somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত!!!

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘আপনে পিশাপ করেছেন?’
‘উঁউঁউঁউঁউঁ’
‘গুড, পায়খানা করেছেন?
‘উঁউঁউঁউঁউঁ’
‘গুড! বমি করেছেন?
‘উঁউঁউঁউঁউঁ’

‘ফাইন। হাত পা সরসর করছে?
‘উঁউঁউঁউঁউঁ’
‘বাহ গুড গুড। বাঁশলি হয়েছে? ।’
‘উঁউঁউঁউঁউঁউঁউঁউঁউঁ।’

‘ঐ খাদেম। মেডিসিন ইউনিট থ্রী, ইউনিট থ্রী।’

খাদেম নামক দেশী শুটকীর মতো লোকটা ছুটে আসল। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ট্রলিতে করে রোগীকে নিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডের পথে তুফানের মতো ছুটতে শুরু করল। আমাদের পেছনে আরো কয়েকটা ট্রলি এভাবেই ছুটে চলছে।

এতক্ষন গম্ভীর হয়ে যে ভদ্রলোক রোগীর রোগের ইতিহাস নিলেন, তিনি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী। ব্যাথায় অজ্ঞান রোগীর ডায়াগনোসিস দক্ষ হাতে করে ফেলছেন। রোগীর উত্তর করা লাগছে না। শুধু উঁউঁউঁউঁউঁ করলেই বুঝে ফেলছেন কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হবে। সাত বছর ইমার্জেন্সীতে কাজ করে তিনি ডাক্তারী শিখেছেন। ছোটখাটো এফ,সি,পি,এস ডিগ্রী তার আঙ্গুলের ডগায় ছলকা ছলকি করে।
জরুরী বিভাগের দায়িত্বশীল ডাক্তার পরম বিশ্বাসে অথবা চরম লজ্জায় রোগীর ডায়াগনোসিসের দায়িত্ব কর্মচারীটির হাতে তুলে দিয়েছেন। কর্মচারীর সাত বছরের অভিজ্ঞতার কাছে তার মেডিকেলের সমস্ত বিদ্যাকে সন্দেহযুক্ত মনে হয়েছে। বিষয়টা মন্দ না। দায়িত্বশীল ডাক্তার হয়তোবা চিপা গলির ভেতরের রুম থেকে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে রোগীর মনের কথা শুনে নিয়েছেন। নিজের দায়িত্বের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করে তিনি নিজের রুম থেকে বের হচ্ছেন না।
কর্মচারীর ডাক্তারী জ্ঞানের বহর আর ডাক্তারের টেলিপ্যাথির মারাত্মক কৌশল দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। চরম পুলকিত হলাম।

খাদেমকে লক্ষ্য করে আমিও ট্রলির পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলাম। উল্টো দিক থেকে একটা ট্রলি আসছে। একজন অতি রুপবতী হিন্দু মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছেন। পেছনে পেছনে দেব শিশুর মতো দুইজন বাচ্চা ছেলে হাউমাউ করে মায়ের পেছনে ছুটছে। তাদের সামনে ধীর গতিতে চলমান ট্রলিতে তার স্বামীর মৃতদেহ। আমার রোগীর আগে এই মৃত মানুষটিকে জীবিত অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল। ভর্তি হয়েছিল দায়িত্বশীল ডাক্তারের টেলিপ্যাথির মাধ্যমে আর কর্মচারীর পিশাপ-পায়খানা-বমির ডায়াগনোসিসে।

আমি থেমে গেলাম। একজন বয়স্ক লোক সবাইকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম,
‘কাকু, কি হয়েছে?

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। আমার চেহারায় নাকি একটু হিন্দুয়ানী ভাব আছে। এই বিষয়টা তাকে সহজ করে দিতে সাহায্য করতে পারে। তিনি আমার কাধে হাত রেখে বললেন,
‘কিছু হয় নি বেটা। আমার ছেলেটার হার্ট এটাক হয়েছিল। মেডিসিনে ভর্তি না করে কার্ডিওলজীতে ভর্তি করলে কিছু একটা হতো।’

আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম লোকটার মুখে হাসি অথচ চোঁখে জলের বান ডেকেছে। আমার মতো সম্পুর্ন অপরিচিত একজন ছেলেকে জড়িয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেদে উঠলেন।

শোক অদ্ভুত জিনিস। ছোয়াচে রোগের মতো। জনে জনে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাদের শোক আমার মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমার চোখ দিয়েও জল ঝরতে শুরু করল। সম্পুর্ন অপরিচিত একটা মানুষকে বোকার মতো জড়িয়ে ধরলাম। পরম মমতায় বয়স্ক লোকটির গায়ে আমার দুইটা হাত জড়িয়ে গেল।

অদ্ভুত আর হাস্যকর একটা বিষয়। একটা রোগী মরে গেলেন শুধুমাত্র ভুল ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়ার জন্য।

তাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কিছু হয় নি। মহাকালের ঘড়ির কাটা এক সেকেন্ড থামে নি। বৃদ্ধলোকটি তার ছেলেকে হারিয়েছে। অতি রুপবতী মহিলাটি তার একমাত্র সম্বলটা হারিয়েছে। এই অভাগা পরিবারটিতে হয়তো কয়েকদিন সন্ধ্যা প্রদীপ বেশীই জ্বালাবে। ধূপ পুড়িয়ে চোখের জলকে মিথ্যা অজুহাতে লুকিয়ে ফেলবে। তার দেব শিশুর মতো ছেলে দুটি স্কুলের রেজিস্টারে বাবার নামের আগে ছোট্ট করে লিখে রাখবে ‘মৃত’।

[আমি আমার একটা কলামে লিখেছিলাম,
‘সৃষ্টিকর্তা তার সবচাইতে প্রিয় বান্দাদের বসিয়ে রেখেছেন হাসপাতালে। তাদের কাজ হলো মানব যন্ত্র মেরামত করা। এই যন্ত্র সৃষ্টিকর্তা বানিয়েছেন অতঃপর সমগ্র জীবনের জন্য মেরামতের দায়িত্ব দিয়েছেন এই প্রিয় বান্দাদের।
ডাক্তার তোমার পরিচয় জানলে?
কেন এতো সহজে ভুলে যাও?]

পাদটিকাঃ মেডিকেল লাইফে আমি অসম্ভব কিছু মেধাবী বন্ধুকে পেয়েছি। পরীক্ষার সময় আমরা একই সাথে ফরম ফিলাপ করি। আমি দ্রুত গোটা গোটা হাতে আমার বাবার নাম লিখে তাদের ফরমের দিকে তাকাই। ঈগল চক্ষুতে তাকিয়ে থাকি তাদের কলমের পিনের দিকে। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি তাদের হাত কেঁপে যাচ্ছে। কি অসম্ভব কান্না চেপেই না তারা তাদের বাবার নামের আগে লিখে ফেলে ‘মৃত’।

বন্ধু,
আমার বাবা সুস্থ আছে। আমি শত চেষ্টা করেও জানতে পারব না কতটা কষ্ট পাস তোরা ঐ কথাটা লিখতে।
শুধু মনে রাখিস, তোর অবহেলায় যেন না মরে অন্য কারো বাবা। মাথা তোর। ব্যাথাটাও তোর জানা আছে



>>>ফেসবুকে রাজীব হোসাইন সরকার(https://www.facebook.com/nillchokh)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×