নেদারল্যান্ডে আসার পর থেকে ভবছিলাম ইতালীর রোমে যাব, ভিসা যেহেতু আছে টাকা পয়সা হলেই যাব। ইউরোপে এসে রোমান সভ্যতা যদি না দেখে যাই তাহলে মন্তবড় একটা অপূর্ণতা থেকে যাবে। রোমান সভ্যতা নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র, গল্প, উপন্যাস আছে। চলচ্চিত্র, গল্প, উপন্যাসের রোম আর স্বচক্ষে দেখার মধ্যে অনেক ব্যবধান। সুতরাং এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
আমাদের ক্লাসে ইতালীর একজন মেয়ে ছিল নাম ভ্যালেন্টিনা। তাকে আমার ইচ্ছের কথা জানাতেই সে কম খরচে কিভাবে যাওয়া যাবে তার একটি পদ্ধতি বললো। এখান থেকে ওয়েজ এয়ারপোর্ট হয়ে চ্যাম্পিয়ানো এয়ারর্পোট হয়ে রোম যাওয়া যাবে। মোট খরচ প্রায় তিনশত ইউরো। এরপর কয়েক দিন ভাবলাম, তিনশ ইউরো টাকায় বল্লে অনেক টাকা, প্রায় ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকায় তো আর দেশ থেকে এসে রোম দেখা সম্ভব নয়। আর কবে আবার ইউরোপে আসবো তার নিশ্চয়তাও নেই। তাই যাব সিদ্ধান্ত নিলাম যাবই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সালেহ ভাই ছিল সেখানে, তার সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি বললেন সমস্যা নেই চলে আসো।
এরপর রাইয়ান এয়ার এ ভ্যালেন্টিনার সহযোগিতায় টিকেট কাটলাম। খরচ পরলো ৫৩ ইউরো। কিন্তু ভ্যালেন্টিনা নিল ৫০ ইউরো। টিকেট কাটলাম প্রায় একমাস আগে। আগে টিকেট কাটলে খরচ কম লাগে। দেখতে দেখতে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। আমার যাওয়ার তারিখ ছিল ১০ ডিসেম্বর। কিভাবে ওয়েজ এয়ারর্পোট এ যাব সেটা নিয়ে চিন্তার মধ্যে ছিলাম। এর মধ্যে আবার ভ্যালেন্টিনার এক বান্ধবী আসলো ইত্যালি থেকে। সেও যাবে ওয়েজ এয়ারপোর্ট হয়ে। সেজন্য ওয়েজ এয়ারপোর্ট যাওয়ার টেনশন থাকলো না। ৯ ডিসেম্বর আমরা এনসকেডে স্টেশনে টিকেট কাটতে গেলাম। সেখানে ওয়েজ এয়ারপোর্ট স্টেশনের জন্য যে টিকেট লাগে সেটা জার্মান ট্রেনের হওয়ায় তা দিল না। বললো মেশিন থেকে কাটতে। আমরা মেশিন কাটতে গেলাম। ভুলে ৯ তারিখের টিকেট কাটলাম ১০ ইউরো দিয়ে। টাকাটা গচ্চা। যাইহোক, পরদিন সকাল ৭.৫৬ তে একটা ট্রেন আছে আমরা সেটাতে যাব ঠিক করলাম।
ভোর সাড়ে ৬ টায় ভ্যালেন্টিনা ফোন দিল, বললো সে আমাদেরকে জার্মানির মুনস্টার ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে। আমাকে ৭.১০ এর মধ্যে তৈরি থাকতে বললো। আমি তৈরি হয়ে ছিলাম পরে ওরা আসার পর আমিও ওদের সাথে যোগ দিলাম। মুনস্টার থেকে টিকেট কাটলাম। ৩৪.৫ ইউরো ওয়েজ এয়ারপোর্ট স্টেশন পর্যন্ত। মাঝে ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে ক্রিফিল্ড স্টেশনে। সেখানে আমরা ট্রেন পরিবর্তন করে সাড়ে ১২ টার দিকে পৌছালাম। সেখানে স্টেশনের বাইরেই একটি বাস ছিল যেটা ফ্রি এয়ারপের্ট পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেই বাসে এয়ারপের্ট পর্যন্ত গেলাম। এবার গেটপাস দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। সুতরাং আমি সে দিকেই গেলাম। আর ভ্যালেন্টিনার বান্ধবী তার লাগেজ ছিল সেজন্য অন্য পথে গেল। আমার টিকেট ও পাসপোর্ট দেখে সিল মেরে ব্যাগ চেক করে ভিতরে ঢুকতে দিল। আমি এয়ারপোর্টের ভিতরে গেলাম। সেখানে ১ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত বসে ছিলাম। তারপর কাংখিত রাইয়ান এয়ার এর রোম (চ্যাম্পিয়ানো) এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। দু’ঘন্টা দশ মিনিটের পথ। বোয়িং ৭৪৭ মডেলের এয়ারবাস। এরপর বসলাম জালানার কাছে। যদিও প্লেন উঠা ও নামার সময় আমার কিছূটা সমস্যা হয়। কানের উপর চাপ পড়ে। তারপরও প্লেন উপরে উঠার সময় জ্বালানা দিয়ে দেখতে আমার ভালোই লাগে। মনে হয় পুরো শহরটাকে একসাথে বিদায় জানাতে পারলাম।
৭টা ২০ মিনিটের দিকে রোম (চ্যাম্পিয়ানো) এয়ারপোর্ট এ নামলাম। হালকা ঠান্ডা বাতাস। আমি ইতালির রোমে। ভাবতেই পুলকিত হচ্ছিলাম। সেখানে গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় বাস কাউন্টার দেখলাম। আমাকে সালেহ ভাই যেতে বলেছে রোমা টার্মিনি তে, সেখানে গিয়ে ওনাকে একটা ফোন দিলেই উনি চলে আসবেন ১৫ মিনিটের মধ্যে। আর এয়াপোর্ট থেকে রোমা টার্মিনি যাওয়ার বাসের কাউন্টার দেখে একটু স্বস্থি পেলাম। আমি প্লেনে ভাবছিলাম নেমে তো দেখবো অনেক রাত। কোথায় ট্রেন বা বাস পাব? আবার টার্মিনি যাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানা হয়নি। পরে টেরাভিশন নামক একটি বাস পরিবহনের টিকেট কাটলাম। সেই বাসে করে টার্মিনি গেলাম। বাসে আসার সময় একটু রোম সম্পর্কে অনুমান করলাম, রোম শহর অনেক পুরোনো, রাস্তাগুলিও অনেক সরু, সেজন্য বেশ কিছুক্ষণ যানজটে থকতে হয়েছিল। আর এটি বিষয় খেয়াল করলাম ফুটপাথে দোকান। এবং অধিকাংশ দোকান বাংলাদেশীদের মনে হচ্ছে। আমাকে রোমা টার্মিনির গেটেই নামিয়ে দিল। আমি রোম এর কেন্দ্রে। বিশাল এক ট্রেন স্টেশন। বাইরে থেকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম শপিং মল। একটা ট্রেন স্টেশন বাইরে থেকে বুঝতে পারিনি। আসলে দেখে বোঝার উপায় ছিল না। ট্রেন এর শব্দ নেই। আর এত ঝকঝকে পরিস্কার আর ঝলমলে। বাইরে থেকে রেললাইন দেখা যায় না। বাস থেকে নেমে রোমা টার্মিনির ভিতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বিশাল একটা ডিসপ্লে বোর্ড যেখানে ট্রেন এর সময়সূচী দেয়া আছে তবে একটু পরপর পরিবর্তন হয়। এই দৃশ্য এতদিন হিন্দি সিনেমায় দেখেছি এখন স্বচক্ষে দেখছি। এবার সালেহ ভাইকে ফোন দিতে হবে। অনেক পাবলিক ফোন। আমি চেষ্টা করলাম ফোন দেয়ার কিন্তু পারলাম না। আমার মোবাইল থেকে কল করলে রোমিং এর জন্য অনেক বেশি চার্জ কাটবে,পাবলিক ফোন ব্যবহার করতে না পরে আমার নিজের মোবাইল থেকেই ফোন দিলাম। ভাইকে বললাম আমি এসেছি। ভাই আমাকে ম্যাকডোনাল্ডস এর সামনে থাকতে বললেন। আমি সেখানে এদিকে ওদিকে বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ম্যাকডোনাল্ডস এর সামনে দাড়ালাম। সালেহ ভাই এর সাথে আমার এখন পর্যন্ত কোনদিন দেখা হয়নি। আজকেই প্রথম দেখা হবে। ভাইয়ের ফটো তো ফেসবুকে দেখেছি কিন্তু তারপরেও একটু আশংকা ছিল যদি না চিনতে পারি তবে একটু বেইজ্জতি হবে। কিছুক্ষণ পর অবাক করে দিয়ে আমার দিকে সালেহ ভাই হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো।
আমরা দুজনে মিলে প্রথমে গেলাম একটি বাংলাদেশি খাবারের দোকানে সেখানে দেখলাম এক চাচি দোকানে বসে আছেন। এবং ওনার ছেলে খাবার পরিবেশন করেন। সালেহ ভাইয়ের কাছে বাংলাদেশি যে কেউ আসলে উনি এখানে তাদের খাওয়ান। আমরা গরুর ভুনা খিচুরী খেলাম। খুব ভালো লাগলো। একদম দেশি স্বাদ। এরপর আবার আমরা মিষ্টির দোকানে গেলাম। সেখানে সালেহ ভাই মিষ্টি কিনলো। এরপর ট্রামে করে বাসায় গেলাম। মোটামুটি ভালো একটা বাসায় ভাই সাবলেট থাকেন। রোমে বাংলাদেশিদের জন্য থাকাটা একটা বড় সমস্যা। টার্মিনি থেকে আসার পথে দেখেছি অনেকেই ফুটপাথে এই ঠান্ডার মধ্যে শুয়ে আছে। ভাই বলেছিলেন ওরা অধিকাংশই বাংলাদেশি।