‘টাইগার রা’ প্রকল্প দু’দশক ধরে ফাইলবন্দি সু্ন্দরবনে রয়েল বেঙ্গলের সংখ্যা কমছে
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
টাইগার রা প্রকল্প প্রায় দু’দশক ধরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি হয়ে থাকায় বিশ্বখ্যাত সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুরায় কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না বনবিভাগ। আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া মূল্য থাকায় সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া এখন ভিআইপি চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ১৯৮০’র দশক থেকে বাঘের চামড়া পাচার শুরু হওয়া বিদেশে রয়েছে এর প্রচুর চাহিদা। ২০০৪ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বাঘের চামড়া বনবিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রাকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান হচ্ছে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানি, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগে সাতীরা জেলার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলা। বাঘ শিকারিরা জেলে সেঁজে বন বিভাগের অনুমতি সংগ্রহ করে গভীর বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে,ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে থাকে। বাঘশিকারের পর স্থানীয় পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরে ওই চামড়া বিশেষ পদ্ধতিতে সংরণ করে লাখ লাখ টাকায় বিনিময়ে পাচারকারি চক্রের হাত বদল হয়ে পৌছে যায় বিদেশে। খুব সহসা বাঘ হত্যা হলেও এর চামড়া আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা।
২০০৩ সালের ৫ অক্টোবর খুলনার একটি হোটেল গ্লোবাল টাইগার ফোরাম (জিটিএফ)’র সভা শেষে বিশ্বের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জানানো হয়, পৃথিবীর ৪০টি দেশের কালোবাজারে বাঘের চামড়া কেনাবেচা হয়ে থাকে। পাচারকারিরা গোপনে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে বাঘের চামড়া নিয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা রাকারি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারিদের ডেরায় পৌছে দেয়। মাঝে মধ্যে এর কিছু চালান ধরা পড়ে যায়। তখনই হয় খবরের শিরোনাম।
বিগত ১৮ বছরে প্রায় শতাধিক বাঘের চামড়া আইনশৃঙ্খলা রাকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। ধরা পড়েনি পাচারকারি চক্রের সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালেরা। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক এই সকল রাঘব বোয়ালেরা তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ডের মাধ্যমে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতীরা, পিরোজপুর, বরগুনা হতে বাঘের চামড়া সংগ্রহ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক কয়েকটি অভিজাত হোটেলে বসে এসব চামড়া কেনাবেচা হয়। যেখানে পাচারকারি ছাড়াও গডফাদারদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত তাকে। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক চামড়া পাচারকারিরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে বার্মা ও ভারতে পাচার করে আর্থিক লেনদেন হয় গভীর সমুদ্রে।
সুন্দরবনের ইতিহাসে বিগত ২৭ বছরে (১৯৭৫-২০০২) বাঘ বাড়েনি, বরং আশংকাজনক হারে কমেছে। চোরা শিকারিদের তৎপরতা ও প্রাকৃতিক কারণে সুন্দরবনের প্রতিবছর গড়ে দুটি করে বাঘ মারা যায়। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অসাধু শিকারিরা ফাঁদ ব্যবহার করে কোরোফরম দিয়ে, বিষ টোপ দিয়ে এবং গুলি করে বাঘ হত্যা ঘটনা ঘটেছে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সামনে। বাঘের চামড়া, দাঁত ও হাড় বেশি দামে বিক্রি হয় বলে বাঘ শিকার করা হচ্ছে। প্রতিবছর চোরা শিকারিদের হাতে ১০-১২টি বাঘ মারা পড়ে। সুন্দরবন বনবিভাগ প্রতিবছর বাঘ হত্যার সংখ্যা ৩-৫ টি বলে জানায়। স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন তাদের নিবন্ধে উল্লেখ করেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে ১২০ টি বাঘ হত্যা হয়েছে।
সুন্দরবন বন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ি ১৯৮১-২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫৩টি বাঘ হত্যার শিকার হয়েছে। ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৭ ও ১৯৯৫ সালে সুন্দরবনে কোন বাঘ মৃত্যুর ঘটনা নেই। এছাড়া ১৯৮৩ সালে ৩টি, ১৯৮৬ সালে ২টি, ১৯৮৮ সালে ১টি, ১৯৯০ সালে ২টি, ১৯৯১ সালে ৪টি, ১৯৯২ সালে ১টি, ১৯৯৩ সালে ৪টি, ১৯৯৪ সালে ২টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ২টি, ১৯৯৯সালে ৪টি, ২০০সালে ৫টি, ২০০১ সালে ১টি, ২০০২সালে ৩টি, ২০০৩ সালে ১টি এবং ২০০৪ সালে ৪টি, ২০০৫ সালে ৬টি এবং ২০০৭ সালে ৪টি বাঘ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯৭ সালে সবচেয়ে বেশি বাঘের প্রাণহাণি হয়েছে ৮টি। বাঘ হত্যার তালিকার শীর্ষে রয়েছে চাঁদপাই রেঞ্জ। এছাড়া শরণখোলা, সাতীরা ও খুলনা রেঞ্জে বাঘ শিকারের ঘটনা ঘটেছে। বেশি বাঘের প্রাণহাণি ঘটেছে জনতার গণপিটুনিতে। এছাড়া বাঘ হত্যার পেছনে বনবিভাগের কর্মকর্তা, বাঘ বিশেষজ্ঞ ও বন সংলগ্ন এলাকার মানুষেরা আটটি কারন চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে আছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ) লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ার ফলে বাঘের লিভার সিরোসিস আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বনের ঘনত্ব কমে যাওয়া, খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ার কারনে পিটুনিতে বেশ কিছু বাঘ মারা পড়েছে। স্বভাবগত কারনে পুরুষ বাঘ কর্তৃক বাচ্চা খেয়ে ফেলা, ফাঁদ পেতে কিংবা বিষটোপ দিয়ে অজ্ঞান করার মাধ্যমে বাঘ মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। সুষ্ঠ রনাবেনের অভাব পাশাপাশি বাঘ সংরনের জন্য ১৯৯০ সালে ‘সুন্দরবন টাইগার রা প্রকল্প’ বিগত দেড়যুগ ধরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। এছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বংশবৃদ্ধির জন্য বাস্তব কোন পদপেও নেয়া হয়নি। সুন্দরবন বনবিভাগ ১৯৯০-৯১ থেকে ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদের এই প্রকল্পের ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩ হাজার টাকা ব্যয় সাপে েপ্রকল্প প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে জমা দেয়। এপর্যন্ত ওই ব্যাপারে কোন অগ্রগতির উদ্যোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমশঃ বেড়ে যাওয়ায় বাঘ হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছে। বনের ভিতরে খাদ্য সংকট ও খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়ার কারণে প্রায়ই বাঘ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাঘ শূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং সুন্দরবন বন বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৬৩ সালে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ গাই মাউন্ট ফোর্টের হিসাব মতে তখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০০টি। ১৯৭৫ সালে ইউরোপীয় বাঘ বিশেষজ্ঞ হেন্ডরিস সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শুমারী করেন। ওই শুমারীতে ওই সময় সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ছিল ৩৫০টি। ১৯৯১ সালে একটি বিদেশি সংস্থা সুন্দরবনে জরিপ চালিয়ে ৪৫৯টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করে। এরপর ১৯৯৩ সালে নেপালের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড· কে এম তামাং পরিচালিত বাঘ গনণায় ওই সময় সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ছিল ৩শ ৬২টি। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ টিসা ম্যাকগ্রেগর জানান, বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২শ’টির বেশি বাঘ নেই। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্তô জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)’র অর্থায়নে পাগ মার্ক বা পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতিতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত বাঘশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে ৪১৯টি পূর্ণ বয়স্ক বাঘ ছিল। যার মধ্যে পুরুষ ১২১টি, স্ত্রী ২৯৮টি ও বাচ্চা বাঘের সংখ্যা ছিল ২১টি। অপরদিকে ভারতের সুন্দরবন অংশে পূর্ণ বয়স্ক বাঘ ছিল ২৭৪টি। তন্মধ্যে পুরুষ ২৪৯টি ও স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ছিল ২৫টি।
তবে বিশিষ্ট প্রাণীবিদ মনিরুল এইচ খানের মতে, ক্যামেরা ট্যাপিং পদ্ধতিতে নতুন বাঘ শুমারীতে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা পাওয়া গেছে ২০০টি এবং ভারতীয় অংশে ১০০ থেকে ১৫০টি। তার মতে, পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে যে শুমারী করা হয় তাতে একই বাঘের একাধিক পায়ের ছাপ গণনায় আসার আশঙ্কা থাকে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের শরণখোলা, চাঁদপাই, খুলনা ও সাতীরা রেঞ্জে তুলনামূলক বেশি বাঘ হত্যা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৮১-১৯৯৯ সাল পর্যন্তô অবৈধভাবে ৩৩টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়
১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷
চলুন গল্পটা শুনে আসি৷
বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই
রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।
ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!
~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো
রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন