তখন মনে হয় তার নিজেরই চিকিৎসা দরকার।
হা হা হা………………
-তুমি নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে অন্য কিছু ছিলে!ডাইনী টাইপ কিছু।নাহলে প্রেমিকের ভগ্ন হৃদয় নিয়ে কেউ এভাবে হাসতে পারে?
আমি ঠিকই ছিলাম!!! তুমি মনে হয় দেবদাসের ভূত ছিলে......তাই আমাকে ডাইনি টাইপ কিছু মনে হচ্ছে…………
হা হা হা.........
-খুব খুশী খুশী মনে হচ্ছে আজ…….কাল্পনিক কণ্ঠের প্রেমে পড়েছ নাকি?
আমি সবসময় আনন্দে থাকি!তোমার মত দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বসে থাকার কোন কারন আমার নেই।আর তাছাড়া আমি বহুদিন পর সমুদ্র দর্শনে যাচ্ছি......তাই এক অন্যরকম ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি!
নীরার মাথায় কেউ একজন খুব হাসতে থাকে......
নীরা ভয় পায়না।তার আসলেই খুব আনন্দ হচ্ছে।এ এক অন্যরকম শিহরণ, অন্যরকম পুলক যা সে আগে কখনই অনুভব করেনি!
তোমার সাথে কে যাচ্ছে?
-সেটা তোমাকে বলা যাবে না!তোমাকে কি আমি দুঃখ দিতে পারি বলো?
আমি এখন গেলাম।
বাই বাই………
ওপাশে কেউ একজনের হাত কীবোর্ডের সামনে এসেও থেমে যায়!শুধুমাত্র একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়, যে শব্দ কোথাও গিয়ে পৌঁছে না………
৫
সমুদ্র এবং চাঁদের মায়াবী আলোছায়ার খেলার মাঝে যখন কেউ হারিয়ে যায় তখন সে আর এই পৃথিবীর কেউ থাকে না!অপার্থিব সপ্নের মত কিছু একটা হয়ে যায় যাকে এই পৃথিবীর পার্থিব কোলাহলে থেকে কখনই স্পর্শ করা যায় না।এমনি এক মায়াবী জগতের রূপকথার রাজকন্যা হতে চেয়েছিল নীরা।আজ সে নীল শাড়ি পরে সমুদ্রের নীলের সাথে নিজের ভিতর গর্জে উঠা ঢেউগুলোকে মিলিয়ে দিতে এসেছে।
কেউ একজন নীরাকে খুব করে ডাকছে।তার যাপিত জীবনের সব অশ্রুজল পরম মমতায় মুছে দিবে বলে কেউ একজন একটু অদূরেই জানু পেতে বসে আছে।আজন্ম চুম্বনে সব দুঃখ চুষে নিবে বলে কেউ একজন ডেকেই যাচ্ছে, আয়! আয়!একটু একটু করে সেই স্বপ্ন পুরুষের সুখস্পর্শের দিকে নীরার বাড়িয়ে দেওয়া হাত সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়নি।পরম মমতায় সে নিজের অতলে ডুবিয়ে দেয় নীরার আজন্ম লালিত স্পর্শসুখের সব উৎসব!
৬
আজ হাসান তারেকের জন্য খুব আনন্দের একটি দিন।আরেকটি খেলায় সে জিতে গেছে।দিনে দিনে নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে।যদিও তার এই খেলা কিংবা খেলার খবর অন্য কেউ জানে না।তাই অন্য কারো মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই।তাকে একাই খেলে যেতে হবে, একাই মুগ্ধ হতে হবে।নীরা কখনই আর জানতে পারবে না তার অনলাইন ফ্রেন্ড, কাল্পনিক প্রেমিক এবং হাসান তারেক একই ব্যক্তি।নীরাকে খুব দ্রুতই ভাবনা থেকে সরিয়ে দিতে হবে।নতুন খেলা শুরু করতে যাচ্ছে তারেক।কাল মাধবীলতার ঠিকানায় একটি গোলাপি রঙের শাড়ি পাঠাতে হবে।তারপর কি হবে সেটা ভাবতেই তারেকের চোখে মুখে রহস্যময় এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে।যদিও তা কেউ দেখে না!কেউ না!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৪