২০০২ সালের কথা। বুয়েটের এক হলে থাকি। কোন এক কারন বশত বেশ কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করা হল। মা, ভাই, বোন সবাই ঢাকায় থাকলেও বাবা গ্রামে থাকতেন। আমি মনস্থ করে ফেললাম অবসর এ কটা দিন গ্রামের বাড়িতে বাবার সাথেই কাটাব।
পরদিন চলে গেলাম। গ্রামে গিয়ে সব কিছু ভাল লাগলেও যুবক ছেলেদের বেকার থাকাটা আমার মোটেও ভাল লাগেনি। কাজের কথা বললে তারা ভাল চাকুরী না পাওয়ার দোহাই দিচ্ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম গ্রামের ছেলেরা যতটুকু শিক্ষিত তাতে তারা কোনভাবেই ভাল চাকুরী আশা করতে পারে না।
আমার বাবা তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন। বাবাকে আমি বললাম সরকার এ সকল ছেলেদের বিষয়ে কি কোন সুবিধা দিচ্ছে না? বাবা বললেন, সাভারে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে, তবে গ্রাম্য পর্যায়ে তেমন কোন সুবিধা সরকার দেয়নি। বাবা আমাকে জোর দিয়ে বললেন এসব ছেলেগুলোকে কোন ভাবে কাজে লাগনো যায় কি না চিন্তা করে দেখতে। বাবার ইচ্ছায় আমি আগ্রহী ১৬৮ বেকার ছেলেকে একসাথে করে একটি সমিতি করে দেই। তারা প্রতিমাসে মাত্র ১০০ টাকা করে জমা দিত। ২০০৩ সালে সময় বের করে আমি আবার গ্রামে যাই। ততদিনে তাদের সমিতির মোট টাকা হয়েছিল দুই লক্ষ টাকার উপরে।
আমি গরু, ছাগল, মাছ, মুরগী, হাস সহ সব ধরনের খামার ব্যবসার বই কিনে লাভজনক বিনিয়োগের সব খাত যাচাই করে আমাদের একটি জমিতে তাদের ছাগলের খামার করে দিলাম। ছাগল পালন খুব সহজ ও এর রোগ বালাই তেমন হয় না। একটি ছাগল বছরে দুবারে মোট ৪ টি বাচ্চা দেয়। কখনো কখনো ৩ টি করেও দেয়। বাচ্চাগুলো এক বছর পর থেকেই বাচ্চা দেয়া শুরু করে। ছাগলের দুধের চাহিদাও আছে ভাল। আমি তাদের আরো চার বছর ছাগল বিক্রয় না করে ১০০ টাকা করে কিস্তি চালু রেখে কিভাবে কি করবে তার একটি ছক করে দিলাম। বয়স্ক ছাগল বিক্রি করলেও এই টাকা লভ্যাংশ হিসেবে না নিয়ে কিভাবে ব্যবহার করবে তাও শিখিয়ে দিলাম।
আমার বাবার হার্ট এ্যটাক হলে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় চলে এলেন। আমার গ্রামে যাওয়াও একরকম বন্ধ হয়ে গেল। আমি আমেরিকা চলে আসা পর্যন্ত তাদের খামারের টোটাল সম্পত্তি ছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা (ছাগল+কোয়েল+৪ একর জায়গা+একটি পিক-আপ+অন্যান্য মিলে।) বর্তমানে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কম হবে না। ২০০৫ সালে খামার সম্প্রসারনের সময় আমি যে মেহগনি, কড়াই, সেগুন গাছগুলো লাগিয়ে এসেছি ২০২০ সালে সেগুলোর দামই হবে কম করে হলেও ২/৩ কোটি টাকা।
১৬৮ জন ছেলের ১১৪ জন সরাসরি এ খামারের উৎপাদন, সরবরাহ, ছাগল পালন, দুধ বিক্রয় ইত্যাদির সাথে জড়িত। কেউ কেউ নতুন খামার দিয়েছে শুনলাম। ছাগল পালনকে কেন্দ্র করে তাদের কয়েকজন দুধ থেকে মিস্টিজাত দ্রব্য তৈরী, কেউ কেউ গোশতের দোকান, কেউ আবার এই খামার ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে ছাগল কম মূল্যে বাচ্চা ক্রয় করে কিছুদিন লালন-পালন করে ঢাকায় সরবরাহ করা ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যবসা শুরু করেছে। অর্থ্যাৎ এই খামারের মাধ্যমে কয়েকশত যুবক বেকারত্ব থেকে বের হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এমন একটি করে খামার থাকলে দেশের বেকারত্ব ৮/১০ বছরেই শতভাগ নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে আমার বিশ্বাস। মুরগীর খামার, গরুর খামার, মাছের খামারে পরিশ্রম একটু বেশি হলেও অনেক বেশি লাভজনক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল বাংলাদেশে সরকারের উপর নির্ভর করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এখন বড় বেশি প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের। চেষ্টা করে দেখুন আপনার আবস্থান থেকে বেকারদের জন্য পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কিছু করা যায় কি না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১:২৮