শিল্পের অন্যতম একটা লক্ষ্য যদি হয় পাঠক কিংবা এর দর্শকদের মাঝে একটা ধুম্রজাল সৃষ্টি ,কিংবা কৌতুহলের আবির্ভাব ঘটানো ; আকিরা কুরোসাওয়ার এর “ রাসোমান “ সেক্ষেত্রে সফলতম সৃষ্টিগুলোর একটি ।।
১ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের এ চলচ্চিত্র কর্ম দেখার পর দর্শককে বিচারকের আসনে বসতে হয় , অনুভূতিকে জাগাতে হয় , চলচ্চিত্রে বর্ণিত সত্য উদঘাটনে । যে সত্য কিংবা যে ফলাফল কুরোসাওয়া বলে দেন নি তার গল্পে ।
রসোমান; আকিরা কুরোসাওয়ার একেবারে প্রথম সৃষ্টিগুলোর একটি । সম্ভবত সেরা সৃষ্টিগুলোর মধ্যেও অন্যতম । আকুতাগোয়ার ‘রাসোমান’ এবং ”In a Grove” এই দুটি গল্পের উপর দাঁড় করানো রাসোমনই প্রথম কুরোসাওয়ার এবং জাপানী চলচ্চিত্রকে “Western World” এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় । কাইয়েত শহরের রাসোমান গেইট এ গল্পটি বর্ণনা করা হয়েছে বলে চলচ্চিত্রটির এমন নামকরণ ।
ছবির শুরুতে আমরা রাসোমন গেইটে দাঁড়ানো তিনজন মানুষকে দেখতে পাই । ঝুম বৃষ্টির দিন । একজন ধর্মযাজক , একজন কাঠুরে এবং আরেকজন । ছবির পুরো গল্পই প্রবাহিত হয়েছে এই তিনজনের বর্ণনায় । বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল এক সামুরাই কৃষক আর তার সুন্দরী বউ । হঠাৎ তাদের পড়তে হয় দস্যু ভয়ংকর ডাকাত তাজোমারুর কবলে । তাজোমারুর লালসার শিকার হয় কৃষক বধূ । তাজোমারু কৃষককে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে । গল্পের এক পর্যায়ে কৃষক খুন হয় । কিন্তু কে তাকে খুন করলো ? দস্যু তাজোমারু ? তার স্ত্রী ? নাকি আত্মহত্যা ?
কুরোসাওয়া এবার আমাদের নিয়ে যান বিচারালয়ে । যেখানে এই তিনজন তিন রকমভাবে বর্ণনা করেন খুনের ঘটনাটিকে । অবশেষে কৃষকের মৃত আত্মাকে ডাকা হয় । সে আরেক রকমভাবে বর্ণনা করে ঘটনার । এখানেই ছবির ক্লাইমেক্স এবং পরিচালকের মুন্সিয়ানা । নির্দিষ্ট করে বোঝার উপায় নেই যে আসলে কোনটি সত্য ।
কুরোসাওয়ার গল্প বলার ধরন একেবারে আলাদা । প্রচলিত Linear বা সরলরৈখিক ধারায় গল্প বলেন না তিনি । এজন্য দর্শককে দিতে হয় শতভাগ মনোযোগ । এ মনোযোগ তিনি আদায় করতে পেরেছেন তার রাসোমানে , বলা যায় আদায় করে নিয়েছেন । সবাই পারেন না , আকিরা কুরোসাওয়ার মতোরা পারেন । তাই তাদের শিল্প হয়ে ওঠে মহৎ সৃষ্টিকর্ম ।
রাসোমানে Complexity আছে । জাপানী সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব আছে । এমনকি ভয়ংকরতম ডাকাতের একজন সাধারণ নারীর কাছে ভালবাসা ভিক্ষে করার ব্যাপার আছে । ধর্ষিতার প্রতি পুরুষসুলভ মানসিকতা আছে । পুরো ছবি জুড়ে কাজু মিয়াগায়ার অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি বেশ লক্ষণীয় । তাজোমারো চরিত্রটি অসাধারণভাবে তোশিরো মিফুনে ফুটে তুলেছেন । সামুরাই স্ত্রীর ভুমিকায় মাসিকো কেয় ছিলেন অনবদ্য । ছবির আবহ সংগীত , দৃশ্যভাবনা , কাহিনীর ভিতরে যেতে দর্শককে যেতে সাহায্য করে ।
আকিরা কুরোসাওয়ারকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম পরিচালক এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার বলা হয় । তার শিল্পে নান্দনিকতা আছে । রাসোমান তার সার্থক শিল্প । নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোরও একটি ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:৩৫