যাইহোক, ড্যাফোডিলের দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা দিন। তখন লাইফের একটি অধ্যায় সত্যই পার করে এসেছি বলে মনে হতো। আমরা সাত বন্ধু আড্ডা দিতাম রাইফেলস স্কয়ারের সামনের লেকে। প্রতিদিন আড্ডা না হলে আমাদের পেটের ভাত হজম হতো না। এখন সাতজনের মধ্যে আমাকে বাদে বাকি ছয় জনের সামান্য বর্ণনা দেই।
আমাদের সাত জনের মাঝে আমি ড্যাফোডিলের (BIT) সেকশনে ছিলাম আর মুন্না ছিল (BBA) সেকশনে। অরমিকা ছিল আমাদের এক ইয়ার সিনিয়র, ও পড়তো কম্পিউটার সায়েন্সে ULAB এ ।আর ফাহাদ, রানা, পাপ্পু আর রাব্বি পড়ত BIMS এ (ACCA) তে। আমাদের এই সাতজনের সাথে মান্নাদের কফিহাউজ গানটা অনেকটা মিলে যায়। আজ সাতজনের কেউ নেই। সবাই যার যার মত ব্যাস্ত।
ফাহাদের সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। একটু উত্তেজিত থাকে সবসময়। সুতরাং দাঙ্গা হাঙ্গামায় ওকে পাওয়া যেত সবার আগে। প্রথমে প্রেম করতো সৌদি প্রবাসী ওর এক মামাত বোনের সাথে। মেয়েরা একেবারে দেশে চলে আসার পরে ফ্যামিলির কারনে হয়ে গেলো ব্রেক আপ। তারপরে ধরলো তন্দ্রা নামের ইডেনের এক মেয়েকে। পনের দিন প্রেম করে একদিন মাতাল হয়ে সেই মেয়েকে ইচ্ছেমত গালিগালাজ করলো মোবাইলে। সেখানেও ব্রেক আপ। ফাহাদ বন্ধুপাগল ছেলে।
রানারা থাকতো খিলগাঁও এর দক্ষিন গোরানে। রাব্বি আর মুন্নাও সেখানেই থাকতো। রানা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আর ফাহাদের মামাত ভাই। ইয়া মোটা আর সাড়ে ছয় ফিট লম্বা এক দ্বৈত। রিকশাওয়ালা ওকে দেখলে দশটাকা বেশী দিতে চাইলেও যেত না। ফাহাদ আর ওর সেই মামাত বোনের ব্রেক আপ হওয়ার পরে সেই মেয়ের সাথে ভাব হলো রানার। রানা তখন আমাদের ভুলে চুটিয়ে প্রেম করতে লাগলো। কিছুদিন রানার খবর না পেয়ে গেলাম ওর বাসায়। দেখি বেচারার ওজন কমে গেছে। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শরিরের বারটা বাজাচ্ছে। পরে শুনলাম আসল ঘটনা। সেই মেয়ে নাকি ওকে ব্ল্যাকমেইল করতেছে। মেয়ে নাকি ওকে বিয়ে করতে বলছে। আর রানা ওর বাবা মাকে এত ভয় পায় যে কান্নাকাটি অবস্থা। মেয়ে নাছোড়বান্দা। দুইবার ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসছে। রানাকে নিয়মিত হুমকি দেয় বিয়ে না করলে দুজনের বাবা মার কাছে সব বলে দেবে।
মুন্না ভালবাসতো তন্নি নামের এক কাজিন কে। কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারেনি তার মনের কথা। প্রায়ই তন্নিদের বাসায় বেড়াতে যেয়ে দেখে আসতো সেই মেয়েটিকে। ওর কাছে এটুকুই ছিল ভালোবাসা। খুব ভালো আমার এই বন্ধুটি। মাঝে মাঝে যখন ফেসবুকে মন খারাপ্রের স্ট্যাটাস দেই তখন পারলে কেঁদে ফেলে। ওর কমেন্ট দেখলে হাসিও পায় আবার কষ্টও পাই এত ভালো বন্ধুদের থেকে দূরে থেকে।
রাব্বি ছিল ঠান্ডা মাথার ছেলে। চুপচাপ থেকে সব দেখত আর যে যা বলে তার সাথেই সহমত দিত। কালো শুকনো গড়নের চোখে চশমা আর চম্বা চুল। মায়াকড়া দুটি চোখ ওর। ভালোবাসতে জানে নীরবে। নিজের অনুভুতি চেপে রাখবে, কখনো কাউকে বুঝতে দেবে না নিজেকে।
পাপ্পুকে আমরা খুব কম সময়ের জন্য পেতাম। পাপ্পু আমাদের পাশের এলাকার ছেলে। খুব বন্ধুপ্রিয় ছেলে। ১৮+ জোকস বলা ছিল ওর প্রধান কাজ।
অরমিকা ছিল আমাদের একবছরের সিনিয়র আর আমাদের সাতজনের মাঝে একমাত্র মেয়ে। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে উদ্ভট যে মেয়ে চরিত্র হয় অরমিকা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যখন যা ইচ্ছে করতো তাই করতো। বাবা ভাই সবাই প্রবাসে থাকে। ওয়ারীর বাড়িতে ও আর ওর আম্মা একাই থাকেন। ইচ্ছেমতন টাকা খরচ করতো আমাদের পেছনে। এতেই ওর আনন্দ। মাঝে মাঝে মেনথল সিগারেট কিনে দিতাম। রাতের বেলায় রুমের দড়জা লাগিয়ে সিগারেট টানতো। আর শুধু ঘুরে বেড়ানর প্ল্যান করতো। কারনে অকারনে আমাদের থাপ্পর মারা ছিল ওর হবি।
আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত হয়ে যেত হদিস থাকতো না। আড্ডার মধ্যে আলোচনা ছিল কে কি করলো, কে কোন মেয়ের সাথে প্রেম করলো আর পাপ্পুর ১৮+ জোকস বলার সময়ে কানে হাত দিয়ে বসে থাকা। বিকেলে যেয়ে আমরা বসে পড়তাম ধানমন্ডির কোন ফাস্টফুডে কিংবা রেস্টুরেন্টে। খাওয়াদাওয়া শেষে অধিকাংশ সময় অরমিকা বিল দিলেও মাঝে মাঝে আমরা পকেট ফাঁকা করে আসতাম।
শেষের দিকে এসে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড কলেজ ইউনিভার্সিটি সেন্টার থেকে ভিসা লেটার চলে আসে। এর আগে একবার ভিসার সমস্যা হয়েছিল বলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ( PASS ) সেকশনের সাহায্যে প্রসেস করালাম। ভিসা হয়ে গেলো কিছুদিনের মধ্যেই। সার্টিফিকেটে বয়স কম থাকায় আন্ডার গ্রাজুয়েশন কোর্স পেলাম বিজনেস ইনফরমেশন টেকনোলজিতে। এতদিন অপেক্ষায় থাকতাম ভিসার জন্যে আর ভিসা পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো সব ছেরে যেতে হবে ভেবে।
ভিসা পাওয়ার মাত্র সাতদিনের মাথায় ঈদের দুইদিন আগে ফ্লাইটের টিকিট কাটা হলো। সেভেন ওয়ান্ডার্স মানে আমরা সাতজন শেষ দেখা করতে এলাম ধানমন্ডির রাইফেলসে। সন্ধ্যায় সুনামিতে ইফতারের পরে শুরু করলাম খাওয়াদাওয়া। তখন রাব্বিকে নীচে থেকে ডেকে উপরে উঠতে যেয়ে ঘটলো এক দুর্ঘটনা। সিঁড়িতে বাঁধা পেয়ে রেস্টুরেন্টের গ্লাসের ডোর ভেঙ্গে পরে গেলাম আমি। কপালের বাম পাশ কেটে গেলো। রানা আর ফাহাদ আমার সাথে গেলো জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালে। ইয়া লম্বা এক ব্যান্ডেজ করে দিল কপালে। যাইহোক, সবার থেকে বিদায় নিলাম। কান্নাকাটি আর বেস্ট উইশেশ একসাথে। অরমিকা বাচ্চাদের মত কান্নাকাটি করে চোখের কাজল দিয়ে আমার টিশার্টের বারোটা বাজালো। শেষে ফাহাদকে নিয়ে রিকশায় যাত্রাবাড়ি যেয়ে ব্যান্ডের খুলে দুইটা প্ল্যাস্ট লাগিয়ে বাসায় রওনা হলাম। ফ্লাইটের আগ পর্যন্ত আমাকে বাসায় বন্দী করে রাখা হলো।
আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে আব্বু-আম্মু, মেঝচাচা, ছোটচাচা আর বন্ধু ফাহাদ আর রানা। বিদায়ের মুহূর্ত কেন যেন সবসময় করুণ হয়। বুকের ভেতরে ধুক ধুক করছিল প্রতিটি মুখের দিকে তাকিয়ে। একসময়ে ঢুকে পড়লাম ইমিগ্রেশন লাউঞ্জে। আব্বুর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে স্টেয়ার পেরিয়ে উঠলাম বিমানে। ছোট বেলায় যেই বিমান দেখে ইচ্ছে হত একদিন আমিও উড়ে যাব। ভোরের আলো তখন ফোটতে শুরু করেছে। ফিকে আলোয় চলতে শুরু করলো আরেকটি জীবন। ইতি ঘটলো জীবনের একটি অধ্যায়ের। ছল ছল চোখে তাকিয়ে রইলাম জানালায়। আজ ছেরে যাচ্ছি সব, ছেরে যাচ্ছি সবাইকে। শেষ বারের মত দেখে নিলাম প্রিয় স্বদেশ চোখভরে। চেষ্টা করলাম প্রিয় মুখগুলো মনে করার। হারিয়ে গেলাম সীমানা পেরিয়ে।
এতটুকই আমার জীবনের গল্প। এই গল্পে দেখেছি সুখের দিন, শুনেছি হারিয়ে যাওয়ার সূর। আমার দাদীর মৃত্যুর পরে আমাদের ফ্যামিলি ভেঙ্গে পরে। চাচারা যে যার মত সরে যায়। দাদা মাঝে মাঝে শব্দ করে কেঁদে উঠেন। আম্মু আশায় থাকেন কখন আমি ফোন করবো। আব্বু বরাবরের মত নিজেকে শক্ত রেখে আমাকে অভয় দেন। বন্ধুবান্ধব সব নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত। ফাইনাল ইয়ারে অধ্যায়নরত আছে প্রায় সবাই। ফাহাদ, রাব্বি আর রানা জব করছে পড়াশোনার পাশাপাশি। মুন্না এখনো আশায় আছে তন্নির জন্য ভালোবাসা নিয়ে। অরমিকা কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। রাইফেলস স্কয়ারের সেই লেকে এখন আর আড্ডা জমে না। সেখানে নতুন কোন মুখ হয়ত আমাদের স্থান নিয়েছে। দিনে দিনে সবকিছু দূরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোন পার্ক বেঞ্চ কিংবা নদীর পারে বসে ভাবি অতীতের সেই দিন। ইচ্ছে করে আবার ফিরে পেতে হারানোর দিন। কোন কোন অলস দুপুরে হাটতে হাটতে পুরনো সৃতি মনে করে একা একাই হেসে ফেলি। একা একা লাঞ্চ আওয়ারে যখন কোন রেস্টুরেন্টে বসে ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেখি, মনে পরে আমাদের সেই দিন।
এখনো সেই রাতের আকাশে তাকিয়ে থাকি। আকাশে তাকিয়ে ভাবি কোন এক প্রিয়জন হয়ত এই সময়ে আকাশ দেখছে। হয়ত সেও তাকিয়ে আছে নিঃস্ব চাঁদের দিকে। সময় চলে যায়, চলে যাচ্ছে, রয়ে যায় সৃতি আর সৃতি নিয়ে বেঁচে থাকি।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর ৩ বছর পরে তার একটি রোলটানা খাতায় লিখে যাওয়া ৭৩ টি কবিতা থেকে ৬১ টি কবিতা বাছাই করে প্রকাশিত করা হয় “রূপসী বাংলা” নামের তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। সেই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা দিয়ে ইতি টানছি......কবিতার নাম “খুঁজে তারে মরো মিছে......”
“খুঁজে তারে মরো মিছে
পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে
তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক নাই আর;
অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক দাঁড়কাক দেখা যেত দিন রাত,
সে আমার ছেলেবেলাকার কবেকার কথা সব;
আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক,
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা,
অবাক তার কথা ভাবি শুধু,
এতদিনে কোথায় সে?
কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সে নদী,
ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই দিন সেই রাত্রি,
সেইসব ম্লান চুল,
ভিজে শাদা হাত সেই সব নোনাগাছ,
কমরচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাঁস,
সেইসব ভিজে ধুলো,
বেলকুড়ি ছাওয়া পথ,
ধোঁয়া উঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব?
অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ ভোর রাতে
নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!”
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৩:৩০