somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ (The Ring Of Bright Water) - দ্বিতীয় পর্ব

২২ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেদিনের পরে মেনিলার সাথে দারুন ভাব হয়ে গেলো। ভার্সিটির বাইরে আমার প্রথম ফ্রেন্ড সে। প্রায় সময়ই মেনিলার সাথে আড্ডা কিংবা ঘুরতে যাওয়া হতো কাউন্ট্রি সাইডে। দুজনে তর্ক চলতো রবীন্দ্রনাথ আর শেক্সপিয়র নিয়ে। তাকে আমাদের উপমহাদেশের কথা শোনাতাম। মুগ্ধ হয়ে শুনতো। তাদের রূপকথা শোনাত। পৃথিবীর সব রূপকথা হয়ত একই, ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন কল্পনা মাত্র। রূপকথায় রাজা থাকে, রাজকুমার থাকে, রাজকুমারী থাকে, ঘোড়া থাকে, ডাইনী কিংবা দুষ্ট বুড়ি থাকে। রাজকুমারী আশায় বসে থাকে রাজকুমারের, আর রাজকুমার অনেচা কোন রাজ্য জয় না করে ফিরে আসবে না বলে সংকল্প করে। শেষটায় রাজকুমারীর অপেক্ষার শেষ হয়, ফিরে আসে রাজকুমার। তারপরে সুখে শান্তিতে বসবাস করে তারা।


আমার বাবা একজন মধ্যবিত্ত ব্যাবসায়ী। ভার্সিটি থেকে স্কলারশিপটা না পেলে হয়ত আজ উচ্চশিক্ষার এই সুযোগ হতো না। প্রায় দুই বছর হলো বাইরে আছি। বাবা মা-কে কতদিন দেখা হয়নি। আম্মার সাথে কথা হলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে খাওয়া দাওয়া ঠিকভাবে হচ্ছে কি না। তার ধারনা তার ছেলে এখনো ছোটই আছে। সে না খাইয়ে দিলে খেতে পারে না। আমিও দিনগুনি ফিরে যাওয়ার। আর তো মাত্র একটি বছর।


মেনিলা সেদিনও আমার জন্মদিনে খুব দামি একটা গিফট করলো। সে প্রায়ই এমন সব পাগলামি করে। একদিন একটা দামি লাইটার গিফট করলো। স্টিলের উপরে স্টোনে লেখা ‘রিক’। অর্ডার করে বানানো।

আমি বললাম, “মেনিলা, আমিতো স্মোকিং করি না।“
“স্মোকিং করো না তাতে কি? একসময় করবে। আমি আগে থেকেই তোমাকে গিফট করলাম।“
“বিলিভ মি, আমি স্মোক টলারেট করতে পারি না”
“আচ্ছা যাও, তোমাকে স্মোক করতে হবে না, তুমি এটা রেখে দিও, মাঝে মাঝে জ্বালিয়ে এর শিখা দেখো, বুঝতে পারবে কতটা উত্তাপ একটি মেয়ের ভালোবাসায় থাকে। আচ্ছা তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?”
“হ্যা” আমি কনফিডেন্সের সাথে দ্রুত জবাব দিলাম।
“ও, কে সে জানতে পারি?” কিছুটা বিমর্ষ দেখায় মেনিলাকে। ধবল মুখ রক্তশুন্য ফ্যাকাসে দেখায়।
“আমার মা, পৃথিবীর সবথেকে ভালো নারী হচ্ছেন তিনি।“

হেসে ফেলে মেনিলা, ওর হাসির অর্থটুক আমি বুঝি। কিন্তু অনেক কিছুই আমাকে না বুঝার ভান করতে হয়। মধ্যবিত্তের অনেক কিছু দেখার থাকে, কিন্তু করার থাকে না। তারা অভাবে হাত পাতে না স্বভাব সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে। হারিকেনের চিমনির বাইরের আলো সবাই দেখতে পায়, কিন্তু ভিতরের জ্বলন্ত শিখার কষ্ট কেউ বুঝে না।

মেনিলার এসব দামি উপহার নিতে সংকোচ বোধ হয় আমার। আমার সাধ্য নেই তাকে এমন কিছু দামি গিফট করার। কাজ থেকে যে টাকা আসে তাতে এপার্টমেন্টের ভাড়া আর অন্যান্য খরচ বাদে মাসের শেষে তেমন কিছুই থাকে না। মাসের শেষ কয়টা দিন একটু বেশিই হাত খালি থাকে। সুতরাং সেখানে গিফট কেনার কথা ভাবাই দুস্কর। আমি ওকে বোঝাতে চাই এসবের কোন অর্থ হয় না, কিন্তু সে বুঝেও তার পাগলামি চালিয়ে যায়। একদিন আমার সাথে দেখা করতে এসে বললো, “রিক, জানো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।“
“কেন?”
“তুমি সেদিন বলেছিলে স্মোক তুমি টলারেট করতে পারো না, তাই আমি স্মোকিং ছেরে দিচ্ছি।“
“বুঝলাম না! আমার টলারেট করা আর না করায় কি যায় আসে?”
“তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি না বুঝলেই ভালো।“


আমি বুঝতে পারি। মেনিলা যতটা সহজ ভাবে সবকিছু ভাবতে পারে আমি পারি না। আমার পরিবেশ আমাকে শেখায় নি। আমি ভাবতে পারি পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে খুব সম্মানজনক একটা চাকরীর কথা, আমি ভাবতে পারি বাবার ব্যাবসার ঋণ শোধ করার কথা, আমি ভাবতে পারি বাবা মাকে নিজের কেনা ফ্ল্যাটে রাখার কথা। ভালোবাসা কিংবা আবেগ আমার কাছে তাই খুব সস্তা, মূল্যহীন।

মাঝে মাঝে রাত জেগে জানালায় বসে থাকি, আকাশের চাঁদ দেখি। আমার মনে হয় ঠিক এইসময়ে কোন প্রিয়জন চাঁদ দেখছে। দুজন হয়ত বহুদুরে থাকতে পারে, কিন্তু দুজনের দৃষ্টি একই লক্ষ্যে। এসব ভাবতে ভালো লাগে আমার। চাঁদের আলোয় বরফ ঢাকা সাদা বিস্তৃত মাঠ দেখতে ভালো লাগে। কখনো কখনো জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে তুলার মত শুভ্র তুষার হাতে নেই। শীতল বাতাস হু হু করে ঢুকে পরে আমার ঘরে।

“ঝরে যায় সব, তুমি আমি পাতা
পাতাল স্পর্শের পূর্বক্ষণে,
থেকে যায় সুপ্ত বাসনার সাজা
তারাও ঝরে পড়ে শেষ বসন্তে।”

কিছু শব্দ কিছু কবিতা নিজ মনে আওড়ে যাই। নিতান্ত অনিচ্ছায় ডায়েরীর পাতায় লেখা হয় না সে কবিতা। কতদিন হয়ে গেলো দিনপঞ্জিকা লেখা হয় না। মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে। ডায়েরীর পাতা খুলে বসে থাকি। রাত গড়িয়ে যায়, ডায়েরীর পাতা আগের মতই সাদা থেকে যায়।


মাঝে মাঝে মেনিলাকে খুব মনে পরে। ইচ্ছে করে এই মেয়েটিকে নিজের ভাবতে। ওর ঠোঁটের নীচের কালো তিলটি ছুঁয়ে দিতে। হাতে হাত রেখে তুষার ধরতে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হয় এসব নিছক পাগলামি। মেনিলাকে পাশে নিয়ে রাতের চাঁদ কিংবা তুষারপাত দেখতে সত্যি যে আমার ইচ্ছে করে না বললে মিথ্যে বলা হবে। খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি ইচ্ছে দীর্ঘদিন চেপে তা মূল্যহীন করতে জানি।


প্রায় সময় মেনিলা তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। পলক না ফেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমি চাইনা এতটা প্রশ্রয় দিতে। আমি ডাকি মেনিলাকে, চমকে উঠে চোখ সরিয়ে নেয়। তখন ওর উজ্জ্বল চোখে লজ্জা আর ভালোবাসা খেলে। আমারও ইচ্ছে করে ওর মত সবকিছু ভুলে তাকিয়ে থাকতে, চোখ ভরে ওকে দেখে নিতে। কিন্তু আমি ইচ্ছে চেপে যাই। আমার সংকোচ বোধ হয়। আমি জানি না কেন আমি ভালোবাসা থেকে এভাবে পালিয়ে থাকতে চাই।

আমি সত্যিই টান অনুভব করি মেনিলার জন্যে। আমি জানি আমি কোন এক মায়াজালে জড়িয়ে গেছি। এই জাল থেকে মুক্তির উপায় নেই, তবে পালানোর পথ আছে। আমি জানি পালিয়ে গেলে আমি এই মায়া থেকে দূরে সরে যেতে পারবো, কিন্তু একেবারে কখনোই আমার মুক্তি মিলবে না। এই সস্তা আর মূল্যহীন আবেগের কাছেই আমাকে হেরে যেতে হবে। তারপরেও আমি চলে যেতে চাই আড়ালে, কোন এক অজানা লেখকের ছোট গল্পের শেষের মত। যে গল্প কখনো কোনদিন জানবে না কেউ।


মেনিলার একটি জিনিস আমার অসম্ভব প্রিয়। ও যখন কথার মাঝে নীচের ঠোঁটের ডান পাশটা কামড়ে ধরে তখন ওকে দেখে অসম্ভব সুন্দর মনে হয়। গোলাপি ঠোঁটের একটি কোন নীলাভ হয়ে যায়। তখন ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হয়। এতটা সুন্দর একবারে নয়, বারে বারে দেখতে হয়। ও কখনো কখনো কথার মাঝে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিত। আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে একদিন দু’হাত ভরা চুড়ি পরে দেখা করতে এলো। ঝন ঝন চুড়ির শব্দ বিদেশিনীর হাতেও মনোরম সূর তুলেছিল সেদিন।
“রিক, কেমন লাগছে?”
“তুমি চুড়ি কোথায় পেলে?”
“কিনেছি, তোমার পছন্দ হয়েছে?”
“কোথা থেকে জানলে আমাদের দেশে চুড়ি পরে মেয়েরা?”
“আমি তোমাদের কালচার নিয়ে স্টাডি করছি কিছুদিন থেকে, তোমাদের দেশের মেয়েরা শাড়ি পরে, আমি শাড়ি কিনেছি, কিন্তু পড়তে পারিনি। তুমি বললে না তো কেমন লাগছে?”
একদিন শাড়ি পরে এসো, সেদিন বলবো।


আমি জানি ও একদিন শাড়ি পড়া শিখবেই। মেনিলা আমাকে মুগ্ধ করার জন্য এমন কিছু নেই যে না করবে। ওর চিন্তা যেখানে শুধুই আমাকে নিয়ে, আমার চিন্তা সেখানে বিস্তৃতি জুড়ে। মেঘলা দিনের আকাশ চিরে রোদ নামাতে চায় সে, আমি চাই সেই রোদ কিন্তু আমি মেঘলা আকাশের কান্নাও দেখতে চাই। গুরিগুরি বৃষ্টিতে একাই ভিজতে চাই। আমি কাকভেজা হয়ে নীড়ে ফিরতে চাই। আমি ফিল করি মেনিলাকে, মাঝে মাঝে খুব বেশী। কিন্তু ফিরে যেতে হবে আমাকে। আমি যে ফেলে এসেছি কিছু স্মৃতি, আমি যে চাইনা কাউকে সেই স্মৃতির পাশে স্থান দিতে। শুধু আমি, শুধুই আমিই থাকতে চাই সেই স্মৃতির সমাধির পাশে অনন্তকালের জন্য। সেই স্মৃতি আর ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার যে নেই!

স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ (The Ring Of Bright Water) - তৃতীয় পর্ব




সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৩০
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×