somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আঠারো নম্বর ট্রোগার স্ট্রিট

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.
সকালের একটা রুটিন আছে। কাগজের কাপে গরম কফি আর এক টুকরো রুটি কিনতে ক্যাফেটেরিয়ায় হানা দেই। করিডোরের সেন্সর লাগানো দরজটা খুলে যায় নিচ থেকে ওপরে। গ্যারেজের দরজার আদলে। এটা হাসপাতালের ব্যাকডোর। জরুরি বিভাগের ঠিক নিচে। ঢুকলেই সাদা বিছানা চোখে পড়ে। নতুন চাদর পালটে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। পরের কোনো রোগীর অপেক্ষায়। হাসপাতালের বিছানাগুলোকে এক ধরনের পোর্টাল মনে হয়। এ যেন আরেক জগতের প্রবেশপথ। সুস্থতা থেকে জরায় আপনাকে স্বাগতম। রোগ-জরাকে পাশ কাটিয়ে কফির উষ্ণতায় ভর দিয়ে বেরিয়ে আসি। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস কেটে অফিস বরাবর হাঁটতে থাকি।

রেখস্ট ডের ইজার। মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির নিজস্ব হাসপাতাল। খুব বেশি দিন হয় নি প্যথলজি বিভাগে কাজ করি। ডাক্তার নই, তবে গবেষক। মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট। ক্যান্সারের মত অসুখ নিয়ে কাজ করলেও তাই রোগী আর তাদের বাস্তবতা যথেষ্ট দূরে। অন্তত এতদিন তাই ভাবতাম। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই হকচকিয়ে যেতে হচ্ছে।

সেক্রেটারী পেত্রা আর আমি একই অফিসে বসি। হাসিখুশি অমায়িক মানুষ পেত্রা। আজকে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রিভলভিং চেয়ারে গা ডুবিয়ে জাঁকিয়ে বসেছি। চোখে পড়লো পেত্রার টেবিলে মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগ স্তুপ করে রাখা। ইমেইল পড়তে পড়তে আলপটকা জানতে চাইলাম, ‘ওগুলো আবার কি, পেত্রা?’। রহস্যময় জবাব এল, ‘এগুলো বডি ব্যাগ। লাশ পুরে চেইন টেনে দেয়া হয়, জিইইইপ্’। শুনে আমার চোয়াল ঝুলে হাঁটুতে নেমে এল। ঘাবড়ানো চেহারা দেখে পেত্রা তাড়াতাড়ি করে ধামা চাপা দেয়ার ভঙ্গিতে বলে বসল, ‘আরে ওগুলো তো অ্যানিমেল ল্যাবের জন্যে। বড় সাইজের শুকর বা কুকুর কাটাকুটির পর মুড়িয়ে নিয়ে যাবে।‘ শুনে সরল মনে বিশ্বাস করে ফেললাম। চোয়াল আবার হাঁটু থেকে জায়গামত ফেরত এল। তবে একটা ব্যাগ নাড়াচাড়া করে মনে হল, আস্ত মানুষও প্যাকেট করে ফেলা যাবে অনায়াসে।

প্যাকেটে মোড়ানো না হলেও আস্ত মানুষের দেখা মিললও খুব শীগগিরই। তৈরি ছিলাম না ব্যাপারটার জন্যে। এক সকালে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়াশোনা করছি। দুপুরে একটা পেপার প্রেজেন্টেশন আছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স কাজে লাগিয়ে কিভাবে ক্যান্সার ডায়াগনোসিস করা যায়। নেচার জার্নালে ছাপা হওয়া খটোমটো পেপারটার ‘প’ও বুঝতে পারছি না। তাও দাঁত খিঁচে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এমন সময়ে দরজায় আলতো টোকা। কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে দেখি কালো পোশাকে জনাকয়েক অপরিচিত নারী পুরুষ। তাদের চেহারা বিধ্বস্ত। অল্পবয়সী একটা মেয়ে আবার ফুঁপিয়ে কাঁদছেও। দলের বয়স্ক ভদ্রলোক তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই রুমালে চোখ মুচছে বারবার। ঘটনা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। খানিকটা ইতস্তত করে একজন প্রশ্ন করলো, ‘আমাদের আত্মীয় মারা গেছেন গতকালকে। শেষবারের মত দেখতে এসেছি। হাসপাতাল থেকে এই সময়ে আসতে বলেছে । কিন্তু কোথায় যাবো, ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি একটু সাহায্য করতেন।‘

মুশকিলে পড়লাম। এ ধরনের ব্যাপার আমার কাজের ভেতরে পড়ে না। একে ওকে ফোন লাগিয়ে লাভ হল না। কি কারনে যেন পুরোটা দালান খা খা করছে। পেত্রাও নেই আজকে। থাকলে সে-ই সামাল দিত। চট করে মনে পড়লো, আরে নিচে তো একটা ঘর আছে। প্রেয়ার রুম। ওখানে নিয়ে যাই এদের। অফিসের সামনে জটলা না পাকিয়ে সেখানে অপেক্ষা করলেই বরং ভাল। এর ভেতর কাউকে না কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

এক পাল লোকজন নিয়ে মাইনাস টু-তে নেমে এলাম। চাবি ঘুরিয়ে পাল্লা খুলতেই জমে গেলাম মুহূর্তে। এ ঘর তো খালি নয়! শূন্য ঘরের মাঝে স্টিলের ট্রলিতে কে ওটা? চোখ সয়ে আসতেই দেখি শ্বেতশুভ্র কাপড়ে মিশরীয় মমির আদলে বুকে হাত ভাঁজ করে শুয়ে আছে সৌম্য চেহারার কে যেন। নিথর অথচ কি জীবন্ত। এতটাই জীবন্ত যে এই বুঝি ভুর কুঁচকে তাকিয়ে বলবে, ‘শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না দেখছি। আর ঘুমাবোই না, ধুর্’...। দৃশ্যটা একই সাথে সম্মোহনী আবার অসহনীয়।

কি যে ভূতে ধরলো, লোকজনকে বললাম, ‘ভেতরে একজন আছেন। একবার কি দেখবেন আপনাদের আত্মীয় কিনা?’ উত্তরে চট্ করে উঁকি মেরে দেখে নিলো অল্পবয়সী মেয়েটা। তারপর প্রবল বেগে মাথা নাড়তে থাকলো। আরেক প্রস্থ কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। ভুল লোকের কাছে ভুল পার্টি নিয়ে এসেছি তাহলে। মারাত্মক গুবলেট হয়ে গেল দেখছি। রীতিমত বিপন্ন বোধ করলাম। হাঁচড়ে পাঁচড়ে আবার ওপরে উঠে এলাম সাহায্যের আশায়। ওদিকে পিলে টিলে চমকে গিয়ে ফুসফুস-হৃতপিন্ড যে জায়গা অদল বদল করে ফেলেছে, সেদিকে গ্রাহ্য করারও সময় পেলাম না।

হঠাৎ দেবদূতের মত উদয় হল পরিচিত এক মুখ। তার পরনে পরিস্থিতির সাথে একদম বেমানান রকমের মেঝে ছোঁয়া পান্না সবুজ ইভিনিং গাউন। ‘কি, ওরা নিচে নাকি? বার বার বলেছি আমার সাথে আপয়েন্টমেন্ট নিতে। একটা প্রোটোকল আছে না!’ গজগজ করতে করতে পাঁচ ইঞ্চি উঁচু স্টিলেটো হিলে ঠক্ ঠক্ তুলে নিচে নেমে গেল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের ফ্রাউ ব্রাউনআইস। তার হাতে সব ছেড়ে ছুড়ে পালিয়ে বাঁচলাম। তবে নিচে দাঁড়ানো লোকজন ভদ্রমহিলার বেশভুষা দেখে ভড়কে না গেলে হয়।

লাঞ্চের টেবিলে ঘটনা খুলে বলতেই কলিগদের চোখ কপালে উঠল। ‘এরপর থেকে এমন হলেই ফ্রাউ ব্রাউনআইসকে ফোন লাগাবে। তার কাজই হচ্ছে মৃতদেহ সাজিয়ে গুছিয়ে আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখার ব্যবস্থা করা। এর ভেতরে আর মাথা গলিয়ো না। প্রোটোকল ভাঙ্গার ক্যাঁচালে পড়ে যাবে।‘

এক মনে শুনে গেলাম কথাগুলো। ফ্রাউ ব্রাউনআইসের পোশাক-রহস্যও বুঝলাম খানিকটা। পাতালঘরের মৃত্যুপুরীতে যার নিত্যদিনের কাজ, তাকে মনে প্রানে বেঁচে থাকতে হলে বর্ম পরে নিতে হয়। আপাদমস্তক ঢাকা জাঁকালো পোশাকগুলো আসলে তার বর্ম। ধূসর মৃত্যুর বনামে দুর্ভেদ্য রঙ্গীন ঢাল।

যাহোক, এক ঢোকে প্লেটের খাবার গিলে দারুন এক শিক্ষা নিয়ে ফিরে এলাম অফিসে। শিক্ষাটা হল, আঠারো নম্বর ট্রোগার স্ট্রিটের এই দালানে জীবিতদের সমান্তরালে নীরবে নিভৃতে মৃতরাও বাস করে। যেখানটায় বসে আছি, তার ঠিক দুই তলা নিচেই হাত ভাঁজ করে কেউ একজন শুয়ে আছে প্রিয়জনদের শেষ দেখার আশায়। সে বেলার মত কাজে মন বসানো দায় হয়ে গেল। (চলবে)

-মিউনিখ, জার্মানি

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:০৫
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×