৩০।১২।২০০৯
আজকে অনেকগুলি কাজ হয়ে যাবার কথা ছিল। ঘাপলাটা বাধিয়ে দিলো মাইক্রোপিপেট। না সেটা খুঁজে পাওয়া গেল পুরানো বিল্ডিংয়ে না নতুন ভবনে। শিক্ষকদের কেউ খোঁজ জানতে পারেন। কিন্তু তারা একটা মিটিংয়ে আছেন। মুশকিলে পরলাম। ল্যাব অ্যাটেন্ডেন্ট আলি ভাই ল্যাবের কম্পিউটারে বিকট শব্দে গান ছেড়ে বসে আছেন। হৃদয় খানের গান। স্পিকার বা কম্পিউটারের কোথাও সমস্যা আছে। হৃদয় খানের গলা মহিলাদের মত শোনাচ্ছে। আলি ভাই নাঁকি সুরের গানেই অভিভূতের মত মাথা দোলাচ্ছেন। তার মনে এখন ব্যাপক শান্তি। আমি যে তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছি আমার কাজের ব্যাপারে-এটা উনি এক ধরনের উদাসীনতার সাথে ডান কান দিয়ে ঢুকিয়ে বাম কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন। একটু পর মোতালেব ভাই আসলেন। তার ঝাড়পোছের কাজ বোধহয় শেষ। এই উপলক্ষ্যে গান বদলে দিয়ে মনপুরার গান ছাড়া হল। ভলিয়্যুম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিথুয়া পাথারে নেমে বিপদে পড়েছে কেউ একজন। তার নাকি কেউ নেই। তাকে উদ্ধারের জন্যে আহবান করা হচ্ছে। আহবানের তোড়ে পুরো ল্যাব ভেসে যাচ্ছে। নাঁকি সুরের আধভৌতিক গান এখন অত্যাচার ঠেকছে। আমি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে কুটিল একটা চেহারা বানিয়ে ইতস্তত পায়চারী করছি ল্যাবের ভেতর।
.......।।....।।....।...।।......।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।
আমার মেজাজ মোটামুটি ভাল রকমের খারাপ। এখন বসে আছি জাহাঙ্গীর মামার চায়ের দোকানে। দুই কাপ চা নামিয়ে দিয়েছি। আরেক কাপ পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু রাতে ভুতের মত জেগে বসে থাকতে হবে ভেবে আর নিচ্ছি না তৃতীয় কাপটা। কার্জন হলে মিষ্টি একটা রোদ আজকে। এই রোদের ভেতর কার্জন হলের মাঠে শুয়ে থাকতে পারলে মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যেত। একটা মেয়ে কনুই ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে চিত হয়ে মাঠে শুয়ে আছে এই দৃশ্য দেখে লোকজন ভড়কে যাবে। আর আমারো আড়ষ্ট লাগবে। থাক, এই বুদ্ধি আপাতত বাদ দেই। মানুষের বেশির ভাগ ইচ্ছাগুলো পূরণ করা সম্ভব করা যায় না। এই অসম্ভবের দুনিয়া আমার তিক্ত লাগে মাঝে মধ্যে।
..।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।..।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...।।...
রেন এসেছিল কালকে। আমার ভাইয়ের মেয়ে। বয়স দুই বছর। তার অনেক নাম। আমি ডাকি ট্যামট্যামালু। আম্মা ডাকে সূর্য। মায়ের ইচ্ছা তার সূর্যের মত তেজ হোক। সেই তেজের চোটে জগত উদ্ভাসিত হয়ে যাক। আমার নানি তার এক একটা নাম দেয়। কিছু দিন পর সে নাম পালটে আরেকটা নাম রাখে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ‘তুলি’ নামটা বেশ চলছিল। তারপর তুলি হয়ে গেল ‘জুঁই’। এখন জুঁই বাদ দিয়ে তার নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘শারমিন’। কিন্তু ক্ষুদ্রাকৃতি এই ব্যক্তিত্যের আসল নাম আফরা রাইয়ান রেন। রেন একটা ছোট পাখির নাম। ইন্টারনেট আঁতিপাতি করে ঘেঁটে এই নাম রাখা হয়েছে। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই তোমার নাম কি? সে উত্তর দেয় “নেন, নেন!” “র” বলা কঠিন কাজ। আমার নিজের পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। কেউ নাম জানতে চাইলে বলতাম, “আমার নাম নিম”। যদি মন্তব্য আসত, “বাহবা, ‘নিম’ তো খুব সুন্দর নাম”, তখন আমি বিপুল বেগে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করতাম, “না, না, আমার নাম নিম না তো্, আমার নাম নিইইম, নিইইইইইম!”
ছোটবেলার স্মৃতি পরিষ্কার মনে আছে। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কেটেছে কার্জন হলে। এটা আমার জন্মস্থান। আব্বা শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর ছিলেন। সেই সুবাদে হাউস টিউটর কোয়ার্টারের দোতালায় থাকতাম আমরা। এক তালাতেও নাকি ছিলাম, তবে সেটা নাকি আমার জন্মের আগে। অনেক স্মৃতি মাথায় খেলে যাচ্ছে। পরে কোনো এক সময়ে লিখে ফেলতে হবে। স্মৃতি যে সারা জীবন নিউরনের অলিগলিতে রয়ে যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন আফসোস করতে হবে।
ট্যামট্যামালুর কথায় ফিরে আসি। এখন শীতকাল। তাকে কমলা খাওয়া শেখানো হয়েছে। শিশুদের খাওয়ানো দুরহ কাজ। আমার ভাই তার অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছে। কমলার কোয়া সূর্যের আলোয় ধরে বলা হয়েছে, “এই যে মা দেখো কি সুন্দর কমলা জ্বলে! খুব মজা, খাবে তুমি??” সূর্যালোকে প্রজ্জ্বলিত কমলা ম্যাজিকের মত কাজ করেছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে রেন দিনের বেলা ছাড়া কমলা খেতে চায় না। রাতে টিউবলাইটের আলোয় কমলা জ্বালিয়ে তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা সে মুখেও তোলে নি। অথচ দিনের বেলা সে নিজেই কমলা নিয়ে হাজির হয় তার বাবার কাছে আর বলে, “কমলা ‘জ্বলে’ দাও।” আমার ভাই তাকে তখন বারান্দায় নিয়ে সূর্যের আলোতে একটা একটা করে কমলা জ্বালিয়ে তার হাতে দেয় আর সে নির্বিকার চিত্তে কপকপ করে সেগুলো খেয়ে ফেলতে থাকে। এই হল তার কমলা বৃত্তান্ত!
মেজাজ ভালো হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের যেখানে খিটখিটে ভাব দানা বেঁধে ছিলো, সেখানে আরেকটা বোধ এসে দখল নিয়ে নিয়েছে। তার নাম খিদা। মাকে খুঁযে বের করতে হবে। সে কার্জন হলের কোথাও আছে। শীতের ছুটি চলছে। তার ক্লাস নেই। আজকে টীচারদের কি যেন একটা নির্বাচন আছে। আমার ধারণা সে কোনো নির্বাচনী আড্ডায় বসে গিয়েছে। তাকে একটা ফোন দিয়ে দেখা যেতে পারে।
পাশেই জনাকয়েক আড্ডা দিচ্ছে। তাদের আড্ডার বিষয়বস্তু “থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার”। মোস্তাফা সারোয়ার ফারুকীর নতুন ছবি। ক্ষীণ একটা ইচ্ছা ছিল ছবিটা দেখব। এদের আড্ডা থেকে শুনে ফেলেছি কাহিনী। আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সস্তা ধরনের প্লট। খেলো, ঠুনকো প্রেম খুব অপছন্দ।
মাকে ফোন দিতে হয় নি। সে নিজেই ফোন দিয়েছে। গাড়ি আসছে। ল্যাপটপ গুটিয়ে অপেক্ষা করি তাহলে। বাসায় গিয়ে নাওয়া খাওয়া সেরে ঘুম দিতে হবে। তারপর শুরু হবে কড়া এক কাপ কফি হাতে থিসিস লেখালেখির কাজ। ব্যস্ততা ভাল জিনিস। সামনের মাসে থিসিস জমা হয়ে গেলে হাঁ করে বসে থাকা ছাড়া আর কি কি করা যেতে পারে ভেবে বের করতে হবে। বেকারত্ব অসহ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০১