somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





বেয়ার গ্রাইলস, ব্রিটিশ অভিযাত্রী এবং টিভি ব্যাক্তিত্ব। ম্যান ভার্সাস ওয়াইল্ড টিভি শোর কল্যানে দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি তার। সারা দুনিয়ার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের কাছে স্বপ্নের নায়ক। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ২২ বছর বয়সে তার জীবন প্রদীপ থমকে যেতে পারত। সে বছর আর্মিতে থাকাকালীন সময়ে জাম্বিয়ার মরু অঞ্চলে এক অনুশীলনে ষোল হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্যারাশুট নিয়ে ঝাঁপ দেন এবং প্যারাশুট ঠিক মত না খোলার কারনে মুক্তভাবে মরুভূমিতে আছড়ে পড়ে মেরুদন্ডের তিনটি কশেরুকা ভেঙ্গে ফেলেন। তার চিকিৎসা করা ডাক্তাররাও ভাবেননি গ্রাইলস কোনদিন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন আর রোমাঞ্চের সন্ধানে সারা দুনিয়া চষে বেড়ান তো দুরের কথা । কিন্তু প্রতিকুলতাকে জয় করার অদম্য মনোবলে গ্রাইলস সেই দুর্ঘটনার মাত্র দেড় বছরের মাথায় জয় করেন তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন এভারেষ্ট, হয়ে উঠেন আজকের অ্যাডভেঞ্চার আইকন বেয়ার গ্রাইলস। এই কাহিনী তার সেই এভারেষ্ট জয়ের কাহিনী।
(তার লিখিত বেষ্ট সেলার ‘Facing up’ বইয়ের ধারাবাহিক অনুবাদ)


অধ্যায় একঃ মরু প্রান্তরে মরন ঝাপ

পশ্চিম আকাশ বিবর্ন হতে শুরু করেছে। আফ্রিকান গনগনে সূর্যের তেজ স্তিমিত করে জায়গা করে নিচ্ছে গোধুলির নরম আভা। আমরা গাদাগাদি করে ছোট্ট বিমানটিতে আসন গ্রহন করলাম এবং বসার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরা শুরু হল। আমি পা টানটান করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। পিঠে বাঁধা প্যারাশুটের ব্যাগ পিঠের দিকে আরামদায়ক কুশন তৈরী করেছে। ইচ্ছে হচ্ছে শরীরের পুরো ভার ব্যাগটির উপর চাপিয়ে দিয়ে একটু আরাম করি কিন্তু কিছুটা সংশয় নিয়েই এতে হেলান দিচ্ছি পাছে ভিতরের যান্ত্রিক ব্যাবস্থা নষ্ট করে ফেলি অথবা দুর্ঘটনাবশত প্যারাশুটখানিই খুলে ফেলি।

বরাবরের মত যা হয়, ষোল হাজার ফুট উচ্চতায় পৌছানো পর্যন্ত ছোট্ট প্লেনের ভিতরে কারো সাথে কারো চোখাচোখি হচ্ছেনা, একটু নিমগ্ন আর শুধু পাশের জনের সাথে নিচু স্বরে অল্পস্বল্প বাক্যালাপ হচ্ছে; উড়ুক্কু যানের ভিতরের পরিবেশ আসন্ন রোমাঞ্চের নিরব উত্তেজনায় কেমন টানটান হয়ে আছে। উড়োজাহাজটি শেষ বারের মত আরেকবার যখন উঁচুতে উঠার জন্য কাত হল সামনের ছোট্ট জানালা দিয়ে আমি অনেক নিচের বিস্তৃত আফ্রিকান বেসিনের দিকে এক পলক তাকালাম; এত উপর থেকে দিগন্ত রেখার কাছে পৃথিবীর বক্রতাকে পরিষ্কার বোঝা যায়। নিজের মধ্যে কেমন একটি উষ্ণ প্রশান্তি অনুভব করলাম।

প্লেনের ছোট্ট প্রকোষ্ঠে প্রায় উবু হয়ে অনেকক্ষন বসে থেকে শরীর যখন আড়ষ্ঠ এবং কিছুটা নার্ভাস ও বটে, তখনি মাজিকের মত একটি ব্যাপার ঘটলো যেমনটি সাধারণত হয়ে থাকে চরম উত্তেজনাকর কোন পরিস্থিতিতে- ঝুপ করে চারিদিক শান্ত নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল।

প্লেন ততক্ষনে তার প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌছে আনুভূমিক অবস্থান নিতে শুরু করেছে। সবাই আড়মোড়া ভেঙ্গে জড়তা ছাড়ানো শুরু করলাম আর শরীরের সঙ্গে বাঁধা জাম্প ইকুইপমেন্টসমূহ যতটা সম্ভব পরীক্ষা করে নিচ্ছিলাম। জীবন মৃত্যুর ব্যাপার বলে কথা। তারপর একজনের পিছন একজন ঝুকে অবস্থান নিলাম সবাই; কেউ একজন প্লেনের দরজার দিকে অগ্রসর হল। শক্তিশালী ধাক্কায় দরজাটি এক পাশে ছিটকে সরে গেল। সাথে সাথে ইঞ্জিনের প্রবল গর্জন আর ঘন্টায় সত্তর মাইল বেগে বয়ে চলা প্রতিকূল বাতাস ভিতরের শান্ত নিস্তরঙ্গ পরিবেশ দখল করে নিল। লাল লাইট জ্বলে উঠলে সবাই যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লাম। আলো বদলে কিছুক্ষনের মধ্যে সবুজ ঝলকানি উঠলো। ঝাঁপ দেয়ার সংকেত। অ্যান্ডি এগিয়ে গেল, অনেক নিচের অবারিত বিস্তারের দিকে একবার তাকিয়ে হারিয়ে গেল সামনের বিস্তৃত শুন্যে। কিছুক্ষনের মধ্যে বাকি সবাই এঁকে এঁকে তাকে অনুসরণ করল। প্লেনের কার্গো এলাকায় এখন শুধু আমি একা। বুক ভরা চেনা পরিচিত গভীর নিঃশ্বাস, পরক্ষনেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম শুন্যে, বাতাস খেলছে আমাকে নিয়ে, জোর ধাক্কায় ধনুকের মত বেঁকে আছি। চোখের সামনে দিগন্ত ওলট পালট হচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে, এই অনুভুতিকে এক কথায় বলা যায় ‘মধ্যাকর্ষের কাছে নিজের স্বাধীনতা সঁপে দেয়া’।‘

ভুমির দিকে মুক্তভাবে পতনরত সঙ্গীদেরকে বিস্তৃত শুন্যে ছোট কালো বিন্দুর মত দেখাচ্ছে। কিছুক্ষন পর সবাই হারিয়ে গেল মেঘের ভিতর। ক্রমশঃ এক ঝাঁক মেঘ গ্রাস করে নিল আমাকেও। শীতল পরশের সাথে সাথে মুখের খোলা অংশটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেল। অল্পক্ষনের ভিতর এই মেঘের ঝাঁক থেকে বের হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হলনা, মেঘ চারপাশ থেকে আষ্টৃপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। চারিদিকে পাক খেতে থাকা সাদা মেঘের মধ্যে আমি ও পাক খেতে থাকলাম। অল্টিমিটারের দিকে তাকিয়ে উচ্চতা ঠাহর করার চেষ্টা করলাম কিন্তু হোয়াইটআউটের জন্য কিছুই বুঝতে পারলামনা।

প্যারাশুট খোলার সময় হয়ে এসেছে বলে মনে হল, হঠাৎ করেই কেন যেন বড় একা মনে হল নিজেকে।
ডান উরুর দিকে হাত বাড়িয়ে প্যারাশুটের রিপকর্ড খুজে নিলাম। সজোরে টান দিতেই প্যারাশুট খোলার স্বস্তিময় এবং প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া অনুভব করলাম। মাথার উপর প্যারাশুটটি ঘন্টায় একশত বিশ কিলোমিটার বেগে পতনের গতিকে সশব্দে বাঁধাগ্রস্ত করে বড় আচ্ছাদন তৈরী করল, আর ক্রমে গতিবেগ কমে ঘন্টায় পনর মাইলে এসে দাঁড়ালো। সব সময় যা করি, মাথা কাত করে উপরে দেখার চেষ্টা করলাম প্যারাশুট যথাযথভাবে ছড়িয়েছে কিনা কিংবা সবগুলো প্রকোষ্ঠ ফুলে উঠেছে কিনা। ভয়ের একটা শীতল স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। প্যারাশুটটি ঠিকভাবে খুলেনি।

উপরের দিকে দু তিন সেকেন্ড তাকিয়ে বুঝে গেলাম ঠিক কি ঘটেছে। প্যারাশুটের নয়টি অংশ সুষম আচ্ছাদন তৈরী করার বদলে কেমন যেন হযবরল হয়ে মাথার উপর ফুলে আছে। খোলার সময় বাতাসের প্রবল ধাক্কায় প্যারাশুটের আচ্ছাদনের উপর দিক ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে আছে। ছেঁড়া দুই অংশ পতপত শব্দে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। দু’পাশের ষ্টিয়ারিং কর্ড সজোরে টেনে ধরলাম যদি এতে কোন কাজ হয় এই আশায়। কিন্তু কিছুই হলনা।

ষ্টিয়ারিং কর্ড ধরে আবারো দিক বদলের চেষ্টা করলাম কিন্তু প্যারাশুট খুব আস্তে সাড়া দিলো আর এমন সজোরে শব্দ হচ্ছিলো যেন তার ফুলে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে ধূধূ মরুর বুক দ্রুত কাছে চলে আসছে, ছোট বড় সব বস্তু স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পতনের গতি এখনো দ্রুত, অনেক দ্রুত। আমি উন্মত্ত হয়ে বাতাসের গতিপথ বোঝার চেষ্টা করলাম; বুঝে গেলাম রিজার্ভ প্যারাশুট ব্যাবহার করার জন্য উচ্চতা এখন অনেক কম- উপায় নেই, এভাবেই ল্যান্ড করতে হবে। ভুমির আরো কাছাকাছি চলে আসলাম এবং নিরাপদ গতির চেয়ে অনেক বেশী গতিতে। আতংকিত হয়ে বেশ উপরে থাকতেই সজোরে প্যারাশুটের ফ্লেয়ার খুলে দিলাম। ঝাঁকুনিতে আমার শরীর ভুমির সমান্তরাল হয়ে পড়ল, আমি প্যারাশুট থেকে খসে পড়লাম আর সজোরে মরুর বকে আছড়ে পড়লাম।

সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, আমি চকিতে বিছানার উপর উঠে সোজা হয়ে বসে পড়লাম। শরীর ঘেমে একাকার আর ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। এ নিয়ে পর পর তিনবার সেদিনের সেই দুর্ঘটনার ঠিক পুর্ব মুহুর্তের স্মৃতি স্বপ্নে হানা দিল। যতই আমি মন থেকে সেই দুর্বিসহ স্মৃতি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি ততই যেন তা বুকের উপর চেপে বসে। এই দুর্ঘটনায় আমার দুটি কশেরুকা পুরোপুরি ভেঙ্গে যায় আর তৃতীয়টিতে গুরুতর চিড় ধরে। যে স্কটিশ ডাক্তার আমাকে প্রথম পরীক্ষা করেন তিনি বলেছেন স্পাইনাল কর্ড পুরোপুরি ছিঁড়ে গিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার মাঝে এক সূতার ব্যাবধান ছিল।

রাতের বেলা পিঠে প্রচন্ড ব্যাথা হয়, ডাক্তাররা অবশ্য আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে, কিন্তু তারপরও ব্যাথায় শরীর কুঁচকে যায় প্রত্যেকবার। দুর্ঘটনার প্রথম কয়েকমাস বিছানায় শুয়েই কেটেছে, সেরে উঠছি ধীরে ধীরে। বন্ধুরা দেখতে আসত। তাদের অভিবাদন জানাতে গিয়ে সামান্য নড়াচড়ার জন্য ও আমাকে বেশ সংগ্রাম করতে হত। পিঠের বন্ধনী পরে ফিতে লাগিয়ে কি চেষ্টাই না করতে হত একটু ভঙ্গি বদলানোর জন্য। এভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা আমার স্বাভাব সুলভ ধর্ম নয়। নিজেকে নিয়ে বেশ বিব্রত ছিলাম। ভিতরের একটা অংশ চাইতনা বন্ধুরা আসুক আর আমাকে এই অবস্থায় দেখুক। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টায় একবার তো এক বন্ধুর সাথে রাগবি বল লোফালুফি করেছিলাম যতক্ষন না পর্যন্ত ছুরির মত তীক্ষ ব্যাথা আচ্ছন্ন করে দেয়। পরে মা বাবা এসে ক্ষান্ত করে আমাকে।

আমার পিতা মাতাকে দুর্ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই আফ্রিকার স্থানীয় এক হাসপাতালে এক সপ্তাহ কাটানোর পর আমি প্রথম মা’র সাথে কথা বলি, ফোনে। মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে মা’কে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। এত দূর থেকেও তাঁর বেদনায় ন্যুজ হয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর বুঝতে পারছিলাম। মা’র এত কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ানোর জন্য নিজের উপর বেশ ঘৃনা হল। এর পর যখন আমি ইংল্যান্ডে ফেরত আসি তখন থেকে আজ পর্যন্ত মা আমার সেবা শশ্রুষায় নিজেকে নিবিড়ভাবে নিয়োজিত রেখেছেন, ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আমাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল, ডাক্তার থেকে ডাক্তার ছুটে বেড়াচ্ছেন। মা’র ধারনা তিনি আমাকে হারিয়েছেন।

এক নাগাড়ে তিনমাস আমি বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলাম। আমার সকল পরিকল্পনা, ভবিষ্যত নিয়ে আমার সকল স্বপ্ন ভেঙ্গেচূরে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল এক দুর্ঘটনায়। সব কিছুই কেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়লো, সেনাবাহিনীর চাকরিটি আমার থাকবে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত ছিলামনা। এমনকি নিশ্চিত ছিলামনা জীবনে আর কোনদিন সুস্থ হয়ে উঠতে পারব কিনা। মনে হচ্ছিল এক লহমায় আমার চির চেনা পৃথিবী উলটে গেল। মনের ভিতরে এই ভয় স্থায়ী হয়ে গেল যে মেরুদন্ডের এই তীব্র ব্যাথা, হাড়ের সাথে স্নায়ুর অরুচিকর ঘর্ষন হয়তোবা শরীরে চিরতরে বাসা বেঁধে নিয়েছে। আর আমি তা একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না। ভয় পাচ্ছিলাম আমি যা যা করতে পছন্দ করি সেসবের কিছুই করার মত সুস্থতা হয়তো আমি আর কখনই অর্জন করতে পারবনা- পাহাড়ে চড়তে, সাগরে পাল তুলতে, বাড়িতে গিয়ে আমাদের গাঁয়ের ওপারে প্রিয় গাছটির ডালে বসে শুধু ভাবতে। এই সবকিছু করার মত সুস্থ হয়ে উঠবো কি উঠবোনা এই ভাবনাই আমাকে সবচে বেশী উদ্বিগ্ন করে তুললো। কারো কাছেই কোন উত্তর নেই- এমন কি ডাক্তাররাও কিছু বলতে পারছেনা।

আমার বয়স যখন আট, সেই সময় বাবা আমাকে মাউন্ট এভারেষ্টের রোমাঞ্চকর এক ছবি উপহার দেন। সেই মুহুর্ত থেকে মাউন্ট এভারেষ্ট আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছে। বসে বসে আমি তন্ময় হয়ে ছবিটি দেখতাম, চূড়ার সামনে বরফের প্রান্তরের বিস্তার অনুভুব করার চেষ্টা করতাম, আর ভেবে আকুল হতাম কতটা খাড়া এর চূড়া। মাঝে মাঝে আমার মন কল্পনার রাজ্যে ছুটে বেড়াত, নিজেকে আবিষ্কার করতাম এভারেষ্টের ঢালে, ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপটা দিচ্ছে আমার উন্মুক্ত গালে। বলা যায় সেই সময় থেকেই আমার ভিতর এক স্বপ্ন জন্ম নেয়। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।

শৈশবে স্কুলের ক্লান্তিকর দিনগুলোর কথা ভুলে থাকতাম বাড়িতে আসন্ন ছুটি কাটানোর কথা ভেবে; বাবার সাথে উইট উপদ্বীপে লাইমষ্টোন পাহাড়ে চড়ার লোভনীয় ভাবনায় আকুল হয়ে থেকে। আমার মাপের চেয়ে কয়েক সাইজ বড় বাবার পুরোন হাইকিং বুট জোড়া পায়ে গলিয়ে গাড়ির পিছনে মালসামান ভর্তি করে আমি আর বাবা আমরা দু’জন ছুট লাগাতাম পাহাড়ে। সাথে নিতাম আমাদের কুকুর দুটোকেও। একটি শিটল্যান্ড শিপডগ আরেকটি জার্মান জাতের ডাক্সহুন্ড। শিটল্যান্ড কুকুরটি পাহাড়ের ঢালে ছুটে বেড়াতে খুব আমোদ পেত কিন্তু ডাক্সহুন্ড রুকস্যাকের ভিতরে বসে বাবার পিঠে চড়ে যেতেই পছন্দ করত আর ব্যাগের আধখোলা মুখ দিয়ে ছোট্ট মাথা বের করে অবাক দৃষ্টিতে চারপাশ অবলোকন করত। এভাবেই কেটে যেত আমার অগুনিত স্বপ্নিল অপরাহ্ন।

ছোটবেলার রোমাঞ্চকর অভিযানের জন্য শীতকালই ছিল আমার প্রিয়; ঠান্ডা বাতাস খোলা মুখে কামড় বসাতো যখন আমি আর বাবা মাঠ প্রান্তর চষে বেড়াতাম। পাহাড়ের ঢাল বেঁয়ে উঠার সময় আমার প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকত বাবার কাছাকাছি থাকার। দূর থেকে চুড়াগুলোকে কেমন যেন ভৌতিক আর অতিপ্রাকৃত মনে হত। আমার মা প্রতিবারই বাবাকে কড়া শাসন করত আমাকে সঙ্গে না নিতে। কিন্তু মা’র নিষেধ নিষিদ্ধ বস্তু আস্বাদনের আনন্দের মত আমার পাহাড় চড়ার রোমাঞ্চকে আরো বাড়িয়ে দিত।

বাবা বলতেন, “তুমি কখনই কোন কিছুর উচ্চতা অনুধাবন করতে পারবেনা যতক্ষন না পর্যন্ত নিজের নাক ঘষে তা অতিক্রমের চেষ্টা করছ।“ তিনি ঠিকই বলেছেন। একথা জীবনের সব ক্ষেত্রেই খাটে। কাছ থেকে চূড়া গুলোকে মনে হয় কয়েক কদম দুরত্বের কিন্তু বাস্তবে আসলে পুরোপুরি ভিন্ন। পর্বতগাত্রে দীর্ঘদিন ভেড়ার পালের চলাচলে ঢাল বরাবর আড়াআড়ি পথের সৃষ্টি হয়েছে, আর তাই প্রতি দশ ফুট আরোহনের পরই আমরা পথের ধাপে বসে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেতাম। চুড়োর কাছে পৌছলে আমরা গোগ্রাসে খেয়ে নিতাম আর উপর থেকে দ্বীপের চারপাশ অবলোকন করতাম। বড়ই মনোরম ছিল সে দৃশ্য। এক সময় আমরা চুড়ায় পৌছতাম আর পৌছেই সটান সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে দেখা মিলত কয়েক জোড়া বুড়োবুড়ির, সহজ পথে চূড়ার সবুজ প্রান্তরে হাটতে এসেছে, তারা অবাক বিস্ময়ে আমাদের পাগলামি দেখত আর টলোমলো পায়ে চলে যেতে যেতে হাত নাড়ত যেন আমাদের এই পাগলামি অনুমোদন করছেনা। এতে আমার আনন্দ আরো বেড়ে যেত।

বাবার সাথে পাহাড়ে প্রান্তরে কাটানো এই দিনগুলোতে বাবা আমাকে তাঁর রয়াল মেরিনে থাকার সময়কার পর্বতারোহনের কাহিনী শুনাতেন; আমাকে শেখাতেন যা যা তিনি জানতেন তাঁর সবই। বুনো প্রান্তরে প্রত্যেক মুহুর্তে তিনটি নির্দেশককে চিহ্নিত করে অগ্রসর হবে। পাহাড়ে তাড়াহুড়ো করবেনা, আর সব সময় এবং সব সময় শান্ত থাকবে- যতই ভীত থাকনা কেন। আমাকে সবসময় বলতেন।
এখন যখন এই চুড়াগুলোকে দেখি পুরোন সব স্মৃতি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি আনমনে হাসি। চুড়াগুলোকে অনেক ছোট মনে হয়, আর মোটেও বিপদজনক মনে হয়না। অথচ সেই আট বছর বয়সে মনে করতাম আমি বোধহয় পৃথিবীর সবচে উঁচু পর্বত পাড়ি দিচ্ছি। যখন স্কুলে ফিরে যেতাম নিজেকে অন্যদের চেয়ে কেমন আলাদা মনে হত, যেন বিরাট এক অভিযাত্রী।

আর এখন আমি সারাদিন বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ, বিছানায় পড়ে আছি, চলাফেরায় অক্ষম, হতাশায় ভারাক্রান্ত। কেবল মনের মাঝেই রয়েছে একটু মুক্তির পথ। সে সব দিনের কথা ভেবে মাঝে মাঝে মুখে একটু হাসি আনতে পারি। আহ্! কত কি করার এখনো বাকি, আরো কত কি দেখার বাকি রয়ে গেছে। অধরা স্বপ্নগুলো আমাকে অবিরত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নিজের স্বাস্থের প্রতি সুস্থতার প্রতি এতটাই আস্থা ছিল যে আজ যখন তা হারিয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি, আমার সব স্বপ্ন যেন হামলে পড়েছে আমার ভাবনায়। সময় আজ থমকে দাঁড়িয়েছে আমার জীবনে।

আমি শোবার ঘরের চারপাশে চোখ বুলালাম, এভারেষ্টের চূড়ার সেই পুরোন ছবিটি যেন আমাকে উঁকি দিয়ে দেখছে। বুঝতে পারছিনা সেকি আমাকে করুনার চোখে দেখছে নাকি আমার অসহায় অবস্থা দেখে বিদ্রুপ করছে। অনেক কসরত করে আমি এটিকে নামিয়ে রাখলাম। এই ছবিকে আমার অক্ষম চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখার আর কোন দরকার নেই।

এভারেষ্ট জয় করার শৈশবের সেই আজন্ম লালিত স্বপ্নকে মনে এখন মনে হচ্ছে কোন সুদূরের এক অলীক অসম্ভব ভাবনা। মাসের পর মাস শুয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবলাম বাবার সাথে পাহাড়ে আরোহনের সেই দিনগুলোর ভালোলাগার কথা, পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ার উপর থেকে পৃথিবী দেখার গোপন অব্যাক্ত ইচ্ছার কথা। ভাবি আর অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করি এই ভেবে যে এসব শুধুই অলীক কল্পনা- বাচ্চাদের জিনিষ। বুকে চেপে থাকা কষ্টকে কিছুটা হালকা মনে হয়।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৫৮
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×