somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কমলা রোদের মাল্টা-১

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৫:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চারিদিক রুক্ষ। মরুভূমি মরুভূমি চেহারা। ক্যাকটাস গাছগুলো দেখিয়ে আদিবা বলেই ফেলল, ‘মনে হচ্ছে যেন সৌদি আরব চলে এসেছি’। শুনে খিক্ করে হেসে ফেললাম। টাইলসের দোকান, বিউটি পার্লার আর ইংরেজি শেখার কোচিং সেন্টারগুলোর গা ঘেঁষে প্যাঁচ খেয়ে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তার দেখিয়ে বললাম, ‘আমার তো মনে হচ্ছে পুরাই ঢাকা। ফিলিং হোমলি‘। বাকিরাও স্বীকার করে নিল, কথা মিছে নয়।

বাকিরা বলতে আদিবার মেয়ের বাপ আকরাম আর আমার ছেলের বাবা রুমি। যাদের গাঁটের পয়সার বদৌলতে এই নতুন দেশে ঘুরতে আসা। এরা এবার বেশ ঝামেলা দিচ্ছে। তাদের দাবি, আদিবা আর আমি দুইজনই যেহেতু টুকটাক চাকরি করি, তাই আমাদেরকেও এ যাত্রায় হাত খুলে খরচ করতে হবে। আমরা অবশ্য উল্টো বুঝিয়ে দিয়েছি যে বিবি-বাচ্চা নিয়ে দেশ দেশান্তরে ঘুরতে যাওয়া পরহেজগার মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। তাতে পয়সাপাতি নামক তেজপাতা যত বেরিয়ে যাবে, ঈমান তত পোক্ত হবে। কড়া এক ডোজ সবক্ দেবার পর থেকে বাবারা কেমন ঝিম মেরে চুপ হয়ে গেছে। তবে ঝিম ধরার আগে ছানা দুটোর কাঁধে তাদের মায়েদের জ্বালানোর দায়িত্ব সুচারুভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছুগুলোর কেউ ছুটে চলা মাইক্রোবাসটার জানালা খুলে বেরিয়ে যাবার ফন্দি আঁটছে। কেউ বা মিহি সুরে খুনখুন করে এই ভ্রমনের আগাম মুন্ডুপাত করছে।

এদিকে ধুলাবালির বহর দেখে আমরা কিছুটা হতাশ। এই কিনা অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপদেশ মাল্টা! দেশটা প্রায় দেড়শ বছর ব্রিটিশ কলোনিও ছিল। অতদিনের ভাঙ্গা কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কি সোজা কথা। এই ভেবে যখন স্বান্তনা খুঁজছি, তখন নীল রঙের কিসের এক ঝলক চোখে ঝাপটা মেরে গেল। গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তায় বাক নিতেই ভুমধ্যসাগর নামের নীল ময়ূর পেখম মেলে দেখা দিল। চোখ ঝলসে গেলেও ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তবে বাবাদের হাসিটা অন্য রকম। ইসকো ক্যাহেতে হ্যায় ‘প্যায়সা উসুল’ মুসকান। তাদের পয়সাটা ঠিকঠাক জলে গিয়েছি। এক্কেবারে সাগর জলে। স্রষ্টা নিজের হাতে এই দেশের চারপাশে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বালতি দিয়ে এমন মহার্ঘ্য ঢেলে দিয়েছেন যে হাজার লুটেরা মিলে লুটে নিলেও ফুরাবে না।

মিউনিখ থেকে মাল্টা মাত্র দুই ঘন্টার আকাশপথ। কিন্তু তাতেই ঘরের দরজা থেকে হোটেলের দরজা অবধি আসতে ঘড়ির কাটা সকাল আটটা থেকে ঘুরে বিকাল চারটায় এসে থেমেছে। হোটেল বললে ভুল হবে, রিসোর্ট আর কি। লবিতে দাঁড়িয়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে যাওয়া পা টান করছি। হঠাৎ পড়ন্ত বিকালের এক ফালি কমলা রোদ আমাদেরকে চটজলদি অভ্যর্থনা জানিয়ে কই যেন ফুরুৎ করে পালিয়ে গেল। আমরাও, ‘বাচ্চাদের খিদে পেয়েছে’- এই অজুহাতে চেক-ইনের লাইনে দাঁড়ানো তাদের বাবাদের হাতে পাসপোর্ট গুঁজে দিয়ে ছানা বগলে নিয়ে ভেতরের রেস্তোরা বরাবর পালিয়ে বাঁচলাম।

ধাতস্থ হয়ে একটু ঘুরে দেখলাম চারপাশটা। রেস্তোরাই তো দেখি সাত-আটটা। বুঝে নিলাম, সাগর পাড় ঘেষে শহর থেকে অনেক দূরে এই অট্টালিকা বানানোর উদ্দেশ্যটা ভীষন দুষ্টূ। লোকে বেড়াতে এসে যেন এখানেই আটকে পড়ে থাকে। সে জন্যে জায়গায় জায়গায় টোপ ফেলা আছে। সার্ফিং থেকে শুরু করে প্যারা সেইলিংয়ের সমস্ত সরঞ্জাম সাগর তীর ঘেঁষে সাজিয়ে রাখা আছে। এতো গেল রোমাঞ্চপ্রিয় লোকজনকে আটকানোর ব্যবস্থা। অ্যাডভেঞ্চার-রোমাঞ্চের নিকুচি করা লোকদের জন্যে আরেক আয়োজন। সামান্য তফাতেই সারি সারি রোদ চেয়ার। এই অলস, কুমির প্রকৃতির লোকেরা যেন তাতে গা ডুবিয়ে শুয়ে বসে মোহিতো কি মার্গারিটা টেনে আর ভাব দেখিয়ে হারুকি মুরাকামি কি পাওলো কোয়েলহো উল্টে বেলার পর বেলা কাটিয়ে দেয়। বোঝা গেল এই প্রমোদ ভবন আসলে একটা হোটেল ক্যালিফর্নিয়া। একবার ঢুকেছো তো মরেছো। ‘You can check out any time you like, But you can never leave!' ভাবতেই এখান থেকে যেকোনো প্রকারে বেরিয়ে যাবার জন্য মন আইঢাই করছে।

কিন্তু সে রাতে আর বেরোনো গেল কই। গলা পর্যন্ত বুফে ডিনারের ব্যাপক সৎকার করে একে একে সবাই পেতে রাখা রোদ চেয়ারগুলোতে গা এলিয়ে দিলাম। রোদের বদলে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো গায়ে এসে পড়ছে। পাশেই কতগুলো বিড়াল সাবধানে এসে ঘাটি গেড়েছে। তাদের কানে ছোট-বড় ফুটো। ফুটোগুলো নম্বরের কাজ করে। তার মানে এগুলো হোটেলের পোষা বিড়াল। আপাতত এদের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য নেই। দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সকল সদস্য একই রকম ভঙ্গিতে পেট ভাসিয়ে শুয়ে আছি। বিড়াল জীবনই সত্য জীবন।

পিট পিট করে চোখ মেলতেই দেখি পাম গাছটা মাথা নুইয়ে বারান্দা ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। কাছেই ঢেউয়ের শব্দ। মাল্টায় বালির সৈকত তেমন চোখে পড়ে নি। সাগরের কোল ঘেঁষে পাথুরে খাড়া পাড়। একটু এগোতেই সে চেহারা বদলে রুপ নেয় খাড়া পাহাড়ে। অদ্ভূত রুক্ষ, রুদ্র সৌন্দর্য। আছড়ে পড়া ঢেউগুলো তাতে শুধু প্রশ্রয়ই পায়, আশ্রয় আর জোটে না।

আজকের ঘোরাঘুরির ফন্দি গত রাতে আঁটা হয়ে গেছে। আজকে হবে জার্নি বাই বাস। বাস এসে রিসোর্ট থেকে তুলে নিয়ে যাবে। এগুলোকে বলে হপ অন-হপ অফ বাস। এই নাম বার কয়েক আমাদের মুখে মুখে ঘুরে শেষমেষ হিপহপে এসে ঠেকলো। সময়মত মধ্যবিত্ত চেহারার এক দোতালা বাস চলে এল। তার এখানে ওখানে রঙ চটে চটক উবে গেছে। কিন্তু আমাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। হই হই করে আমরা হিপহপ বাসে চেপে বসলাম। আদিবা-আকরামরা ছোট্ট আমালিয়াকে নিয়ে নিচে বসলো। আর আমাদের তাফসু মিয়ার বাস মাথায় তোলা চিল চিৎকারের দাপটে ছাদ খোলা দোতালায় কড়া রোদের মাঝে আচারের বয়াম হয়ে বসলাম।

মজার ব্যাপার, প্রায় আধা দিন হয়ে গেলো, কিন্তু কোনো মাল্টিজ লোকের দেখা পেলাম না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা গেল, সে এসেছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপালের মত দেশ থেকে অথবা ইউরোপের অন্য দেশ থেকে। গত রাতে তো এক বাংলা বলা আসামের লোকও পেয়েছি। হোটেলের বাবুর্চি। খুব যত্ন করে মেক্সিকান টাকো বানিয়ে দিল। আর চমৎকার উচ্চারনে বলল, ‘আরেকটা বানিয়ে দেই?’। হেসে আপত্তি জানিয়ে জানতে চাইলাম, “মাল্টার লোকজন সব গেলো কই?’। সে উত্তর না দিয়ে রহস্য করে বলল, ‘সবাই ইম্পোর্টেড’। পরে অবশ্য আরেকজনকে একই কথা পাড়তে জবাব দিল, ‘আছে তো মাল্টার লোক। ইয়া মোটা আর এই বেঁটে দেখতে। তবে ইউরোপিয়ান্দের মত সাদা। দেখবে তুমি? কালকে আমার এক মাল্টিজ কলিগ আছে। নিয়ে আসবো নে সকালে তোমার নাস্তার টেবিলে‘। সকালে অতি দ্রুততার সাথে নাস্তা করে পালিয়েছি। নইলে খাস মাল্টিজ এনে আমাকে বলা হত, ‘কি বলেছিলাম না ফর্সা, মোটা আর বাঁটকু? এবার তোমার সাধ মিটেছে?’। সেই মাল্টিজের চেহারাই বা কি হত তখন, আমিই বা কই লুকাতাম?

বাস ঢিমে তালে না চলে শাঁ শাঁ করে বাতাস কেটে চলছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় আর তার পাশে ছাত্রদের হোস্টেল চোখে পড়ল। লাল ইটের দেখে মনে হচ্ছে যেন কার্জন হলের ফজলুল হক হল। তারপর তাজ্জব বনে গিয়ে দেখলাম, লুঙ্গির মত কি একটা ঘাড়ে ফেলে কোমরে তোয়ালে পেঁচানো কেউ একজন পাট করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ব্যাপক উৎসাহে হাত নাড়ছে। পর্যটন দেশ মাল্টার পর্যটন শিল্পের সেও এক অংশীদার। হাত নেড়ে অতিথি বরন তার কর্তব্যের ভেতর পড়ে। হোক না সেটা গোসল শেষের আদুল গায়ে।

নানান জায়গায় বাস থামতে শুরু করেছে। সাথের ছোট শিশুদের কারনে দৌড়ঝাপ করে সবকিছু এক বসায় দেখে ফেলা অসম্ভব। ঠিক হল, স্লিমা (Sliema) যাব। নামটা আরবি ‘সালাম’ থেকে এসেছে। শেখান থেকে হবে জার্নি বাই বোট। ঘন্টা খানেকের নৌবিহার। এও মন্দ কি? আসন থেকে উঠে এসে চালক বাস চাপড়ে কড়া ব্রিটিশ উচ্চারনে হাঁক ছাড়ল, ‘স্লিমা এসে গেছি। কে নামবে নামো।‘ এই লোকের চোস্ত ইংরেজির অত্যাচারে কানের বারোটা বেজেছে এতক্ষন। বেচারা যেচে পড়ে শহরের বিবরণ দিচ্ছিল। এর বদলে সে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিলে চোখ বুজে জিওফ্রে বয়কটদের ভাত মেরে দিতো। যাহোক, নেমে পড়ে বাঁচলাম।
(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৫:১৬
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×