দিন তারিখ মনে নেই। হিসেব করে দেখলাম সালটা ২০০২। লেকার্স থেকে সরকারী স্কুলে নবম শ্রেণীতে আসার জন্য একটা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। রেজাল্ট আনতে গিয়েছিলাম। সে হিসেবে মাসটা হয়ত জানুয়ারী-ই হবে। হেড স্যার এর রুমের সামনে ছেলেটার সাথে আমার দেখা।সেই বিখ্যাত সাদা ইউনিফর্ম। শার্টের বুকে সবুজ স্ট্রাইপ দেখে বুঝলাম মর্নিং শিফটের-ই ছেলেটা। কিন্তু কালো রিমের চশমার মধ্যে চোখগুলো নজড় কেড়ে নিতে বাধ্য। আগ বাড়িয়ে কথা বললাম। কি বলেছি কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, ছেলেটা বলেছিল ওর নাম ‘শুভঙ্কর’ ।
আমি অদৃষ্টবাদী নই। কিন্তু শুভঙ্করের সাথে দেখা না হলে হয়ত বন্ধুত্বর পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে অজানা থেকে যেত। বাসা কাছাকাছি হওয়াতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওর সাথে একবারে বাসায় পড়ে থাকার মত সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল।
আসলে আমি অনেকটা লাকি এই অর্থে যে কলেজ লাইফটা আমরা একসাথেই কাটিয়েছি। অনেক মজার মজার স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। ফিজিক্স পড়াব বলে ওর কাছ থেকে আমি দেড় হাজার টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু পড়াতে গিয়ে দেখি যেটাই জিজ্ঞেস করে সেটাই পারিনা!আমি খালি বলি, এইসব পরীক্ষায় আসবে না।
স্কুলের শুরুর দিকে ওকে খুব রগচটা মনে হলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম শুভ আসলে খুবই শান্ত। সবকিছুকে খুব সহজভাবে মেনে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। মনে আছে একবার হোস্টেলে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মহিলা কমিশনারের মাথায় বল ফেলেছিলাম।আমাদের ছয় জনের সিট ক্যান্সেল করে দেয়া হবে বলা হয়েছিল। আমাদের সবার যখন নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে যাচ্ছিল তখনো শুভ ছিল একদম শান্ত।
আমরা যখন শুভর রুমে যেতাম তখন দেখতাম কত গুছানো! হয়ত বাবা-মা দুজনেই চাকরী করতেন বলে সে অমন স্বভাবের হয়েছে। রাখী-বন্ধনীর সময় রিপা (আমার ছোটবোন) শুভকে রাখী পড়িয়ে দিয়েছিল। আর শুভ পকেট থেকে বের করে দিয়েছিল এক বক্স চকলেট। আমি নিজে কিছুই দিইনি রিপাকে! পরবর্তীতে রিপাকে অনেকদিন পড়িয়েছিল শুভ। কাজের ফাঁকে বাড়ি গেলেই সে রিপাকে একবার দেখে আসত। চকলেট নিয়ে যেত। শুভর কোনো বোন ছিলোনা বলেই হয়ত। নিখোঁজ হওয়ার পর রিপা যতটুকু কান্না-কাটি করেছিল অতটুকু শুভর আপন বড় ভাইও করেনি।
শুভ যখন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়েছুড়ে মেরীনে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগল আমি তখন অনেক বলেছিলাম। তুলির কথা ভাবতে বলেছিলাম। সে বলেছিল, মেরীনে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চাকরী-বাকরী করে তুলিকে বিয়ে করবে!
শুভর নিখোঁজ হওয়ার দিন তুলি আমাকে ফোন দিয়েছিল।
ক্লাস শেষ করে এসেছি। হঠাত এক জুনিয়র এসে বলল, ভাই , আপনার ফ্রেণ্ড মেরীনে আছেনা? শুভঙ্কর নাম? সে নিখোঁজ। আমার এক ফ্রেন্ড একই শিপ এ কাজ করে। সে জানালো।
হঠাত করে মনে হল আমার পায়ের নিচে মাটি নেই। একের পর এক ফোন করতে লাগলাম। কিন্তু, কোথাও ভালও কোনো খবর পাচ্ছিলাম না।
সে সময়ই মেয়েটার ফোন। তুলি বলছিল, দাদা, ও আসলে বলবে আর যেন না যায়। আমি কোনোভাবে হু-হ্যা করে রেখে দেই। প্রচন্ড কষ্ট পেয়েও আমার চোখে পানি আসছিল না।
সেদিন রাতেই চলে যাই চট্টগ্রাম। খবর নিয়ে জেনেছিলাম, ঝড়ের মধ্যে ওরা কয়েকজন বন্দর থেকে জাহাজ যাচ্ছিল। ঠিকমত পৌছেও গিয়েছিল। কিন্তু শিপে ওঠার সময় ঢেউ আর আঘাতে পা-ফস্কে যায়। লাইফ জ্যাকেট পড়ার প্রটোকল থাকলেও আমার দুর্দান্ত সাহসী বন্ধুটির গায়ে ছিলনা জ্যাকেট। খনিকের জন্য ওকে দেখা গিয়েছিল। এরপরই হারিয়ে যায় ১৫-২০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের আড়ালে। আর দেখতে পায়নি কেউ।
আমি সাঁতার জানিনা। কয়েকদিন আগেই শুভ বলছিল, আমাকে সে তার কাজ করার জায়গায় নিয়ে যাবে। আমি যখন বলছিলাম, ‘পানি’কে আমার ভয় লাগে। খুব হেসেছিল আর বলেছিল, আরে গাধা, আমি থাকবো সাথে।
আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু ওর লাশ খুঁজতে। টানা ৩ দিন খোঁজার পরও পাইনি।
ছেলে হারানোর শোকই সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের! আমাকে শুভর বাবা-মার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিলনা। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল, আমাকে দেখলে হয়ত তারা সাহস পাবেন। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। ওনাদের সামনে এরপর যতবারই গিয়েছি, ঠিক করেছি এরপর আর যাবোনা। কিন্তু পারিনি।
এখনো মাঝে মাঝে তুলির সাথে কথা হয়। মেয়েটা বেশ শক্ত ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন পাগলামি শুরু করে তখন ভয় লাগতো। বেশ ভয় লাগতো!
আর আমি?
ক্ষুদ্র জীবনে যে কটি বন্ধু পেয়েছি, তাদের মধ্যে সেরা বন্ধুটিকে হারিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি-ই হয়ত কোনো পাপ করেছিলাম। যে কারণে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশীদিন টিকেনি।
শুভ নেই, এটা আমি কখনো ভাবিনি। এখনো ওর নাম্বারটা মোবাইলে আছে। কিন্তু ওই নাম্বার থেকে কোনো মেসেজ আসেনা। জন্মদিনে সবার শেষে যার মেসেজটা আসত সেটাও এখন আর আসেনা। খুব মিস করি শুভঙ্কর কে, খুব!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




