লরি কি শুধু ঘোড়াকেই ঢেকে দিয়ে গেল?
সত্যজিতের এই ছোট্ট শর্টের বিষয়বস্তু শুধু ঘোড়া আর লরির মধ্যেই রাখা যেত। কিন্তু আমরা তা রাখতে চাই না কিংবা সত্যজিতের সিনেমাটিক মুন্সিয়ানা আমাদেরকে আরো অ-নে-ক কিছু ভাবায়।
ছোট এই দৃশ্যই যেন আভাস দিচ্ছে নতুন এক যুগের। যে যুগের নাম যন্ত্র যুগ। যে সভ্যতার নাম যান্ত্রিক সভ্যতা। গ্রামের ধূলো মাখা পথে সর্বনাশা যন্ত্র সভ্যতার করাল গ্রাস যেন অনুচ্চারিত এক সত্য হয়ে দাড়িয়েছিল এ সিনেমায়।
তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘জলসাঘর’ নিঃসন্দেহে সত্যজিতের সেরা কাজগুলোর একটি। সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক ভাবেও যথেষ্ট সফল বলে সে সময়ের বক্স অফিসের হিসেব তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছিল।
ছবির পুরো কাহিনী-ই আবর্তিত হয়েছে নখ দর্পণহীন জমিদার বিশ্বম্ভর বাবুর দাম্ভিকতা ও পতনের গল্পকে ঘিরে। জমিদার বেঁচে আছেন কিন্তু জমিদারি আর নেই।
তবুও প্রচন্ড দাম্ভিক বিশ্বম্ভর রায় চূর্ণ হবেন না, বংশ আভিজাত্যের দম্ভকে টিকিয়ে রাখতে তাই তিনি বিসর্জনের নেশায় মেতেছেন। পুরো ছবিতেই সত্যজিৎ এই জমিদারের প্রতি একটু বেশিই মানবিক আর সদয় মনে হয়েছে ।
যদিও সঙ্গীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা তাকে একজন শিল্প অনুরাগী মানুষ হিসেবেই চিনিয়েছে কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে তিনি প্রজা দরদীও। কিন্তু যার এমন অহম, পতন তাঁর অনিবার্য। সে কথাই চিত্রনাট্যে ধাপে ধাপে উঠে এসেছে।
তাই দর্শকের চোখে তাঁর দম্ভ খুব একটা ধরা পড়ে না ,যেটা পড়ে সেটা হলো তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ । তবে এই বোধের চূড়াই তাঁর জন্য ডেকে আনে ভয়ংকর পরিণতি।
একজন দাম্ভিক জমিদারকে মানবিক মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারার মাঝেই সত্যজিতের সার্থকতা। এখানেই সত্যজিৎ কালজয়ী। তাই বিশ্বম্ভর বাবুর করুণ পরিণতিতে একজন মনোযোগী দর্শক হিসেবে আমাদের কাঁদতে হয়,তার প্রতি সহানুভূতির দরজা কিছুটা খুলে দিতে হয়।
এখানে কোথাও কোথাও চরিত্রগুলোকে সত্যজিতের চেয়েও অধিক বলবান মনে মনে হতে পারে। এমনটার কারণ ,তাদের চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতে পারা।
জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস । সত্যজিতের বয়ানে ‘ছবি বাবুর মতো অভিনেতা না থাকলে ‘জলসাঘর’ কে চিত্রনাট্যে রূপ দেয়া সম্ভব হতো না’।
তবে ছবির লোকেশন অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের নদী পাড়ের যে জমিদার বাড়িতে শ্যুটিং হয়েছে সেটি বড্ড বেশিই নির্জন মনে হতে পারে। বিশ্বম্ভর বাবু ঠিক কোন এলাকার জমিদার সেটি বোঝার উপায় নেই। হয়তো পরিচালক চেয়েছিলেন জমিদারে জমিদারিকে প্রধান্য না দিয়ে বরং জমিদারের মনোবিশ্লেষণ করা। তবে সেই নব্য শহুরে ধাঁচে গড়া মহিম গাঙ্গুলির বাড়িখানা দেখার আকুতি শেষ পর্যন্ত থেকেই যায় দর্শকের কাছে।
ছবির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক জমিদারিহীন জমিদারের প্রতি ভৃত্যদের অন্ধ আনুগত্য। যা তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই জলসাঘর যেন অল্প বিস্তর সেই সমাজ ও মানুষের গল্পও হয়ে ঊঠেছিল।
ছবিতে নিখাদ বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আমেজ দর্শককে অন্য এক জগতে পৌঁছে দিতে পারে অনায়াসেই। ওস্তাদ বেলায়েত খাঁয়ের সঙ্গীত পরিচালনাকে বেশ পরিমিত ও পরিশীলিত বলা যায়। কেবল কি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কত্থকের মতো ধ্রুপদী নৃত্যর অনন্য উপস্থাপনও যেন সত্যজিৎ বলেই এমন নিষ্ঠার সাথে করেছেন।
সব মিলিয়ে ছবি বাবুর অভিনয় নৈপুণ্য, চিত্রনাট্যের প্রখরতা ,সংলাপ সচেতনতা আর তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা সব কিছুর ভিতর দিয়ে জলসাঘর সত্যিই কালের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই সত্যজিতের জলসাঘর যেন কালের অনন্য এক দলিল হয়ে উঠতে পেরেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪৬