৪.
দলবিহীন একলা ডাকাতকে দুর্ধর্ষ লাগে না। কেমন মিনমিনে সিধেল চোর মনে হয়। বেড়াতে এলেও দলবল লাগে। নইলে ঠিক পর্যটক পর্যটক ভাব আসে না। ভবঘুরে-ভ্যাগাবন্ড মন হয়ে বড়জোর। হোটেলে পা রাখা মাত্র আমরা তাই দল ভারী করে ফেলে জাতে উঠে গেলাম। আদিবা আর আকরাম তাদের পুঁচকে ছানা আমালিয়াকে নিয়ে আমাদেরই অপেক্ষায় বসে ছিল। শুধু বগলে জুতা চেপে ইবনে বতুতা সেজে বেরিয়ে পড়া বাকি।
ঘাড়ের বয়সী এই তরুন দম্পতির সাথে আগেও এদিক সেদিক যাওয়া হয়েছে। বছর খানেকের ছোট হলেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি বয়সের। তাই একসাথে পথ চলতে বেশ লাগে। আরেকটা ব্যাপার আছে। আদিবা-আকরামদের ভেতর বউ-জামাই ভাবটা প্রবল। আকরাম কারন ছাড়াই হম্বিতম্বি করছে তো আদিবা আবহামান বাঙালি নারীর রূপ ধরে হাসিমুখে চুপ করে আছে। আসলে এটা এক ধরনের ভেক। আদিবার সাথে থাকলে আমিও এই ভেক ধরি। ছেলের বাবাকে ইচ্ছেমত কর্তৃত্ব ফলাতে দেয়া হয়। সমস্ত সিদ্ধান্ত তাদের হাতে। বউদের এই ‘জি জাঁহাপনা’ চেহারা ভাল লাগে না, এমন বাংলাদেশি ছেলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই খোশ মেজাজের স্বার্থে তাদেরকে দিন কতকের জন্যে সিংহাসনটা ধার দিতে কোথাও বাধে না।
চোখে মুখে পানির ঝাপ্টা মেরে জাঁহাপনাদের পিছু পিছু আমরা বেগমরা বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে আবার তৈরি হয়ে নিলাম। হাতে আজকের পুরো বিকেলটা রয়ে গেছে। খরচ না করা অবধি শান্তি মিলছে না। ডেকে আনা ট্যাক্সিতে চেপে সৈকতের দিকটায় চললাম। যেতে যেতে পুরোটা সময়ে হাতের ডানের পাহাড়ের সারি হাতছানি দিয়ে ডাকলো। পাহাড়ের মাথায় ঘোলাটে মেঘের আনাগোনা। মোটামুটি বিশ্বাস হয়ে এল তার চূড়ায় বুঝি বা কোনো ডাইনি বুড়ির রাজ্য। অথচ পাহাড়ের আঁচলেই সৈকত। আর সেখানে দিব্যি আয়েশী রোদের ছড়াছড়ি। যেন পাশাপাশি দুই সমান্তরাল জগত। আলো আর আঁধারে কি অদ্ভূত হাত ধরাধরি।
সৈকতে নেমে আরেকবার চমক লাগলো। কোথায় সাগরতীর ঘেঁষা সোনার কুঁচির মত বালুর রাশি। এখানে বালু নিকষ কালো। যেন এই বালুকাবেলা পৃথিবীর কোন অংশ না। ভাড়া করা হলুদ ট্যাক্সিটা দশ ইউরোর বদলে আমাদেরকে আরেক গ্রহে পৌঁছে দিল নাকি?
আমাদের ঘোর কাটছে না। এই সুযোগে ছানা দুটো ছুট লাগিয়েছে। খোলা বেলাভূমি পেয়ে ইচ্ছেমত দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সৈকত কালো না সাদা, এ নিয়ে মাথাব্যাথা করে ফায়দা কি? তারা বরং দুহাত দু’পাশে ছড়িয়ে দৌড়ে পাখি হয়ে উড়ে যাবার চেষ্টায় মগ্ন। তবে তীর থেকে বেশ তফাতে বলে ঢেউয়ের ভয় নেই। বড়রা আমরা তপ্ত বালুতে পা ছড়িয়ে বসেছি। পাখি হয়ে আমাদের কাজ নেই। হাড়গুলো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, জিরোতে পারলে বাঁচি।
ছোট্ট একটা নোটিশ বোর্ড চোখে পড়লো এক কোনায়। কৌতূহলী হয়ে উঠে গেলাম। বালু-রহস্য বোঝা গেল এতক্ষনে। আগ্নেয়গিরির জমাট বাধা লাভা আর ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়া পাথরের কুঁচি জমে জমে এই সৈকতের সৃষ্টি। তাও ভাল, জানা গেছে। নইলে ভূতের জায়গা বলে মনে হচ্ছিল।
প্রবাসী হবার প্যারা আছে। পড়াশোনা কি চাকরি, সবখানেই একশোর উপর একশো দশ ভাগ ঢেলে দিতে হয় নিজেকে প্রমানের চেষ্টায়। তাতে জীবনের রস কিছুটা হলেও শুকিয়ে আসে। আজকে অনেকদিন বাদে শুকিয়ে আসা প্রাণটাকে সাগরতীরে বসে ইচ্ছেমত ভিজিয়ে নিলাম।
ডুবন্ত সূর্য পুরো বিকেলটা গিলে খেয়ে ঢেকুর তুলবে তুলবে করছে। আমাদেরও আমোদ একেবারে কম হয় নি। আরাম করে হাড় জিরিয়ে আর লাল-কমলা কতগুলো আইসক্রিম খেয়ে নবাবী কায়দায় সময় পার। তারপর জবজবে আঠালো হাতের তালুতে বাচ্চাগুলোকে আটকে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
এখানকার হোটেলগুলোও যেমন। যাব্বাবাহ্! কাঁচতোলা লিমুজিন গাড়ি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। সুউচ্চ দালানগুলোর গায়ে পাঁচ তারা যেন একদম ছিল ছাপ্পড় মারা। তেমনই একটা পাঁচিলঘেরা ঝাঁ চকচকে বড়লোকী হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আধা ঘন্টা লাগিয়ে অনেকগুলো ফোন খরচের পর আরেকটা লক্করঝক্কর হলুদ ট্যাক্সি জোটাতে পারলাম। তারপর ‘এই সব দামী হোটেল আসলে ভাল না, লোকে কেন যে শুধুশুধু পয়সা জলে ফেলতে আসতে’ ইত্যাদি তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথাবার্তায় নিজেদের দৈন্যতা কোনরকম ঢাকাঢুকি দিয়ে ফিরে চললাম আমাদের দুই কি তিন তারকা সস্তা হোটেলের ডেরায়। (চলবে)
ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ আদিবা আমাথ
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২০ রাত ২:৪৯