somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা এবং গর্ভবতী গাভী

৩১ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা একটা গাভী পালছে।


গাভীটা গর্ভবতী।


গর্ভবতী গাভীকে নিয়ে বাসায় উৎসব উৎসব ভাব। এই উৎসব বিয়ে বাড়ীকেও হাঁর মানিয়েছে। সবাই হাসাহাসি-নাচানাচি করছে।

সবচাইতে বেশী নাচা-নাচি করছে আমার মা। গর্ভবতী গাভীর বিষয়টা তার বয়স অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তাকে এখন পনের বছরের তরুনীর মতো লাগছে।


ঘোমটা মাথায় মা সারা বাড়ী চষে বেড়াচ্ছেন।


লোকজন ভাবছে ছেলের বিয়ে হবে তাই মনে হয় এতো খুশী। সবাই আমাদের বাসায় আসছে। হাসিমুখে পান-সুপারী খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফিরে যাচ্ছে।


গ্রামে বিয়ের বাড়ীতে সবাইকে পান খাওয়ানো হয়। সুসংবাদের মিস্টির বদলে পান। কেউ মন খারাপ করে না। ছেলে পাশ করেছে। লোকেরা বলবে,


‘পান খাওয়াবেন না?’


লোকেরা হাসিমুখে পান গিলবে। গরু-ছাগল যেমন ঘাস-পাতা কচকচ করে চিবায়, উৎসবের বাড়ীতে সবাই পান খায় সেভাবে।


একমাত্র আমি আর বাবা পান সুপারীর বাইরে। বাবা তো খুব খুশী। খুশীর কারন মা মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। বাবা বারবার আমাকে বলছেন,


‘ভালো করে দেখতো, তোর মাকে নতুন বউ নতুন বউ লাগছে না?’


আমি বাবার দিকে তাকালাম। তিনি লজ্জা পেয়ে গেলেন। তাকে দেখলাম ভ্রু কুঁচকে বারবার মার দিকে তাকাচ্ছেন।


একদিন গর্ভবতী গাভী বাচ্চা দিল। বাচ্চা দেখে মায়ের আক্কেল গুড়ুম। তিনি কাঁপতে লাগলেন। চোঁখ ফেটে তার জল বের হতে লাগল। কাউকে কিছু না বলে দরজা দিয়ে ফেললেন।


অনেক কষ্টে কান্নার কারন জানা গেল।


বাছুর দেখতে ভয়াবহ সুন্দর। সমস্যা তার গায়ের রংয়ে। পুরো শরীর লাল হয়েছে। কিন্তু লেজের নিচের অর্ধেক সাদা।

লাল গরুর বাজার মুল্য অনেক বেশী। লেজ সাদা হওয়ায় নাকি কয়েক হাজার টাকা মুল্য কমে গেল।


ঘটনা আকস্মিক ভাবে ঘটেছে। যারাই মাকে দেখছে, তারাই অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।


শোক আর সুখের মধ্যে একটা মিল আছে। দুইটায় আশে পাশের মানুষের মধ্যে ছড়ায়। সুখটা সবার মাঝে না ছড়ালেও শোকটা কেমন কেমন করে যেন ছড়িয়ে পড়ে। মেয়ে জাতির মধ্যে এই বিষয়টা প্রবল।


মায়ের শোক দেখে বাসার সবাই চুপ মেরে গেল। সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আমরন অনশন হবে। অনশন হবে দানাপানি ছাড়া। একটি বিশেষ দিন দেখে সবাই এক সাথে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল।


মায়ের আমরন অনশনের একটা কারন ছিল। তিনি গাভীটাকে লালন করেছিলেন অন্য উদ্দ্যেশে। বাছুর বিক্রির টাকায় আমাদের ছোট বোনের বিয়ে দিবেন।


এই ছোট বোন আমার মামার মেয়ে। মামার মৃত্যুর পর মা তাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন। উদ্দেশ্য, বড় হলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিবেন। বাছুর বিক্রি টাকায় হবে এই বিয়ে।


অসম্ভব সুন্দরী এই বোনটিকে বিয়ে দেবার জন্য বাছুর বা গাভী বিক্রি করতে হয় নি। একজন স্ব-হৃদয়বান সুদর্শন ছেলে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। এখন আর তার টাকার অভাব নেই।


বোনটির বাসায় গেলে আমি তার হাসি-মুখ দেখতে পাই। আমার জড়িয়ে ধরে কান্না-কাটি শুরু করে। কানেকানে ফিসফিস করে বলে,


‘ভাইজান, চল না আরেকটা গাভী পুষি। সবাই মিলে আরেকবার অনশন করব। বাছুরের টাকা দিয়ে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’


আমি কিছু বলি না। বোনের সু-দর্শন স্বামীটির দিকে তাকিয়ে থাকি।


তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। বোনটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টিতে বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আমি। তারও কি আজকে আমার বাবার মতো অনুভুতি হচ্ছে?


হতেও পারে। তার স্ত্রীকে তার কাছে নতুন বউ নতুন বউ লাগছে।


একবার আমাকে দুইদিন না খেয়ে থাকতে হলো।


পকেটে টাকা নেই। বাসা থেকে কখনো টাকা আসত না।


টাকা আমি নিজেই নিতাম না। তিনবেলা সংসারের খাবার জোটাতে বাবার খুব কষ্ট হতো। মেডিকেল স্টূডেন্ট হয়ে তারকাছে টাকা নিতে আমার লজ্জা লাগছিল। লজ্জার কারন টিউশনী। আমাদের নাকি টিউশনিতে শহরে প্রচুর চাহিদা।


আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হলো। একটা টিউশনীও পেলাম না। প্রচন্ড টাকার অভাব শুরু হলো।


শীতে আমার ঠোঁট কখনোই ফাটত না।


অভাবের শীতে এসে ভয়াবহ ভাবে ঠোঁট ফাঁটতে লাগল। টাকার অভাবে শীতে একটা লিপজেল কেনার সামর্থ্যও নেই।

লজ্জায় কারো কাছে টাকা চাইতে পারি না।


রুমমেট বাইরে গেলে তার টেবিলে যাই। খুজে দেখি লিপজেল আছে কি না। রুমমেটের টেবিলে লিপজেল থাকত না। পকেটে নিয়ে ঘুরত।


আমি খুজে খুজে একটা বিকল্প উপায় বের করলাম।


রুমমেটের সরিষার তেলের বোতল থেকে তেল বের করে ঠোটে মাখতাম। তেল মাখার সময় চোখ দিয়ে জল ঝরত।


আহারে! এতো কষ্ট আমার!


জল ঝরার সাথে সাথে অদ্ভুত ভাবে মাথা ব্যাথাও করত।

বলা বাহুল্য, মাথা ব্যাথার ঔষুধ কেনার সামর্থ আমার ছিল না।


ঠোঁটে সরিষার তেল মেখে কোন লাভ হলো না।


ঠোৎ ফেটে মারাত্মক আকার ধারন করল। ঠোটের রং কালো হয়ে গেল। লজ্জায় আর আমি রুম থেকে বাইরে বের হতে পারিনা। ঠোটে রুমাল বেঁধে সারাদিন কচ্ছপের মতো রুমে পড়ে রইলাম।


একবার দুই মাসের মিলের টাকা বাকী পড়ায় আমার মিল বন্ধ হয়ে গেল।


দুইদিন না খেয়ে আছি। পেটের ক্ষুধা মারাত্মক আকার ধারন করল। কচ্ছপের মতো পেট কামড়ে রুমে পড়ে থাকলাম।

কষ্ট পেয়ে পেয়ে সহ্যের সীমা ছেড়ে গেল।


রাগের মাথায় মাকে একটা চিঠি লিখলাম। জীবনের সমস্ত দুঃখ-বেদনা একসাথে করে চিঠিটা লিখলাম। কলমের ডগা দিয়ে কালি বের হলো না। কষ্ট, কষ্ট আর চোখের জলে খাতা ভরে গেল। চোখের জলে লেখা চিঠিটা অস্বাভাবিক শক্তিশালী হয়ে গেল।


অস্বাভাবিক শক্তিশালীচিঠিটা ডাকবক্সে পোস্ট করলাম।


চিঠি পেয়ে মা রংপুরে চলে আসল। একা আসেননি, সদলবলে এসেছেন। বাড়ীর সমস্ত বাচ্চা-কাচ্চা বুড়ো-বুড়ী। আমাকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে বাচ্চা মেয়েদের মতো কান্নাকাটি শুরু করলেন।পাবলিক প্লেসে সবাই মুখ-চাওয়া-চাউয়ি শুরু করল।


আমি অবাক হয়ে গেলাম আমার চিঠির ক্ষমতা দেখে।


আমি পণ করেছিলাম এই চিঠি কোনদিন কাউকে দেখাব না। একমাত্র দেখাব আমার মেয়েকে। তাকে দেখিয়ে বলব,


‘দেখ মা, চিঠিটা পড়।আমার মায়ের সম্পর্কে তোর ধারনা থাকা উচিৎ। কি পরিমান আবেগী মহিলা ছিলেন তিনি।আবেগের বশে যিনি শত মানুষর মাঝে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতেন।’


আজ আর লোভ সামলাতে পারলাম না। তীব্র ইচ্ছা করছে পাঠককে চিঠিটা দেখানোর জন্য। এই ইচ্ছা দমিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই।


সমস্ত চিঠিটাতে আমি একটা লেখায় লিখেছিলাম...


মাগো মাগো মাগো মাগো.....................


এই কথাটাতে কি পরিমান কান্না আর কষ্ট লুকিয়ে ছিল আমি জানি। আমার চাইতেই বেশী জানেন আমার মা। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন তার ছেলে কত কষ্টে আছে?


টাকার অভাবে দুই দিন না খেয়ে আছে?


লিপজেলের অভাবে চুরি করে রুমমেটের সরিষার তেল ঠোটে মাখছে?


অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন।


এই পৃথিবীতে একজন সন্তানকে সবচাইতে বেশী বোঝে মা।


এই পৃথিবীর বিজ্ঞান অনেক উন্নত হবে। কোটি কোটি যন্ত্রপাতি তৈরী হবে। এরা মানুষের মন অক্ষরে অক্ষরে বুঝে ফেলবে। তবে মায়ের মতো বুঝতে পারবে না।


মা প্রজাতিটা আদিকাল থেকেই বুঝে আসছে, এখনো বুঝে যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন এই বুঝতে যাওয়া।


ছোট্ট একটা গল্প বলি,


একজন মা শহরে এসেছে।


সাথে এনেছে কবুতরের মাংস আর পোলাও। ছেলেকে নিয়ে একসাথে খাবেন।


শহরের সবচাইতে সুন্দরএকটা রেস্টুরেন্টে বসে মা ছেলে একসাথে খাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। পৃথিবীতে এই দৃশ্যগুলো এখন বিরল হতে চলেছে।


খাওয়া শেষে একটা ছোট ছেলে আসল। হোটেল বয়।


বয়স সাত বছর। মা-ছেলের খাবারের উচ্ছিস্ট গুলো পরিষ্কার করবে। টেবিল মুছবে।


হোটেল বয় টেবিলে হাত দিল। সাথে সাথে মা চেঁচামেচি শুরু করলেন। এতো ছোট ছেলেকে দিয়ে কি কেউ টেবিল মোছায়?

মা হোটেল ম্যানেজারকে ডাকলেন।


সবাই এসে গেছে।


মা সবার সাথে ঘোষনা করলেন,

‘আজ থেকে এই ছেলে আমার। আমি একে পালব।’


ছেলে বিব্রত। সাথে সাথে খানিকটা বিরক্তও। কিছুই বলতে পারছিল না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল,

‘একটা হোটেল-বয় কিভাবে একজন অপরিচিত মহিলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কান্নার সাথে বারবার মৃদু স্বরে বলছে,

‘মা...... মা......।’


যে ছেলেটি বিব্রত আর বিরক্ত সেই ছেলেটি আমি।


বাঙালী মায়েরা একটু পাগল হয়। আমার মাও বাঙালী। অদ্ভুত আর অসীম ভালোবাসা তাকে আরো পাগল করেছে।


আমি এ মায়েরই সন্তান......



উৎসর্গঃ পৃথিবীর সকল মাকে। যাদের পেটে দশ মাস থেকে আমরা শুধু রক্ত-মাংস শুষে খেয়েছি। বের হয়ে আসার সময় শান্ত ভাবে আসিনি। অশান্ত ভাবে এসেছি। এসেছি জরায়ু ছিন্ন করে।
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×