সেপ্টেম্বর ১৩। আনলাকি থার্টিন।
বার্ডে দুই মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এর শেষ দিন। বিদায়বেলায় একটু মন ভারাক্রান্ত। দুপুরের খাবার শেষে কোর্সমেট কয়েকজন মিলে প্রাণচঞ্চল কুমিল্লা শহর পরিভ্রমণ করলাম। ধর্মসাগর, অরিজিনাল আদি মাতৃভান্ডার, খাদির দোকান ঘুরে, কেনাকাটা শেষে সন্ধ্যায় বার্ডে শেষবারের মত ফিরে এসেছি। বিদায় শেষে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দিতে রাত সাড়ে আটটা। আমি আর সারওয়ার ভাই মাইক্রোতে নোয়াখালী ফিরবো, মাইক্রো ড্রাইভার তোফায়েল - বেশ রসিক ও মিশুক মানুষ। ফিরতিপথে মনে হল কুমিল্লার প্যারা সন্দেশ বাসায় নিয়ে যাই, সুতরাং হাইওয়ের একটা হোটেলে গাড়ি থামিয়ে হালকা পেটপুজো, তারপর কেনাকাটা সেরে পুনরায় যাত্রা। প্রচন্ড বৃষ্টিতে সেসময় পদুয়ার বাজার হয়ে লাকসাম বাইপাস রোডের বেহাল দশা, তাই আমরা ফেনীর পাঁচগাছিয়া বাইপাস দিয়ে নোয়াখালীর চৌরাস্তা - মহীপালের রাস্তা ব্যবহার করে নোয়াখালী ফিরতাম।
যাই হোক, স্মৃতিচারণ-গল্প করতে করতে ভ্রমণ করছি। দেরীতে যাত্রা, বিরতি, একটু ঘুরপথ, রাস্তার জ্যাম সব মিলিয়ে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। নোয়াখালী-মহীপাল আঞ্চলিক রোড বেশ নির্জন। কিছু ট্রাক, দুয়েকটা বাস আর হাতেগোণা প্রাইভেট গাড়ী, রাস্তায় তেমন জনমনিষ্যিও নেই। জায়গাটা কোথায় মনে নেই, রাত প্রায় ১০:৩০ টা বাজে তখন, নিকষ কালো আঁধার চারিদিকে আর নির্জন রাস্তায় হু হু করে গাড়ী এগিয়ে চলছে। কিছু সামনেই একটা ট্রাক, তোফায়েল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ট্রাকটা ওভারটেক করবে। ট্রাক ফুলস্পীডে, আমরা মোটামুটি গতিতে; হঠাৎ দেখি আপাদমস্তক কাপড় মোড়ানো, মাথায় ঘোমটা দেয়া একজন মহিলা ঠিক আমাদের গাড়ীর সামনে দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে বাম দিক হতে ডান দিকে রাস্তা পার হয়ে গেলেন আর তারপর আর দেখতে পেলাম না। ডানে-বামে না তাকিয়ে মুখ নিচু করে রাস্তা পার হয়েছেন, ট্রাক এবং আমাদের মাঝ দিয়ে, গাড়ী দুইটিও ভালো স্পীডেও ছিল, যেন মহিলা জানতেন তার সাথে আমাদের গাড়ীর দুর্ঘটনার কোন সম্ভাবনাই নেই। হাঁটার গতিও এতই স্বাভাবিক ছিল যেটা অবাক হবার মতই, একটু দৌড়ে বা দ্রুতগতিতে তো রাস্তা পার হবার কথা! তোফায়েল গাড়ীর গতি এতটুকুও কমায়নি, এমনকী স্টিয়ারিং ঘোরায়নি পর্যন্ত, সে খুব স্বাভাবিকভাবেই জায়গাটা পেরিয়ে চলে এল।
আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এত রাতে একজন মহিলা নির্জন রাস্তায়, তার উপর এত স্বাভাবিক ভাবে রাস্তা পার হল, তার তো দ্রুতগতির গাড়ী দেখে ন্যূনতম আতংকিত হবার কথা ছিল। আমি কি চোখের ভুল দেখলাম কিনা, সারওয়ার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনিও অবাক হয়ে গেছেন, এমনকি তোফায়েলও মহিলা কে দেখেছে যদিও সে গাড়ীর গতি কিন্তু কমায়নি।
গাড়ীর ভেতরে একটু থম মেরে থাকলাম কিছুক্ষণ, তারপর আলোচনা শুরু হল। তোফায়েল জানাল গভীর রাতে গাড়ি চালানোর সময় সে আগেও বেশ কয়েকবার এই রাস্তায় হুবহু একই রকম এক মহিলাকে রাস্তা পার হতে দেখেছে। তার ধারণা এই মহিলা এখানেই কোন এক দুর্ঘটনায় হয়তো মারা পড়েছিলেন যার জন্য এই অশরীরী অভিজ্ঞতা এই রাস্তার চালকদের গভীর রাতে মাঝে মাঝে ফেস করতে হয়। চালকরা এই মহিলাকে দেখে কখনোই গাড়ীর গতি কমায় না, ব্রেক তো দূরের কথা।
হয়তবা সত্যিও হতে পারে, পৃথিবীর কত রহস্যই বা আমরা জানি! আবার এমনো হতে পারে আশেপাশে কোন লোকালয় বা বাজার আছে, গ্রামের মহিলা কোনরকম বাছবিচার না করেই রাস্তা পার হতে গিয়েছে। যেটাই হোক, রহস্য যাই থাকুক না কেন কিছুটা ভয় তো পেয়েছিলাম বটেই। সত্য-মিথ্যার তর্কে যাবো না, আমার অশরীরী অভিজ্ঞতার ভান্ডারে ঘটনাটা যুক্ত হল।
১৩ সেপ্টেম্বরের ঘটনাটা সবার সাথে শেয়ার করলাম, যাতে কোন পাঠক যদি কখনো চৌরাস্তা-মহীপাল রাস্তায় গভীর রাতে ভ্রমণ করেন, তিনিও এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন কিনা জানার ইচ্ছে রইল।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৬