somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টেনেরিফের বতুতা বাহিনী

২০ শে জুলাই, ২০২০ ভোর ৪:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
সাল ২০১৮। মিউনিখ বিমানবন্দর। থলথলে সুখী সুখী চেহারার এক মহিলা পুলিশ দ্রুত ধেয়ে আসছে। তার চেয়েও দ্রুত হেঁটে পালিয়ে যাবো, সে উপায় নেই। এখন কি মামলা ঠুকে দেয় সেটাই দেখার বিষয়। এয়ারপোর্টে সবার সামনে মান ইজ্জত ফেঁসে শেষে কিয়েক্টা অবস্থায় দাঁড়াবে, ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে তাই ভাবছি।
‘বাচ্চাটা কি তোমাদের? ওভাবে কাঁধে নিয়েছো কেন?'
বলা মাত্র ছেলের বাবা তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে সোজা দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু ভিকটিম বাবাজী মাটিতে পা পড়ামাত্র ঈশান কোনের দিকে দিল এক ভোঁ দৌড়। সেখানে এয়ারপোর্ট পুলিশের গলফ কার্টগুলো পার্ক করা। তেমন একটা গাড়ি হাকিয়ে সে পালিয়ে যাবে, এই হল ধান্দা। এতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে পুলিশ ভদ্রমহিলা তার থলথলে শরীর বিদ্যুৎবেগে উড়িয়ে নিয়ে সম্ভাব্য গাড়ি চোর বরাবর ছুট লাগালো। মুহূর্ত আগের আসামী বাবা-মা আমরা বিনা লড়াইয়ে মামলা জিতে এবার তাড়িয়ে তাড়িয়ে চোর-পুলিশ খেলে দেখতে লাগলাম।

বেশিক্ষন মজা নেয়া গেল না। কারন, কালপ্রিট ধরা পড়ে পুলিশ আপার হাতের ফোঁকরে হাত ঝুলিয়ে পায়ে পায়ে ফিরে আসছে।
‘ছেলে তো মারাত্মক চঞ্চল। কিন্তু বকাঝকা একদম বারণ। বুঝিয়ে বলবে, কেমন? নইলে বড় হয়ে গুন্ডা টুন্ডা বনে যাবে...।’ বলেই গুন্ডা ছেলে হাতে গছিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিল তখনকার মত। চোখের আড়ালে চলে যেতেই তার শিশুপালন বিষয়ক জ্ঞান মাথা ঝাঁকিয়ে বাম কান দিয়ে বের করে আবার ছেলে কাঁধে ফেলে চেক-ইনটা কোন দিকে খুঁজতে রওনা দিয়ে দিলাম। বাঙালি বাবা-মা বলে কথা।

জার্মান সময়ানুবর্তিতা মেনে প্লেন ছাড়ল ঘড়ির কাটায়। ঘন্টা পাঁচেকের মাঝারি লম্বা ভ্রমন। মিউনিখ টু টেনেরিফে। নভেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতকে ভেংচি কেটে ইউরোপের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পালিয়ে যাচ্ছি আফ্রিকার গা ঘেষে দাঁড়ানো স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে। টেনেরিফে তারই এক দ্বীপ। মনের ভেতর জেল ডিঙ্গানো ফেরারীর আনন্দ। ভারী জ্যাকেটগুলো খুলে ওভারহেড ব্যাংকারে পুরে আরাম করে বসলাম।

‘উফ্, এ্যাইকক্...!’ শান্তিতে আর বসা গেল কই। পাজি ছেলেটা সামনের আসনের কারো চুল টেনে দিয়েছে। বছর ষাটেকের প্রৌঢ়া ঘাড় ঘুরাতে ঘুরাতে অপ্রস্তুত আমি বার দশেক ছেলের হয়ে স্যরি বলে ফেললাম। ভদ্রমহিলা হালকা হেসে, ‘আহা, ছেলেমানুষ, ইটস ওকে‘ বলে ফিরে বসলেন। তবে আরো তিন-চারবার চুলে টান খাবার পরে সেই একই ভদ্রমহিলা আমাদের মাতা-পুত্রকে একযোগে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিলেন। তারপর পাশের সিটের যাত্রীর সাথে আসন বদলে নাগালের বাইরে চলে গেলেন। বেয়ারা ছেলেটা যে কোন ফাঁকে সুযোগ কাজে লাগায়! কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। সুতরাং, ছাই ভষ্ম ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে জানালার বাইরে নির্লিপ্ত দৃষ্টি ছুড়লাম।

২.
মেঘ কেটে নেমে যাচ্ছি। আকাশী নীলের জগত থেকে সাগর নীলে নামছি যেন। আরো নামতেই আটলান্টিকের বুক গোটা আষ্টেক বড় সড় দ্বীপ আর কিছু খুচরো দ্বীপের অবয়ব ভেসে উঠল। ছোট বড় পুঁতি মিলিয়ে গাঁথা মালার মত এক সুবিশাল দ্বীপমালা। এই সব মিলিয়েই ক্যানারি আইল্যান্ড। ভূগোলের ভাষায় তাকে আদর করে ডাকা হয় ‘আর্কিপেলাগো’ বলে। তারই একটা লালচে দ্বীপ বরাবর ছুটে চলছে আমাদের বিমান।

ক্যাপ্টেন আর বিমানবালাদের তাড়ায় পড়ে সিটবেল্ট বাঁধছি। হঠাৎ মনে হল, টেনেরিফে নিয়ে অনেক আগে কোথাও কিছু একটা পড়েছি বা ডকুমেন্টরি দেখেছি যেন। ঘটনা বা দুর্ঘটনা। হাজার স্মৃতি ঘেটেও লাভ হল না। ওদিকে প্লেন নাক নামিয়ে মাটি ছুঁলো বলে। আর তখনি মনে পড়ল ব্যাপারটা।

টেনেরিফে এয়ারপোর্ট, ১৯৭৭। রানওয়েতে হালকা কুয়াশা কেটে ৭৪৭ জাম্বো জেট টেক অফের জন্যে দৌড়াচ্ছে। কেউ কিচ্ছু টের পেল না যে আরেকটা ৭৪৭ উল্টো দিক থেকে নাক বরাবর ঘন্টায় দুইশ মাইল গতি নিয়ে ছুটে আসছে। শেষ মুহুর্তের কোনো চেষ্টাই কাজে এল না। স্ফুলিঙ্গ তুলে ঘটে গেল বিমান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ছয়শ মানুষ হারিয়ে ছাই।

কাহিনী মনে পড়ার আর ভাল সময় পেল না। আমাদের রায়ান এয়ারের পলকা প্লেনটাও প্রকান্ড এক ঝাঁকি মেরে রানওয়ে ছুঁয়ে প্রায় ছেঁচড়ে যেতে থাকলো। ‘পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে, চাবুক ছুড়ে মেরেছে’ অবস্থা। অস্বস্তিতে কলিজা খামচে বসে থাকলাম।

অবশ্য মিনিট খানেক বাদেই ভয় উবে গেল। ধুলো উড়িয়ে পাগলা ঘোড়ার খুর থেমেছে। কিন্তু এ কোথায় এসে পড়েছি? চারিদিক আলোয় আলোয় ঝলসে যাচ্ছে। মিউনিখের মেঘে ঢাকা ঘোলাটে গুমোট দিন দেখে অভস্ত্য চোখে তাতানো রোদ সইছে না। পিটপিট চোখে হাতড়ে হাতড়ে বেরিয়ে আসলাম একে একে।

৩.
ভাড়া করা গাড়িটা মসৃন হাইওয়ে ধরে দুর্বার গতিতে ছুটছে। ইচ্ছে করেই হোটেল অনেক দূরে নেয়া হয়েছে। লোকালয় থেকে দূরে থাকা যাবে। হাতুড়ি বাটালি পিটিয়ে গড়া শহরে দেখার কি আছে? রঙ বেরঙের ইটকাঠ আর সুরকি ছাড়া? তার চেয়ে পাহাড়, সাগর, খোলা আকাশ ঢের ভাল। তাছাড়া, বহুদিন শীতের দেশে থেকে খানিকটা নবাব হয়ে গিয়েছি। সামান্য গরমেই ননীর পুতুল ঘেমে গলে যাই। টেনেরিফের নভেম্বরকে রীতিমত কাঠাফাটা জুলাই বলে ভুল হচ্ছে। সাগরপাড়ে হয়ত গরমটা কম হবে।

ড্রাইভার নিজে উদ্যোগে আলাপী হয়ে কথা জুড়েছে। আমরা পথের ক্লান্তিতে কুপোকাৎ। মাঝে মাঝে হ্যাঁ-হুঁ করছি ভদ্রতার খাতিরে। আর সে বকেই চলছে। পুরো ক্যানারি আইল্যান্ড নাকি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের ফল। আগ্নেয়গিরি এই দ্বীপমালাকে সাগর থেকে টেনে তুলেছে। বলা যায় না, কবে আবার আগ্নেয়গিরির মাথা বিগড়ে যায় আর দ্বীপগুলোকে গলন্ত লাভার স্রোতে তলিয়ে ফেলে। সবই প্রকৃতির লীলা। আসতে না আসতেই গরম লাভায় ডুবিয়ে মারার কথায় সামান্য চুপসে গেলাম। এ কেমন অভ্যর্থনা রে বাবা!

টেনেরিফে পেশাদার পর্যটন অঞ্চল। পাহাড়ি পথের দুপাশে ক্লাব আর অল-ইনক্লুসিভ রিসোর্টের ছড়াছড়ি। মোট কথা, প্রমোদ দ্বীপ। সেখানে ছাও-পাও নিয়ে গিয়ে কতখানি আমোদ করা যাবে, ভেবে কপালে তিন-চারটে ভাঁজ পড়লো।

প্রায় এক ঘন্টা পর হোটেলে পৌঁছে অবশ্য মুচকি হাসি ফুটলো। সামনেই উথাল পাথাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে সৈকতে। জায়গাটা কোলাহল থেকে বহু দূরে। আমোদ-প্রমোদের মত চটুল শব্দগুলো ঢেউয়ের ঝাপটায় কই যে ভেসে চলে গেলো, হদিসই পেলাম না। তাজা নোনা বাতাস নিমিষেই ক্লান্তি ঘুঁচিয়ে কর্পূরের মত উড়িয়ে দিল। দীর্ঘ যাত্রার শেষে শুরু হল আসল ভ্রমন। (চলবে)

ছবি কৃতজ্ঞতায়ঃ আদিবা আমাথ

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০২০ ভোর ৪:২৩
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মজনু নামাজ পড়ার পর মোনাজাত ধরল তো ধরলই, আর ছাড়তে চাইল না | পাক আর্মির বর্বরতা!!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭



১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি পুরো বাঙালী জাতির উপর যে নৃশংস হত্যাংজ্ঞ, বর্বরতা চালিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব দোষ শেখ হাসিনার !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৬


অনেকদিন পর zahid takes এর ডা. জাহেদুর রহমানের এনালাইসিস ভিডিও দেখলাম। জুলাই আন্দোলনের পূর্বে বিশেষত যখন র‍্যাব স্যাংশন খায় তখন থেকেই উনার ভিডিও দেখা আরম্ভ করি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুলকে ১৩ বছর পুর্তি উপলক্ষে অভিনন্দন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৭



সামুর সুসময়ের আদর্শ ব্লগারদের মাঝে মাঈনউদ্দিন মইনুল হচ্ছেন একজন খুবই আধুনিক মনের ব্লগার; তিনি এখনো ব্লগে আছেন, পড়েন, কমেন্ট করেন, কম লেখেন। গত সপ্তাহে উনার ব্লগিং;এর ১৩ বছর পুর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়তির খেলায়: ইউনুস ও এনসিপিনামা

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৪



২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান চলচ্চিত্র 'আনব্রোকেন' একটি সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, আমেরিকান বোমারু বিমানের কিছু ক্রু একটি মিশন পরিচালনা করার সময় জাপানিজ যুদ্ধ বিমানের আঘাতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×