somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: গয়নার বাক্স

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গয়নার বাক্স

সারা বাড়ি জুড়ে বিয়ের আমেজ। বড় ফুপ্পি গ্রাম থেকে এসেছেন, তিনি সকাল-বিকাল অনেক নিয়ম-আচারের কথা বলছেন, যা মা নিজেও জানতেন না। হলুদের সময়ে সাত-সধবা গোসল করাবে, সোনা রূপার পানি আমপাতা দিয়ে হলুদের আগে সবখানে ছড়িয়ে দিতে হবে, বিয়ে পড়ানোর সময় জামাই এলে পেস্তাদুধ দিয়ে বরণ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মা হয়রান সবদিক সামলাতে। বিয়ের বাজার, তার সাথে মেহমানদারি, এক হাজার ঝুটঝামেলা! বাবা রোজ সকালে বেড়িয়ে যান এক তাড়া নিমন্ত্রনপত্র নিয়ে, বিকেল বিকেল ফিরে, খেয়ে, আবার বের হয়ে যান, অনেক রাতে ফিরেন। সপ্তাহ খানেক বাকি মাত্র, এত করেও দাওয়াত পর্ব শেষ হবে কিনা কে জানে! কত যে লোক আসছে যাচ্ছে।

আমি আছি একটা ঘোরের মধ্যে। আমার বিয়ে! সাত দিনের মাথায় আমি নুতন একটা জীবনে ঢুকতে যাচ্ছি। আমি কি তার জন্য প্রস্তুত? না, বাবা-মায়ের পছন্দে নয়, আমি নিজের পছন্দের লোককেই বরণমালা দিতে চলেছি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি জানি এই পছন্দ আসলে নিজের সাথে এক সমঝোতা মাত্র। আমি নিজেই নিশ্চিত নই এই বিয়েটা করা ঠিক হচ্ছে কিনা।

স্কুলে পড়ার সময় আমার একজনকে অনেক ভাললাগতো। কিন্তু কৈশোরের ভাললাগাকে সারা পৃথিবীর কাছে জানাবার মত সাহস সঞ্চয় করা হয়নি। সেই ভাললাগা ছিল অনেক গোপন, রাতে মশারীর ভিতর শুয়ে শুয়ে তার সাথে সারাদিনে কতবার চোখাচোখি হয়েছে, কতবার তার ভুবনজয়ী হাসি আমার মনকে নাড়া দিয়ে গেছে তার হিসাব করতাম; কিন্তু দিনের আলোয় সেই হিসাবের নথি নিয়ে তার সাথে কথা বলার সাহস ছিল না, আমার নিজের ডাইরী ছাড়া এ জগতের কেউ জানে না তার কথা, তাকে আমার না বলা যত কথা, বোধের গভীরে সন্তর্পণে লালিত সীমাহীন মুগ্ধতার কথা!

ও নিজেও কি টের পেত না? আমার চোখের মনিদুটো যে সূর্যমুখির মত ওর দিকে চৌম্বকীয় মুগ্ধতা আর সকরুণ ব্যাকুলতা নিয়ে চেয়ে থাকত, তার আভাস সে পায়নি, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ তার চোখও আমায় খুঁজে ফিরত, তার কিছু কিছু মৃদু হাসি শুধু আমার জন্যই ছিল, শীতের বাতাসের মত শিরশিরিয়ে কে যেন আমার মনকে সেই বার্তা পৌছে দিত, আমি আহ্লাদে গলে মনে মনে কতই হাসতাম আনমনে! একই স্কুলে পড়তাম তার সব কান্ড কারখানা, আমার সব বোকামী দুজনের কারোরি অজানা থাকত না। সামনাসামনি কথা হয়েছে বড়জোর তিন চারবার, কিন্তু মনে মনে যে হাজার কথা বলা সারা!

কিন্তু শংকাও ছিল তাকে নিয়ে। সারা স্কুলে তার ভীষন জনপ্রিয়তা। অনেক সুন্দরী মেয়ে তার অনুরক্তা ছিল, তার ক্লাসের একজনকে নিয়ে কত যে রটনা! খুব সাধারণ আমি এইসব গল্প শুনে ধরেই নিয়েছিলাম আমার প্রতি তার অনুগ্রহ, অনুকম্পা বই নয়! আমার পূজার নিরব আরতির প্রতিদানে, ভক্তের জন্য দেবতার স্নেহের প্রসাদ।

আমার থেকে তিন বছরের বড় বলে স্কুলের পাঠ শেষ করে এক দিন কোথায় যে সে হারিয়ে গেল। আমিও আমার ভয়ের আড়ালেই থেকে গেলাম, তাকে সত্যিকার অর্থে খুঁজিও নি। যেদিন তাকে শেষ দেখেছিলাম অনেক দূর থেকে, জেনেছিলাম আর হয়তো দেখা হবে না কোনদিন, সেদিন বাসায় ফিরে ডাইরী আঁকড়ে অনেক কেঁদেছিলাম, আর তো ওকে নিয়ে কিছু লেখারও থাকবে না। আমাকে ও ওর বন্ধু মারফত একবার খবর দিয়েছিল দেখা করার জন্য। আমি ভয়ে যাইনি। বাবা-মা কোনদিন মেনে নিবেন না, তারা দুঃখ পাবেন, এই ভেবে আমি যাইনি তার সাথে দেখা করতে। কি বোকাই না ছিলাম! আমার এখনো মনে আছে, ওকে নিয়ে আমার শেষ লেখা---
-----
“মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে
যেতে যেতে দুয়ার হতে কি ভেবে ফিরালে মুখ খানি
কি কথা ছিল যে মনে মনে--”

তোমার মনের কথা তুমি জানাতে চেয়েছিলে, আমি জানতে যাইনি। আমার সকল অক্ষমতা, সকল কুন্ঠা ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। তুমি যেখানেই থাক, ভাল থেক। অনেক অনেক ভাল থেক। তোমাকে আমার দূর থেকে প্রণাম, সমস্ত শুভেচ্ছা আর হৃদয় নিঙরানো ভালবাসা।
“আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ-
আমার লাজ ভয়, আমার মান আপমান, সুখ দুখ ভাবনা।।
মাঝে রয়েছে আবরণ কত শত, কতমতো—
তাই কেঁদে ফিরি, তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে মনের বেদনা।।“
----

আমি তাকে নিয়ে আর কোনদিন কিছু লিখিনি ডাইরীতে। কিন্তু সেদিনই আমার কল্পলোকে জন্ম নিল আমার চিরবন্ধু, সুখদুখের সাথি, আমার রাজকুমার, আমার প্রেমিক “অনিক”। যার আদল ছিল তার মত, স্বভাব ছিল তার মত, যার হাসি ছিল তার মত বিমুগ্ধকর হৃদয়হরণি,—তার আদলে গড়া আমার কল্পনার রাজপুত্র তার শূণ্যস্থান পূরণ করে দিল। আমার কল্পনার অনিককে আঁকড়ে ধরে আমি মেনে নিলাম আমাদের চিরবিচ্ছেদ। প্রায় প্রতিদিন ডাইরী লিখতাম, যেন অনিককে লিখছি চিঠি, সবকিছু তাকে সম্বোধন করে।

মা মনে হয় টিভি ছেড়েছে। তারা মিউজিক মার প্রিয় চ্যানেল। কি অবাক কান্ড আমার সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন সর্বাণী, কি মায়া ওর গলায়, বুকের মাঝখানটায় ছুঁয়ে যায়--

“তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে,
একদিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে
তবু মনে রেখো।
একদিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে—মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়ন কোণে—
তবু মনে রেখো।“

একটা সময় ছিল এই গানটা শুনলেই সৌমিকের কথা মনে পড়ত। ও না থেকেও ছায়ার মত সত্যি আমাকে ঘিরে থাকত। ওই কি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ প্রেম? অনিক কে আমি সৃষ্টি করেছি, সেটা সৌমিককে পাব না বলেই, ওর রিপ্লেসমেন্ট? অকারণেই চোখ ভিজে উঠত। রবীন্দ্রনাথ কি করে লিখেছেন এমন? সবসময় গানটা শুনলে বুকের ভিতর কি এক হাহাকার, কি এক শূন্যতা গুমড়ে উঠে। এখনো তাই! কি আশ্চর্য!

আসলেই কত্তদিন পার হয়ে গেছে। সেই কবে আমি সৌমিককে শেষ দেখেছি। এরপর দিন চলে গেছে দিনের নিয়মে। পদ্মার, মেঘনার অনেক জল বঙ্গোপসাগরের লোনা জলে মিশেছে। অনেক পলি পড়ে কত নুতন দ্বীপের জন্ম হয়েছে। আমি স্কুলের গন্ডি পেড়িয়ে কলেজ, কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ঠেকলাম। ততদিনে ওর ভাবনা আমাকে আর সর্বক্ষন ঘিরে থাকত না। আমার যে অনিক আছে তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকবার প্রাক্কালে আমার এক সহপাঠী, তুহীন, তার অনুরাগ প্রকাশ করল আমার প্রতি। বাসা থেকেও বিয়ে নিয়ে অনেক চাপ দিচ্ছিল। ভাবলাম, আমাকে যে বুঝবে তাকেই না হয় বিয়ে করি! আমি তো অনিক ছাড়া কাউকে ভালবাসতেই পারব না। যার সাথে আমার রুচিতে কিছুটা মিলে, ভবিষ্যত ভাবনায় মিলে তাকেই নাহয় জীবনে জড়াই।

কিন্তু তুহীন কি সত্যি আমাকে ভালবাসে? ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে ও মনিজা নামের এক মেয়েকে ভালবাসত। মেয়েটির হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তুহীন খুব ডিপ্রেসড হয়ে গেছিল, উত্তরায় কোন সাইক্রিয়াটিস্টও দেখিয়েছিল। ওর জীবনের কস্টের কথা শুনে আমার খুব মায়া লেগেছিল। ভালবাসা এত বৈরী কেন? মিলনের থেকে বিচ্ছেদের পাল্লাই কেন ভারী সবসময়? আমার নিজেরও তো চিরবিরহে বাস। তখন তুহীনের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল, আমরা বোধহয় একে-অন্যকে বুঝতে পারতাম। কিন্তু এই পারস্পরিক আস্থা আর আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ভালবাসা নয় সেটা আমি নিশ্চিত। আমার বিয়েটা তাই একটা সমঝোতা মাত্র। তাই বুঝি মন সরছে না, চাইছে না এই ভালবাসাবিহীন শিকলে বাঁধা পড়তে! তাই আজকে আমার মনের এই অস্থির হাল, সব ভেঙে পালানোর সুপ্ত ক্ষ্যপা ইছাটা মাঝে মাঝে বুকের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে!

ধূর! আজকে যে আমার কি হল, কেন এসব সাতপাঁচ ভাবছি। আমার বিকালে পার্লারে যাবার কথা, ফেসিয়াল করাতে। একটু পরে সাবাহ আসবে, ওর সাথে যাব। কিন্তু মনটা কেন যে এত্ত উদাস হয়ে আছে। শুনলাম কলিংবেল বাজল। এইযে সাবাহ এসে গেছে। যাক বাবা, ওর হৈচৈতে আমার পাগলামি ভাল হয়ে যাবে। একি আবার বাজল, কেউ দরজা খুলছে না কেন। আমিই গেলাম দরজা খুলতে। খুলে দেখি সাবাহ নয়, কুরিয়ার সার্ভিসের এক লোক, আমার নামেই একটা ডেলীভারি। একটা বিশাল প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সিগ্নেচার নিয়ে চলে গেল। মোটামুটি ভারী একটা বাক্স মনে হচ্ছে। কে পাঠাল?

ঘরে এনে মোড়ক খুলে আমি বিস্ময়ে হতবাক। কি সুন্দর কারুকার্য খচিত একটা বাক্স। কি মসৃণ, কি নিখুত তার নকশা। হুক খুলে ভিতরে দেখি নিখুএ প্ল্যানিং এ সাজানো আরো ছোট বড় বাক্স আর ট্রে। চুড়ি রাখার আলনা, কানের দুল রাখার, গলার হার রাখার ট্রে। এত দারুন গয়নার বাক্স আমি জীবনে দেখিনি। কেমন যেন মন ভাল হয়ে গেল, একটু আগের ভার ভার ভাবটা এক নিমেষে গায়েব! চুড়ির আলনার সাথে দেখি একটা সাদা ধবধবে খাম। হঠাৎ বুকের মাঝে গুড়গুড় করে উঠল, সৌমিক! ও যে অনেক কাঠের জিনিষ বানাতো! স্কুলে কত্ত দেখেছি!

আমার হাত কাঁপছিল। ও কি করে আমার ঠিকানা পেল? এতদিন পর ও কি লিখেছে? আলতো করে চিঠি বের করলাম। আমি কিছু পড়তে পারছিনা কেন, সব এমন ঝাপসা লাগছে কেন? টপ টপ করে কয়েক ফোটা পানি আমার হাতের উপর পড়ল, কখন যে চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে বুঝতেই পারিনি! ত্রস্ত হাতে চোখ মুছে পড়তে শুরু করলাম, মনে যে ঝড় শুরু হয়েছে, তাকে থামাই কি করে?

প্রিয় বিভা,
তোমাকে প্রিয় সম্বোধন করলাম। রাগ করো না। তুমি আমার কতটা প্রিয় তার ইতিহাস আজকে লিখব না। সেই কবে থেকে তোমাকে চেয়ে আসছি তার সকরুণ বিবরণও নয়। আজকে শুধু তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই। তোমার আগামী দিন যেন অফুরান আনন্দে ভরে থাকে, সেই শুভাশীষ জানাতে চাই। আমার সচেতন বোধ হবার পর থেকে তাই যে চেয়ে এসেছি আজ অব্দি।

আমি সপ্তাহখানেক আগে দেশে এসেছি। তোমার উপর অভিমান করে দেশ ছেড়েছিলাম। জ়েদ করে বাইরে পড়তে চলে গেছিলাম। বাবা-মা জমি বিক্রি করে আমাকে পড়িয়েছেন। কিন্তু তখন এসব ভাবিনি। কি এক দুরন্ত অভিমান তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তোমার উপর আমার অনেক অনেক অভিমান জমেছিল। এইচএসসির পর আমি তোমাকে দেখা করতে বলেছিলাম, তোমার মনে আছে? তুমি কেন আমার সাথে দেখা করনি সেদিন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমার ভালবাসাটা একতরফা নয়। আমাকে দেখলেই তোমার চোখে যে দ্যুতি খেলা করে যেত, যে মিষ্টি হাসি দিয়ে তুমি পৃথিবীকে পদানত করতে পার, তার আভাস তোমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠত, তারাই সেই দৃঢ়তা জুগিয়েছিল।

কিন্তু সব কিছুকে মিথ্যা প্রমাণ করে তুমি যখন এলে না, তখন বুঝে নিলাম, আমার ভালবাসার অর্ঘ তুমি নিবে না, তা মূল্যহীন তোমার কাছে। আমি জোড় করি না কিছুতেই। অন্য প্রেমিকদের মত পিছন পিছন ঘুরঘুর করা কিম্বা তোমাকে উতক্ত করে প্রেম নিবেদন আমার রুচি বিরুদ্ধ। কিন্তু একই শহরে থাকব আর তুমি আমার জন্যে হাসবে না, সেটা মেনে নেয়াও কঠিন ছিল আমার জন্য। তাই পালিয়েছিলাম সব ছেড়ে। চলে গিয়েছিলাম আমেরিকা।

লাভ হয়নি বেশী। তোমাকে ভুলতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি সেই অর্থে, তোমাকে ভোলা মানে নিজের আত্মাকে অস্বীকার করা, তাই না! তবে ওদের গতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে, পড়া আর কাজ় নিয়ে ব্যস্ত থেকে জীবন কিছুটা সহনীয় হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরিও করতে শুরু করে দিলাম। মা আমার বিয়ে নিয়ে অনেক অস্থির, অহর্ণিশি একই ভাঙ্গা রেকর্ড, বিয়ে কর বাবু, বিয়ে কর!

হঠাৎ আমার মনে হল, পনের বছরের এক কিশোরী আমার কাছে আসেনি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে, তার অনেক শংকা ছিল হয়তো, অনেক অজানা ভয় কাজ করেছিল, আজকের বাইশ বছরের পরিনত তরুনীর সেই ভয় হয়তো ভেঙেছে! যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিনই টিকেট কেটে চলে এলাম। এবার তোমার সাথে নিজে গিয়ে দেখা করব, আমার কোথায় যে এক আস্থা ছিল, আমি হাত বাড়ালে তুমি সেই হাত ধরবেই।

কিন্তু তোমাকে খুঁজে পাব কি করে। সব বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছি। কেউ কিছু জানে না। তোমার ক্লাসের দু-তিন জন ছেলের কাছেও গিয়েছিলাম, ওরাও জানে না। শুধু বলল তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছ। তোমার ডিপার্টমেন্টের পিওনকে ঘুষ দিয়ে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি। কিন্তু চলে আসার সময় তিনিই জানালেন তোমার বিয়ের খবর।

নাহ হৃদয় ভেঙ্গে যায়নি। গত সাতবছর কোন যোগাযোগ ছাড়া যেভাবে কেটেছে সেইভাবে আমার বাকী দিন কেটে যাবে, সেটা আমি জানি। তোমার শূন্যতা আমি আসলে খুব বুঝিনি, মনে মনে সবসময় তোমার সাথে কথা বলতাম যে! তুমি সবসময় ছিলে আমার মনে, আমৃত্যু থাকবে। তুমিতো জানই আমি ছেলেবেলায় কাঠ দিয়ে জিনিষপত্র বানাতাম। কত কিছু যে তোমার জন্য বানিয়েছিলাম সেই ছেলেবালায়। চুড়ির বাক্স, কানের দুল রাখার ট্রে, গলার হার রাখার কেস, আংটি রাখার স্ট্যান্ড! দেয়া হয়নি তোমাকে। বোনরা কত চেয়েছে, ওদের আলাদা বানিয়ে দিয়েছি কিন্তু সেরাগুলো তোমার জন্য রাখা ছিল।

এত বছর পরেও আমার আলমারীতে ঠিক ঠিক ছিল সেগুলো। বাসায় ফিরে ভাবলাম, এইগুলো অনেকদিন আমার কাছে ছিল, এবার তোমার জিনিষ তোমার কাছে পাঠিয়ে দেই। তাই একটা বড়বাক্স বানালাম গত দুইদিন ধরে। তোমাকে অনেক সাজাবার শখ ছিল আমার, নানান রূপে, নানান রঙে, সেই সৌভাগ্য আমার হল না। অন্তত এই গয়নার বাক্সে তোমার সব গয়না রেখো, যেই গয়না তোমাকে অপরূপা করে, তোমাকে ছুঁয়ে থাকে তাদের না হয় আমার ভালবাসার এই মোড়কে রেখো। আমার খুব ভাল লাগবে।

এবার গেলে আমি হয়তো আর ফিরবো না। আজকে তোমার নুতন জীবনের প্রারম্ভে তোমাকে আমার হৃদয়ের সবটুকু শুভাশীষ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি। তুমি অনেক ভাল থেক, আনন্দে থেক। পৃথিবীর সব সুন্দর আর সব শুভ্রতা তোমাকে ঘিরে থাকুক। আমার খুব একটা প্রিয় কবিতা রইল তোমার জন্য উপহার। নাহ, তোমার জীবনে আমি কোন কালো মেঘ হয়ে আসব না, তোমার ন্যূনতম কষ্ট হোক, সেরকম কিছু করার ক্ষমতাই নেই আমার। ভালবাসার সঙগা কি, তার ব্যপ্তির মাপকাঠি কি আমি জানি না। শুধু জানি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে শুধু তোমাকেই চেয়েছি, তোমাকেই ভালবেসে যাব।

এই চিঠি পরে তুমি অনুশোচনা বা অনুকম্পা করো না। সহানুভূতি জানিও না। তোমাকে অপ্রস্তুত বা অপরাধী করা আমার অভিপ্রায় নয়। একদম নয়। আজ ভালবাসার কথা বলা অর্থহীন তাও আমি জানি, কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে জানাতে, তোমাকে একবার দেখতে। ভালবাসা এক ধরনের স্বীকৃতি চায়, তার নিজেকে প্রকাশের বড় লোভ; সেই বোধ থেকেই হয়তো এই কথাগুলো বলা। তুমি অন্যভাবে নিও না। কষ্ট পেও না। আমাকে অনুকম্পাও করো না। আমার এখনো কি অন্ধ বিশ্বাস তুমি ঠিক ঠিক বুঝবে আমার মনের এই ঝড়কে, বুঝবে আমার ভালবাসাকে, তাকে তুমি কোনদিন অপমান করবে না, হেয় করবে না। কি ঠিক বলিনি?

অনেক লিখলাম। অনাহূত এই আবেগ তোমাকে বিরক্ত করলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভালবাসি তোমাকে, পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম সেই ভালবাসার একটাই প্রার্থনা--শুভ হোক তোমার। সর্বাঙ্গীন কল্যান কামনায়,
তোমার,
সৌমিক

----
এই কবিতা তোমার জন্য--
অপরূপ বাগান
আবুল হাসান

চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক !

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন !
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি !

অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি !
ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ;
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান-

আর লোকে দেখে ভাববে- বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে !
১৬টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×