(১)
মিজানুর রহমান নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি এখন কি করবেন। তার মাথায় সকল চিন্তাভবনা কেমন যেন জট পাকিয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি প্রবল অস্থিরতা নিয়ে তার ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা অবধি দ্রুত বেগে পায়চারি করছেন। চোখে মুখে তার অসহনীয় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অথচ তার এমন অবস্থা হওয়ার তেমন কোন ইঙ্গিতই ছিলো না দিনের শুরুতে। উল্টো আজকের দিনটা মিজানুর রহমানের জন্য একটা বিশেষ দিন। কারণ আজ তার একমাত্র মেয়ে অবন্তীর বিয়ে। সকাল থেকেই মিজানুর রহমান তাই ব্যাপক আনন্দের মধ্যে ছিলেন। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি নামাজ পড়েছেন। বাসায় আসা পারিবারিক অতিথিতেদের সাথে মন খুলে কথা বলতে বলতে সকালের নাস্তা সেরেছেন, এরপর তিনি গিয়েছেন অবন্তীর রুমে, অবন্তীর মাথায় হাত রেখে মেয়ের আশু বিয়োগ ঘটিত বেদনা নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ শিশুর মতো অঝোরে কেঁদেছেন, শেষে অবন্তীর আগত বিবাহিত জীবনের মঙ্গল কামনা করে তাকে ছোটখাটো কিছু উপদেশও দিয়েছেন। অবন্তীর রুম থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেয়ের বিয়েকে ঘিরে তিনি মোটামুটি একটা হুলুস্থুল টাইপ আয়োজন করেছেন, সেই আয়োজনেরই বিভিন্ন খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে তিনি ক্রমাগত কথা বলতে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়। ছেলে পক্ষের লোকজন যাতে বিয়ে ঘটিত ব্যাপার নিয়ে কোথাও কোন খুঁত ধরতে না পেরে সেটা নিশ্চিত করার জন্য মিজানুর রহমানের আপ্রাণ চেষ্টা সেই তখন থেকেই এই ভর দুপুর অবধি অব্যাহত ছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে অবন্তীর মা এসে তাকে যে খবরটা শুনিয়েছেন সেটার জন্য মিজানুর রহমান কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না। বিনা মেঘে বজ্রপাত প্রবাদটার যথার্থতা নিয়ে মিজানুর রহমানের মনে আজ পর্যন্তও যদি কোন সংশয় থেকে থাকতো, তবে আজ যে তা দূর হয়ে গেছে তাতে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা না। কারণ অবন্তীর মা এসে তাকে কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছে--অবন্তী পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় নিজের রুমে ছোট্ট একটা চিরকুটে বড় বড় করে লিখে গিয়েছে সে--"তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করো"। পুরো ব্যাপারটা অবন্তীর মার কাছ থেকে শোনার পরও মিজানুর রহমান কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এ কি করে সম্ভব! অবন্তী কেন পালিয়ে যাবে? এমন তো না যে তিনি মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছেন। এই বিয়ে ঠিক করার আগে অবন্তীর সাথে তিনি বেশ কয়েকবার কথাও বলেছেন। অবন্তীর কোন পছন্দ আছে কিনা সেই বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সাথেই তিনি অবন্তীর সাথে কথা বলেছেন, কই অবন্তী তো তখন তাকে কিছুই বলেনি? নাকি মেয়েটা লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি? কিন্তু তাও তো হতে পারে না, সে রকম হলে তো অন্তত পক্ষে মেয়েটার চোখে মুখে কিছুটা হলেও ব্যাপারটা ধরা পড়তো। অন্যদিকে যে ছেলেটাকে তার বর হিসাবে ঠিক করা হয়েছে তার ব্যাপারে অবন্তীর কোন আপত্তি আছে কিনা সেই ব্যাপারেও তিনি অবন্তীর কাছে জানতে চেয়েছেন, অবন্তী হাসিমুখে তাকে জানিয়েছে যে-- সে রাজি। আজ সকাল অবধিও মেয়েটাকে তিনি খুব হাসিখুশি দেখেছেন। গত কয়েকদিন ধরেই সবার সাথে খুশি খুশি মন নিয়ে কথা বলেছে অবন্তী, মুরুব্বিদের বিভিন্ন হাসি ঠাট্টায় মাথা নিচু করে হেসেছে, ভাই বোনদের খুনসুটি টিপ্পনীতে তাদের সাথে মৃদু মন্দ আহ্লাদী ঝগড়াও করেছে। মোদ্দা কথা মেয়ের গত কয়েকদিনের কর্মকান্ডের কোন কিছুতেই তিনি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া এই কুৎসিত ঘটনার ইঙ্গিত পাননি, মিজানুর রহমান তাই অনবরতই ভেবে চলেছেন কি কারণ থাকতে পারে অবন্তীর এই অতি অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটানোর পিছনে। তিনিই বা এখন কি করবেন? বর পক্ষের লোকজনদের কাছে তিনি কি জবাব দিবেন? তিনি এখনো বুঝে উঠতে পারছেন জীবনের এই পর্যায়ে এনে আল্লাহ তাকে এ কোন ধরনের কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিলেন?মিজানুর রহমানের স্পষ্টই বুঝতে পারছেন তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন, ধীরে ধীরে নিজের চারপাশটাকে কেমন যেন ঘোলাটে আর অন্ধকার লাগতে শুরু করেছে তার। অন্যদিকে মিজানুর রহমানের বাসার সবার মধ্যেই এখন একটা প্রবল উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে, ঘটনার অতি আকস্মিকতায় সবাই যার পর নাই বিস্মিত ও স্তম্ভিত।
(২)
এখন বাজে দুপুর সাড়ে তিনটার মতো। এই ধরনের পরিস্থিতে যে কেউই ধরে নিবে যে অবন্তী হয়তো তার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছে, যদিও ব্যাপারটা মোটেই সেরকম কিছু না, অবন্তীর হাত আকড়ে ধরে রাখার মতো কোন পরুরষই এখনো তার জীবনে আসে নি, আসলে মনে হয় ভালোই হতো, অনন্ত আজ এই চরম বিপদের অবন্তী হয়তো সেই মানুষটার কাছেই নিজের আশ্রয় খুঁজে নিতো, হায়! তার পরিবারের মানুষগুলো হয়তো কোনদিনও জানতে পারবে না কি ভীষণ মানসিক যণ্ত্রনা আর বেদনা নিয়ে সে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে আজ কঠিন এক অনিশ্চয়তার পথে।
অবন্তী এখন বসে আছে কমলাপুর রেল স্টেশনে যাত্রার শুরুর অপেক্ষায় থাকা সিলেটগামী সুবর্না এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেনীর একটা কামরার জানালার ধারের একটা সিটে। গত কয়েকদিনে সে বাসার মানুষগুলোর সাথে অনেক অভিনয় করেছে, কউকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি নিজের চিন্তা ভাবনার কথা। ট্রেনের টিকিটটা কেটে রেখেছিলো সে অনেক আগেই। সিলেটের একটা নামকরা চা কোম্পানীর সুপারভাইজারের পোস্টে মোটামুটি বেতনের একটা চাকরি হয়ে গেছে তার। এই চাকরির কথাও সে কাউকেই বলে নি। শধু নিজের মনে মনেই আজকের দিনটার প্রতীক্ষা করেছে, যদিও এই প্রতীক্ষা ছিলো বড় বেদনার। কোম্পানীতে তার জয়েনিংটা আরো দুই দিন পরে, কিন্তু বাধ্য হয়েই টাকে দুই দিন আগেই চলে যেতে হচ্ছে, কোম্পানীকে সে এ কথাটা জানিয়েছেও, সেই অনুযায়ী কোম্পানীর পক্ষ থেকেও তার থাকা খাওয়ার বন্দোবস্তটাও দুই দিন আগেই করা হয়ে গিয়েছে। জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে স্টেশনের প্ল্যাটফরমটার দিকে তাকিয়ে আছে অবন্তী। সেই ছোটবেলা থেকেই স্টেশনের অতি ব্যস্ত কোলাহলময় তাকে যার পর নাই মুগ্ধ করে। সবাই ব্যস্ত এখানে--কেউ কেউ ফিরে আসায় ব্যস্ত, কেউ কেউ চলে যাওয়ায় ব্যস্ত, কারো কারো মুখাবয়বে নীড়ে ফেরার আনন্দ, কারো কারো নীড় ছেড়ে কিছুদিন পালিয়ে বেড়ানোর আনন্দ। যারা নীড় ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানোর আনন্দ খোঁজে, নীড়টা আছে বলেই তো আনন্দটা তাদের কাছে এতো মধুর মনে হয়, অথচ অবন্তীর? সে যে আজ তার চিরচেনা নীড় ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সেই নীড়ে আদৌ কোনদিন আর তার ফিরে আসা হবে কিনা--সেই ব্যাপারে যথেষ্টই সন্দিহান অবন্তী, কাজেই তার এই পালিয়ে যাওয়ায় কোন আনন্দ নেই, কোন সুখ নেই, কোন রোমাঞ্চকর অনুভূতিও নেই---কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলো অবন্তী। হঠাৎ করেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে আরম্ভ করলো সিলেটগামী সুবর্ণা এক্সপ্রেস। সাথে সাথে অবন্তীর ভাবনার তালটাও কেটে গেলো। ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে অবন্তী আর অন্যান্য সকল যাত্রীদের নিয়ে সুবর্না এক্সপ্রেসটা ছুটতে লাগলো সবুজের শহর সিলেটের উদ্দেশ্যে।
..............................................................(চলবে)