পর্ব-২
৬.
ওয়াটার পার্কের নাম শুনলেই মনে হয় দেয়াল ঘেরা বিশাল কোনো জায়গা, যার চিপা চুপায় অনেকগুলো পানির কল বসিয়ে রাখা আছে আর লোকজন তাতেই হুটোপুটি খাচ্ছে। এর মাঝে বিনোদনের কি আছে। সুতরাং, প্যাঁচা মুখ করে ঘুরছি। টেনেরিফের একেবারে উত্তর দিকে সিয়াম পার্ক নামের এই ওয়াটার পার্কে আসতে সময় লেগেছে। বাকিটা দিন মাঠে মারা যাবে মনে হচ্ছে।
আশে পাশে নানান বয়সী ছেলেবুড়ো আর বিকিনি সুন্দরীদের ভিড়। এমন নির্মল খোলামেলা পরিবেশে এসে বেশ লাগছে আমাদের দলের জনা দুয়েকের। ছেলের বাবা আর তার স্যাঙ্গাৎ আর কি। তারা আগ্রহ নিয়ে আগে আগে হাঁটছে। আমি আর আদিবা আস্তে ধীরে অলস পা ফেলছি। আজকের দলটা অসম্পূর্ন। সামান্য সর্দি-গর্মির কারনে ছোট্ট আমালিয়াকে তার বাবার জিম্মায় রেখে আসতে হয়েছে। আদিবা তাই ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু তার কপালে দু’টো ভাঁজ। ছানা রেখে এসে ঠিক স্বস্তি লাগছে না।
দলের একমাত্র শিশু তাফসু মিয়াকে দলপতি বানিয়ে তার আজ্ঞায় বাকিরা চললাম পিছু পিছু। খানিক্ষনের ভেতরেই সে তার মর্জি মত ভিজে ভূত হয়ে একটা ভেজা তোয়ালের মত হয়ে গেল। হাত চাপলেই পানি ঝরছে। তবুও থামাথামি নেই। তার ইশারায় এবার যেতে হল সৈকতের দিকটায়। একটা হোঁচটের মত খেলাম। এ যে দেখি কৃত্রিম বানিয়ে রাখা সিমেন্টের সৈকত। টেনেরিফের অমন দারুন বীচ রেখে লোকে এখানে ভিড় করছে কেন, মাথায় ঢুকলো না।
লোকের চিন্তা বাদ দিয়ে আরেক চিন্তা এসে ভর করেছে। বিশাল ঢেউ পাল তুলে হঠাৎ তেড়ে আসছে। মানুষজন আতংকে চিৎকার করছে রীতিমত। এদের পানির কল ফেটে ফুটে গেল নাকি? নইলে এমন সুইমিং পুল মার্কা জায়গায় ঢেউ আসবে কোত্থেকে? মুহূর্তের মাঝে বাবা-ছেলে বরাবর দৌড় লাগালাম। এদের কেউই সাঁতার জানে না। বড় একটা ছাতার ছায়ায় আধশোয়া আদিবা কিচির মিচির করে কি যেন বলছে। কিছুই ভাল করে কান অবধি পৌছালো না।
বারো হাত কাকুরের তেরোর হাত বিচির মত হাঁটু পানির নকল সৈকতে ঘাড় সমান ঢেউটা আছড়ে পড়ে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিলো। পুরোপুরি হতভম্ব, তবে আশ্বস্ত চোখে দেখলাম সাঁতার না জানা দু‘জন দিব্যি একজন আরেকজনের কাঁধে আকর্ন হাসি নিয়ে বসে আছে। তাদেরকে হাঁটু পানির জলদস্যুর মতই দুর্ধর্ষ লাগছে।
‘ঢেউটা তো একটা খেলা। অ্যাডভেঞ্চার ভাব আনার জন্যে একটু পর পর এরা পানির একটা তোড় ছাড়ে। আসতে আসতে খেয়াল করেন নি? বাই দ্যা ওয়ে, দৌড়টা কিন্তু সেরকম খিঁচে দিয়েছেন, হাহাহা...। ’ আদিবার একটু আগের কিচির মিচিরের অর্থ বুঝলাম এতক্ষনে।
৭.
বাকিটা বেলার পুরোটা জলে-ডাঙ্গায় কাটিয়ে যখন ফিরলাম, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দলের বাকি সদস্য আমালিয়া আর তার বাবা আকরাম এসে জুটেছে সাথে। বসেছি সেই গতকালের কাঁচা পেঁপের আলপাকা রঙের চেয়ার টেবিলেই। তবে আজকের আয়োজন অন্যরকম। মঞ্চের মত বাঁধা হয়েছে রেস্তোরাঁর পেছনের ফাঁকা জায়গাটায়। আলো-আঁধারের ঝাপসা পরিবেশ বদলে গিয়ে বল্রুমের ঝকমকে ঝালর ঝুলছে মঞ্চের ওপাশে।
হেতুটা স্পষ্ট হতে সময় লাগলো না। ফ্লামিঙ্গো নাচ হবে এখন। পুরু করে মোজ্জারেলা দেয়া পিজ্জা আর রোজমেরীর ঘ্রানে ভুরুভুর মাশরুম পাস্তার থালা ঠেলে উঠে গেলাম। একটা সম্মোহন কাজ করছে। আঁটোসাঁটো নকশা কাটা পোশাকে চওড়া কাঁধের দুইজন ভীষণ সুপুরুষের বিপরীতে টকটকে লাল গাউনে দুই অপ্সরী এগিয়ে এল। তাদের ব্লক হিল স্যু অদ্ভূত সুরে তাল তুলেছে। স্প্যানিশ গিটারের সাথে জুতার ঠকঠক যেন সঙ্গতের কাজ করছে। সেতারের সাথে যেমন তবলা।
ভাবছি,পায়ের জুতা কি হাতের গিটার, সবই তো নিষ্প্রান কাঠের। তাদের জুড়ি কি করে এমন জ্যান্ত, প্রানবন্ত হয়ে উঠছে। তালে তালে মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে মোহনীয় মুদ্রায় লাল গাউনের নাচিয়েদের ঝরে পড়া কৃষচূড়া বলে ভুল হচ্ছে। এই তাহলে ফ্লামিঙ্গো নাচ। টেবিলের থালাগুলো জুড়িয়ে যেতে দিয়ে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত হারিয়ে গেলাম সুর-তাল-লয়ের প্রলয়ে।
কড়া হাততালি দিয়ে নাচের পালার ইতি টানা হল। আমরাও খাবারগুলোর কাছে ফিরে এলাম। ঠান্ডা পিজ্জা টান দিতেই চুইংগামের মত লম্বা হতে লাগলো। তা-ই গোগ্রসে চিবিয়ে গিলে ক্ষুধার্ত পেটে পাঠিয়ে দিলাম।
বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নাচিয়ের দলটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যস্ত সমস্ত ভাব। কৌতূহলী আড়চোখে তাদের ব্যস্ততা দেখছি। একজন নর্তকীকে দাঁতের পাটি খুলে ছোট্ট একটা বাক্সে পুরে নিতে দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। আরেকজন ঘন কালো পরচুলা খুলে ভাঁজ করছে। চেপ্টে থাকা পাতলা ফিনফিনে চুল ঘেমে লেপ্টে একাকার। পুরুষদের একজন কন্ট্যাক্ট লেন্স খুলে মোটা ফেমের চশমা এঁটেছে নাকের ডগায়। পৌরুষদীপ্ত ভাবটা উবে গিয়ে তাকে স্কুলের মাস্টার মশাই লাগছে রীতিমত। সাজসজ্জার সাথে একটু আগের দারুন শোম্যানশীপও স্যুটকেসে পুরে নিল চারজনের দলটা। ঢোলা টি-শার্ট আর ভুশভুশে জিন্সে নয়-পাঁচটা চাকুরের মত হদ্দ ক্লান্ত হয়ে বিদায় নিল তারা। কে জানে আরেক রেস্তোরাঁয় গিয়ে নাচতে হবে কিনা আবার। বিচিত্র অথচ বাস্তব এক অনুভূতিতে মন ছেয়ে গেল। (চলবে)
ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ আদিবা আমাথ ও অন্তর্জাল
মিউনিখ, জার্মানি
০১.০৮.২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৫৭