ভোর সাড়ে ৫টা, মোবাইল অ্যালার্মে ঘুম ভাঙলো।
উঠতে ইচ্ছে করেনা, তারপরও উঠলাম, ফজরের নামায আদায় করতে হবে। উঠে ওযু করে নামায পড়লাম। নামায শেষে দেখলাম আমাদের হাসান ভাই উঠে লেখাপড়া করছে। মানে বিসিএস পড়ছে। সে সকাল ৬টায় উঠে পড়ে আবার সকাল সাড়ে আটটায় আবার ঘুমায়। হাসান ভাইকে দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। আমিও তো বিসিএস পরীক্ষা দিবো। আমারও তো সরকারী একটা চাকুরীর দরকার। কিন্তু পরীক্ষার জন্য কোথায় পড়াশোনা করছি।
ডেডিকেশন এবং এডুকেশন ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব না। আমার ডেডিকেশন –এডুকেশন কিছুই নেই। তাই উন্নতিও নেই। মন খারাপ আর আফসোস করি, অবশেষে নিজের দোষ অপরের উপর চাপিয়ে, নিজেকে হালকা করার মিথ্যে চেষ্টা করি।
হালকা মন খারাপ নিয়ে আবার ঘুমাইতে গেলাম। সকাল আটটার দিকে আমাদের অফিসের ড্রাইভারের ফোন।
-“ভাইয়া আপনি কি রেডী?”
-“১০মিনিট লাগবে।”
উঠে গামছা লুঙি, সাবান-শ্যাম্পু, পেস্ট ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে গেলাম। সকালে টয়লেটে বসলে অনেকক্ষন সময় লাগে। কমকরে তো ১০-১৫মিনিট লাগে। টয়লেটে বসে চিন্তা করছি আজকে অফিসে কি কি করতে হবে।
কিছু কিছু মানুষের বুদ্ধি টয়লেটে বসলে বের হয়। আমার মাথা বুদ্ধি বের হচ্ছে, অন্যদিক দিয়ে বাথরুমের দরজায় একজন টোকা মারতেছে, -“ভাই তাড়াতাড়ি বের হন, ভাই হইলো? ভাই আর কতক্ষণ।” বুদ্ধির উৎপাদন বন্ধ করে গোসল করে হাসিমুখ করে বের হলাম।
আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে। সকালের নাস্তা আমার কোনদিন বাসায় করা হয় না। বুয়াও কর্পোরেট অফিসের মত নয়টায় আসে, একজনের জন্য রুটি বানিয়ে দিয়ে যায়।কিছু বললে কান্না শুরু করে।
তাড়াহুড়া করে বের হলাম। গাড়িতে উঠলাম।
রাস্তায় খুব জ্যাম। গ্রেট তুরাগ সিটি রাস্তার মুখে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নিচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার বলছে-“ভাইয়া এই শালারা তো সিটিং সার্ভিসের নামে চিটিং সার্ভিস শুরু করেছে।যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছে, পেছনের গাড়িগুলোকে আটকে দিচ্ছে। এই সামনের তুরাগের কারণে এতগুলো গাড়ি পেছনে আটকা পড়ে আছে।”
আমাদের ড্রাইভারের কথা খুব সত্য।
গাড়িতে বসে চারপাশে তাকাচ্ছি। স্কুলের পোশাক পড়িয়ে ছেলেমেয়েদেরকে তাদের অভিভাবক স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখলেই আমার স্কুলের কথা মনে পড়ে। খুব ইচ্ছে করে স্কুলে ফিরে যেতে। কত না সুখের দিন ছিলো সে সময়।
অফিসে পৌঁছালাম। টেবিলে বসলাম। শরীফকে ডাকলাম। হাতে ৫০টাকা দিয়ে সকালের নাস্তা আনতে বললাম।
স্কাইপিতে, কিউকিউতে লগইন করলাম। আউটলুক ওপেন করলাম। বিডিনিউজ২৪ ওপেন করে আজকের আপডেট জেনে নিলাম। অফিসে যদিও ৫-৬ পত্রিকা নেওয়া হয়, কোনদিন পড়া হয় না। অফিসের কাজ শুরু।
মাঝে মাঝে ভাবি অফিসে বসে পিসিতে পড়াশুনা করবো। কিন্তু করা হয় না।
বস না থাকলে, অফিসের কলিগদের সাথে আড্ডাবাজি চলে। ভালো লাগে।
অফিস জীবনটা দিন দিন বোরিং আর একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছে। কোথাও পালাতে পারলে বাঁচতাম। কিন্তু পালাবো কোথায়?
মাঝে মাঝে ভাবি স্বাধীনতা আসলে কি? সবাই স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে। মেয়েরা তাদের স্বাধীনতা চায়, কেউ মনের স্বাধীনতা চায়। রিক্সাওয়ালারা চায় রাস্তার স্বাধীনতা। পলিটিসিয়ানরাও চায় যা ইচ্ছে তা করার স্বাধীনতা। সবাই তার নিজ নিজ জায়গায় স্বাধীনতা চাচ্ছে। কিন্তু কেউ স্বাধীনতা লাভ করতে পারছে না।
হঠাৎ এক বন্ধুর ফোন। সে সামনে শুক্রবার মাওয়াঘাটে যাওয়ার কথা বলছে। আমি যাবো কি না জানতে চায়। সম্মতি দিলাম যে যাবো।
অফিসে খুব একটা কাজ নেই। ব্লগে ঢুকে ব্লগ পড়ছি। স্টুডেন্ট থাকাকালিন ব্লগে সময় দেওয়াটা কোন ব্যাপার ছিলো না। ব্লগে একদিন না ঢুকলে মন খারাপ হতো। বাপের টাকায় নেট কিনে ব্লগ পড়তাম। এখন অফিসের ফ্রি নেটেও ইচ্ছা করেনা। কারণ ব্লগ পড়ার জন্য সময় দরকার। সময় কোথায়। তারপরও ইদানিং কাজ না থাকার কারণে ব্লগে ঢুকি। অনেক নতুন ব্লগার এসেছেন। তাদের লেখাও অনেক সুন্দর। অনেক ব্লগারকে আর ব্লগে পাওয়া যায় না। তাদের লেখা খুব মিস করি। যদি কাউকে পাই তবে খুব ভালো লাগে, হুদায় বক বক করে তাদের বিরক্তি করি।
ব্লগ পড়াটা এমন একটা ব্যাপার, যদি ৪-৫দিন ব্লগে না ঢুকেন, তাহলে ব্লগে আসতে আর ভালো লাগেনা, আবার ৪-৫দিন টানা পড়লে, না ঢুকে থাকা যায় না।
পাশে আমার কলিগ অনলাইনে নিউজ দেখছে। কার সাথে কি হলো, কোন নায়িকা কি করলো এই সব পড়েতেছে।
-“ভাই দীপিকার তো হট মুভি বের হচ্ছে। ভাই ড্রাইভারের সাথে মালিকের বউ এর পরকীয়া।”
আমরাও মজা করে দেখি। লিংক থাকলে লিংকে গুতা মেরে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঢুকে পড়ি।
আর অন্যদিক থেকে মজিলা ফায়ারফক্সে আইসার্চ, ওমেগা এসে জমা হয়।
আমাদের কতিপয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুল নারীদের নগ্নভাবে উপস্থাপন করে। কোন নায়ক গাঁজা খাইলে কোন সমস্যা নাই, নায়িকা সিগারেট টানলেই হয়েছে, শেষ পর্যন্ত নায়িকার গোপন ভিডিওর সংবাদ প্রকাশ করে ছাড়ে।
অফিসে থেকে বের হওয়ার আগে, ঐশী মেয়েটার ফাঁসির খবর পড়লাম। কেউ ফাঁসির পক্ষে, আবার কেউ বিপক্ষে।
আমার অবস্থান বিপক্ষে।
কারণ তাকে সমাজ, আমাদের নিষ্ক্রিয়তা ঐ জঘন্য পথে নিয়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের দায়কে কিভাবে এড়িয়ে যাবো।
সে হয়তো পরিবার থেকে অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছিলো, পরিবার তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পারে নাই, কিন্তু মাদক তাকে ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করেতে পেরেছে।
আমরা সামাজিক মূল্যবোধ –ধর্মীয় মূল্যবোধকে মধ্যযুগে পাঠিয়ে দিতে চাইছি।
এই মূল্যবোধ কে ঘিরে উগ্রপন্থিদের জন্ম হচ্ছে। এই মূল্যবোধকে হাতিয়ার বানিয়ে সমাজে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান।
তাছাড়া আমরাও কেমন জানি খিটখিটে মেজাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মানবিক মূল্যবোধ গুলো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
অফিস থেকে বের হলাম। রিক্সাতে উঠলাম অফিস থেকে বাসার দূরত্ব ১৫ মিনিটের কিন্তু জ্যামের কারণে যেতে লাগে সময় দেড় ঘন্টা।
রাস্তায় জ্যামে রিক্সাতে বসে আছি।
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি। আমি যখন প্রাইভেট গাড়িতে বসে থাকি, তখন ধুমাইয়া রিক্সাওয়ালাদের গালি দিই।বলি ঢাকা শহর থেকে রিক্সা উঠিয়ে দেওয়া দরকার। আবার রিক্সাতে বসে থাকলে, ভাবি ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ি নিষিদ্ধ করা দরকার। হা হা হা………………………
এই দেশে প্রাইভেট গাড়ি কেনা খুব সহজ হয়ে গেছে। যে একটা কিনতে পারে, সে ৪-৫টাও কিনতে পারে। শহরের বেশির ভাগ প্রাইভেট গাড়ি গ্যাস চালিত, কারণ গ্যাসে খরচ কম। ভাবছি সরকার কেন প্রাইভেট গাড়ির জ্বালানীতে ভূর্তকী বন্ধ করে দেয় না। যারই একের অধিক গাড়ি থাকবে তাকেই ভূর্তকী ছাড়া জ্বালানী কিনতে হবে।
ওদের টাকা আছে বলেই তো ৪-৫টা গাড়ি কিনেছে। শুধু ইনকাম ট্যাক্স দেওয়ার সময় ব্যাংক লোন দেখায়, দেউলিয়াত্ব দেখায়, ব্যবসার লোস দেখায়, কোন ইমপ্লয়ীর বেতন ৩০হাজার টাকা হলে বেতন দেখায় ৮০হাজার টাকা।
১৫মিনিট ধরে এক সিগনালে আটকা পড়ে আছি। রিক্সাওয়ালা বললো-“মামা দেশে কোন সিস্টেম নাই।”
আমাদের দেশ নিয়ে এই রিক্সাওয়ালা খুব কথা বললো।
আপনি বাসে চলেন, কিংবা রিক্সায় অথবা পায়ে হেটে, আপনি একটা ব্যাপার নিশ্চিত বুঝতে পারবেন, এই দেশের রাজনৈতিক কোন নেতার উপর কারো কোন আস্থা নেই। কেমন একটা শোষণ আর পরাধীন জীবনের মধ্যে দিয়ে সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে সিগনাল ছাড়লো, আমার রিক্সাওয়ালা রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। নিষেধ করলাম না যাওয়ার জন্য সে আমার কথা কানেই তুললো না।পুরাই স্বাধীন। না এই দেশে রিক্সাওয়ালারা অনেক স্বাধীন। তবে তাদের অতিরিক্ত স্বাধীনতার খেসারত মাঝে মধ্যে ৫০০টাকার মাধ্যমে দিতে হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের রিক্সাওয়ালাদের এক এবং একমাত্র শত্রু ট্রাফিক পুলিশ। অনেক সময় দেখি রিক্সাওয়ালার স্বাস্থ্য ট্রাফিক পুলিশের স্বাস্থের চেয়ে ভাল হলে, মারামারি শুরু করে দেয়।
দেশের রিক্সাওয়ালা আর সিএনজি ওয়ালা একটা ভাবে চলে। তাদের মাসিক ইনকাম মাস্টার্স পাশ কিংবা ২ বছর অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের বেতনের চেয়ে বেশি।
এই দেশে রিক্সা সিএনজি চালিত গাড়ির সংখ্যা বেশি হলেও, তাদের ভাব আছে, তারা বেশি টাকা চাইতে পারে। কিন্তু এই দেশে মাস্টার্স –অনার্স পাশ করা ছেলে তার কর্মক্ষেত্রে বেশি টাকা চাইতে পারে না, চাওয়াটা পাপ কিংবা অপরাধ।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাসায় পৌঁছলাম। অনেক ক্ষুদা লেগেছে।কিন্তু বুয়া কিছু রান্না করতে আসে নাই। ঘরে কালাই আটা আছে। রুটি পাকানো শুরু করলাম। বেগুন ভর্তা করলাম।বাসায় প্রায় রাতেই আমি রান্না করি। কারণ সকাল-দুপুরে ঠিক মত খাওয়া হয় না। আর বুয়াও আসে রাত ৯টার পরে।
রাত ১২টার দিকে ঘুমাইতে গেলাম। রুমমেট চাদর জড়িয়ে, মাথা ঢেকে মোবাইলে প্রেমের গল্প শুরু করেছে। গভীর প্রেম। এমন সব শব্দ উচ্চারণ করে, এখানে এই মুহুর্তে কথা বলা একদম নিষেধ, তাদের গভীর প্রেম করতে দাও।
হঠাৎ কথা বলা বন্ধ। ভাবলাম কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। ১০মিনিট পরে হঠাৎ শুনি-
“হ্যা বলো শুনতেছি।”……………
৪-৫মিনিট চুপচাপ থাকার পর আবার শুনি, "হ্যা খাইছি। হুম বলো……………….."
এভাবে চলছে তাদের কথা।
অন্য রুম হাসান ভাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেলিম ভাই ইন্ডিয়ান ভিসা পূরণের কাজ রাত জেগে করে যাচ্ছেন। আরেক রুমের বাসিন্দা সানোয়ার ল্যাপটপে মুভি দেখছে।
আর আমি ভোর সাড়ে ৫টার অ্যালার্ম দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি।
ঘুম.........................
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৫৫