সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাসপাতালে এলাম।
একা না।বাবাও সাথে এসেছেন।তার জন্য
তাকে অফিস কামাই করতে হয়েছে আর
আমাকে করতে হয়েছে ক্লাস কামাই।
আমি রীতিমতো কিছুটা খুশি কারণ
বোরিং লেকচার শুনতে হবে না।বাবা কি অফিস
কামাই করে খুশি হয়েছেন?মনে তো হয় না।কারণ
যে ব্যক্তি অফিসে যেতে সামান্য
দেরী হলে চিতকার করে পুরো পাড়া প্রতিবেশী এক
করে ফেলেন,সেই ব্যক্তি একদিন সম্পূর্ণ অফিস কামাই
করে কিভাবে খুশি থাকেন।তবে বাবার
চোখে মুখে বিরক্তির কোন আভাস
নেই,আছে দুশ্চিন্তা।আমারও
কিছুটা দুশ্চিন্তা লাগছে তবে বাবার তুলনায়
তা নেহায়েত কম এ আমি বলে দিতে পারি।
হাসপাতাল জিনিসটাই দুশ্চিন্তার জায়গা।
সারা দুনিয়ার সব অসুস্থ মানুষের তীর্থস্থান।সকালের
দিকে ডাক্তার ফোন করে বলল আমার রিপোর্ট
নাকি উনার হাতে এসে পৌঁছেছে।তার তলবেই
এখানে আসা।প্রায়
দুঘন্টা হয়ে গেলো আমরা অপেক্ষা করছি।
এখনো ডাক্তার আঙ্কেলের দেখা পেলাম না।
চারপাশে এত রোগী!!বেলা বাড়ার
সাথে সাথে তা যেন আরো বাড়ছে।
সেইসাথে হৈচৈ,শোরগোলও বাড়ছে।কিছুক্ষন পর
একজন ওয়ার্ডবয় এসে বাবাকে বলল,"ডাক্তার
ডাকছেন।"বাবা আসছি বলে উঠে দাড়ালেন।তারপর
কিছুটা সামনে যেতেই কি মনে করে আবার
পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকালেন।
মুখে হালকা মিষ্টি হাসি রেখে বললেন,"একা একা বসে উল্টাপাল্টা কিছু
চিন্তা করিস না।দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি,তর
বাবা বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে।"প্রত্যুত্
তরে আমি হেঁসে মাথা নাড়ালাম।বাবার শেষ
জোরালো কথাটায় কেমন জানি ভরসা পেলাম।
বাবা ডাক্তার আঙ্কেলের রুমে গেলেন প্রায় আধ
ঘন্টা হতে চলল।এতক্ষন
একা একা বসে থেকে আমি একটা জিনিস আবিষ্কার
করে ফেললাম।হাসপাতাল
ে আসলে যতটা না রোগী ভিড়
করে,তারচেয়ে বেশী ভিড় করে রোগীর
এটেন্ডেন্টরা।দেখা গেল রোগী একজন কিন্তু তার
এটেন্ডেন্ট সংখ্যা দশজন।সেই
হিসেবে হাসপাতালে যদি মোট
দু'শো রোগী থাকে তাহলে এটেন্ডেন্ট এর
সংখ্যা দাড়ায় দু'হাজার!!এত এত লোক একটু একটু
কথা বললেও তো একসাথে মিলে এমনিতেই
শোরগোল হয়ে যাবে।এসব
চিন্তা করতে করতে হাতঘড়িটায় একফাঁকে চোখ
বুলিয়ে নিলাম।বাবা গিয়েছেন এখন বরাবর
একঘন্টা হয়ে গেল।আমার দুশ্চিন্তা এবার
আস্তে আস্তে মাথাচারা দিয়ে উঠছে।কোন
খারাপ কিছু নেই তো রিপোর্টে!!?সেই
ওয়ার্ডবয়কে আবার দেখতে পেলাম।আমার
কাছে আসছে।বলল,"আপনাকে স্যার
ডাকছেন।"আমি আর এক মূহুর্তও
দেরী না করে সোজা ডাক্তার আঙ্কেলের
রুমে ঢুকে গেলাম।বাইরের
গরমে বসে থাকতে থাকতে ঘামে একেবারে ভিজে গিয়েছিলাম।
দরজা খুলতেই ভেতরের এসির সমস্ত শীতল বাতাস
গায়ে এসে লাগল।ক্লান্ত শরীর তা শুষে নিতেই
মূহুর্তেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।ডাক্তার আঙ্কেল
ইশারায় বাবার পাশের চেয়ারটায় বসতে বললেন।
ডাক্তার আঙ্কেল এমনিতেই গম্ভীর থাকেন।কিন্তু আজ
আগের চেয়ে আরো বেশী গম্ভীর লাগছে।বাবার
দিকে তাকালাম।এ আমি কাকে দেখছি!!কিছুক্ষন
আগেও আমার বাবা যেমন ছিল,এখন একেবারেই
ভিন্ন।চেহারাটা কেমন যেন মলিন আর
ফ্যাঁকাসে দেখাচ্ছে।তার দিকে তাকাতেই আগের
মত মিষ্টি হাসি দেয়ার চেষ্টা করলেন।
না পেরে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন।
আমি ঘটনার আকস্মিকতায়
ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়ছি।সেই
মূহুর্তে ডাক্তার আঙ্কেল মুখ
খুললেন।"বাবা অন্তু...আমরা কে কবে এ
পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো কেউ বলতে পারিনা।
তবে এমন কিছু অসুখ আছে,যারা তাতে আক্রান্ত
হলে মৃত্যু তাদের দ্রুত গ্রাস করে নেয়।কথাটা কষ্টের
হলেও আমাকে বলতে হচ্ছে,You are suffering from Multiple
sclerosis!!And you don't have enough time my boy!!!You need to be
more strong.You need.......
বাকি কথাগুলো আর কানে যায় না।শুধু
কানে বাজতে থাকে "You are suffering from Multiple
Sclerosis and you don't have enough time!!!" মূহুর্তেই আমার
চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসে।হার্ট বিট বেড়ে যায়।
এই প্রথম আমার এত ভয় লাগছে।এই প্রথম
আমি হাসপাতালে বসে থাকতে এখন ভয় পাচ্ছি।
চারপাশের অসুস্থ মানুষগুলো যেন আমাকে ইশারায়
বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে,"You don't have enough
time!!,You don't have enough time!!!!" আমার এমন
অবস্থা দেখে বাবা আর
কান্না চেপে রাখতে পারলেন না।শক্ত মনের
মানুষটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে আমায়
বুকে নিয়ে শক্ত করে আগলে ধরে রাখলেন আর
বলতে লাগলেন,"আমার কাছ থেকে তোকে কেউ
কেড়ে নিতে পারবে না।তুই ভাল হয়ে যাবি বাপ
আমার!!তুই আগের মত সুস্থ হয়ে যাবি!!"
বাবার এই কথাটাও না আমার খুব বিশ্বাস
করতে ইচ্ছে করছিল...কিন্তু পারলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৪ ভোর ৪:০৪