রান্নাঘর থেকে মা চিৎকার করতে থাকে
-নিতু, এই নিতু সেই কখন থেকে ফোন টা বেজে যাচ্ছে। একটু ধর না।
মা'র চিৎকারে বাস্তবে ফিরে আসে নিতু।
- যাচ্ছি মা
-হ্যালো
-হ্যালো, এইটা কামাল ভাই এর নাম্বার না?
-জী না।
-সরি আপু।
কেটে দিলো ফোন টা। নিতু সিওর একটু পর এই ব্যক্তি আবার ফোন দিবে। প্রথমে নাম জিজ্ঞেস করবে, তারপর ঠিকানা, তারপর গল্প করার চেষ্টা করবে। এদের যন্ত্রণায় আর পারা যায় না।
আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো । আজকের বিকেলটা অনেক বেশি সুন্দর। ঠিক যেমনটা ছিল আজ থেকে ৩ বছর আগে। সব কিছু আজও ঠিক ঠিক মনে আছে, সে দিনটির একটা মুহূর্তও সে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারে নি। সেটা ছিল আরিফের সাথেদেখা হওয়ার পর প্রথম নববর্ষ।
=========================================================
=========================================================
আরিফ কে সে দেখেছিল তার বান্ধবী মিলির বিয়েতে। ছেলেটার মাঝে এক তীব্র আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। অনুষ্ঠানের পুরোটা সে একাই জমিয়ে রেখেছিল। প্রচণ্ড প্রাণ চঞ্চল একটা ছেলে। প্রথম দেখায়ই ভাল লেগে গিয়েছিল নিতুর। জানিয়েছিল মিলিকে। তার মাধ্যমেই পরিচয়। তার মাধ্যমেই নাম্বার দেয়া নেয়া। সেই থেকে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলা। কিছু কিছু অনুভূতি শেয়ার করা। দিন যায় আর ফোনে কথা বলার সময় দীর্ঘায়িত হয়। নিতুও বুঝতে থাকে ধীরে ধীরে সে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে আরিফের প্রতি।
সেই বৈশাখ এর আগের দিন আরিফই বলে বসল কালকে ফ্রী থাকলে আর কোন প্রব্লেম না থাকলে তার সাথে ঘুরতে। আকস্মিক এরকম প্রস্তাবে নিতু কি বলবে বুঝতেছিল না যদিও তার মনে হল এরকম কিছু শোনার জন্য সে কতকাল ধরেই না অপেক্ষা করছে । সেদিন ফোন রাখার পর থেকে বাকি সময়টা কিভাবে কেটেছে নিতু জানে না। আরিফ এর সাথে ফোনে অনেক অনেক কথা হলেও তার সাথে কখনও ঘোরা হয় নি। কালই প্রথম । নিতু ঠিক করতে পারছিল না কিভাবে কি করবে। সাজগোজ জিনিসটা সে প্রায় করে না বললেই চলে। কিন্তু কাল সে কি করবে? আর এতটাসময় সে আরিফের পাশে থেকে কি বলবে? কিভাবে কাটবে সময়? ফোনে নির্দ্বিধায় অনেক সময় ধরে কথা বলা যায় কিন্তু সামনাসামনি সে কি পারবে নরমাল থাকবে?? সে কি পারবে বাকিসবার সাথে যেরকম থাকে সেরকম থাকতে পারবে আরিফের সামনে? তবে সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক তো হল এবার আরিফকে সে সরাসরিই বলবে। আর এতদিনে আরিফের তো পুরোপুরি বুঝে যাওয়ার কথা যে নিতু তাকে কতটা ভালবাসে।
=========================================================
=========================================================
পরদিন খুব সাধারন সাজগোজ করেই বের হয়ে যায়। তারপর???
সারাদিন যেন স্বপ্নের মত কাটে নিতুর। সারাদিন এখানে ওখানে অনেক ঘুরাঘুরি, দুপুরে বাইরে খাওয়াদাওয়া, বিকেলে মেলায় যাওয়া আর সর্বক্ষণ আরিফের সেই প্রাণচঞ্চল হাসি আর কথাবার্তা।
এর মাঝেই নিতু সারাদিন ধরেই ভেবেছে কখন বলবে তাকে কথাটা। কিন্তু একবার বলে উঠতে পারে নি। বিকেলের দিকে নিতু সিদ্ধান্ত নিল এবার সে অবশ্যই বলবে আরিফকে। যা হয় হবে।
-আরিফ শুন, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।
-ও। সারাদিনে তো আপনি মনে হয় একটা কথাও বলেন নি। এই প্রথম মুখ খুলবেন তাই না? এর জন্য অনুমতি নেয়া হচ্ছে।
বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে আরিফ। নিতুর কান্না পেয়ে যায়। আরিফ কি কখনই একটু সিরিয়াসলি কথা বলবে না তার সাথে??
-আরিফ প্লিজ হাসি থামাও। সিরিয়াস একটা কথা বলব।
-আচ্ছা বাবা সরি। আর হাসব না। বল কি বলবে
-ইয়ে ...... মানে ......... আসলে হচ্ছে কি............
-আরে বাবা কি???
-মানে আরিফ...... শুন যেটা বলব সেটা হচ্ছে......
-আরে কি বলবে??
নিতুর গলা ধরে এসেছে। একটা কথাও বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে
-মানে আরিফ আসলে...... আসলে...
-উফ তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কি হয়েছে সেটা তো বলবে
-আরিফ আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমাকে প্লিজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে আস।
এবার আরিফ আবার হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল।
-এই তোমার সিরিয়াস কথা? এটা বলতে তোমার এত মানে মানে করতে হল।
-হাসি থামাও। আমাকে প্লিজ বাসায় পৌঁছে দাও।
সেদিন আর একটা কথাও বলে নি নিতু। খুব কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিল। বাসায় ফিরে সারারাত অঝোরে কেদেছে সে। কেন সে বলতে পারল না আরিফকে? কেন পারল না নিজের অনুভুতিটুকু আরিফকে বুঝাতে? নিজের উপর প্রচণ্ড অভিমান হল। সেদিন সে বুঝতে পেরেছে তার পক্ষে নিজে থেকে কিছু বলা কখনই সম্ভব না। তাই সে অপেক্ষা করবে যতদিন না আরিফ নিজে থেকে এগিয়ে আসে।
=========================================================
=========================================================
পরদিন থেকে আবার আগের মতই দিন কাটতে থাকে আর নিতুও অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু অপেক্ষা যেন আর শেষ হয় না। সপ্তাহ পেরিয়ে মাস যায়, মাস পেরিয়ে বছর কিন্তু আরিফ যেন কিছুই বুঝে না। মাঝে মাঝে নিতুর খুব রাগ হয়। আরিফ কি সত্যিই কিছু বোঝেনা নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে? সারাক্ষন অপেক্ষা আর অপেক্ষা।
তারপর হটাত একদিন আরিফ জানালো ভার্সিটির একজনকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। । আর মেয়েরও আরিফকে পছন্দ হয়েছে অনেক। এই মেয়েটাকেই সে তার জীবন সঙ্গীনি বানাতে চায়। মুহূর্তেই সমগ্র পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে উঠে নিতুর। তার সামনে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে স্লো মোশনে । এতদিনের স্বপ্ন, এত ভালবাসা সবকিছু যেন নিজের কাছে মিথ্যে মনে হয়। সে কি বলবে সেটাও খুজে পায় না। শুধু একবার উইশ করে ফোনটা রেখে দেয়। আরিফের প্রতি সমস্ত ভালবাসা, নিজের প্রতি প্রচণ্ড অভিমান, একটু একটু করে দেখা স্বপ্ন সব সেদিন কান্না হয়ে ঝরে নিতুর চোখ থেকে।
=========================================================
=========================================================
ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে ভালবাসতে পারার এক অসীম ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন কিন্তু সবাইকে সেই ভালবাসা প্রকাশ করার ক্ষমতা দেন নি। যাদের দিয়েছেন তারা সরাসরিই বলে দেয় ভালোলাগার কথা, ভালবাসার কথা, যারা পারে না তাদের কেউ কেউ আকারে ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যারা কিছুই করতে পারে না তারা সমস্ত ভালবাসা জমিয়ে রাখে বুকের ভিতরে। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই জমিয়ে রাখা ভালবাসা একসময় হারিয়ে যায় জীবন থেকে। ভালবাসতে সাহস লাগে না, সাহস লাগে ভালবাসার কথা প্রকাশ করতে। সেটা যদি না থাকে তবে সেই ভালবাসা চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যায়, সবার চোখের আড়ালে অশ্রু হয়ে ঝরতে থাকে সারাজীবন