৪.
সস্তা হোটেলের ছবি মাথায় নিয়ে এসেছিলাম। পুরু কার্পেটের মেঝে, সুউচ্চ সিলিং আর দেয়ালের ক্লাসিক পেইন্টিংগুলো দেখে উল্টো ভিমড়ি খাবার যোগাড়। হোটেল কোথায়, এ যে রাজবাড়ি। তবদা ভাঙতে না ভাঙতেই চোস্ত জার্মান জানা রিসেপশনিস্ট এসে উদয় হল। কাগজপত্র দেখেদুখে দুই মিনিটেই চাবি বুঝিয়ে দিল। চাবি তো না যেন পাথরের চাঁই। আধা কিলো ওজনের পিতলের চাবিটা হাতে নেবো নাকি পকেটে পুরবো, ভেবে না পেয়ে শেষে বিড়ালের ঘন্টার মত গলায় ঝুলিয়ে ঘর খুঁজতে রওনা দিলাম। নম্বর মিলিয়ে নব ঘোরাতেই পনেরো শতকের দরজা খুলে গেল যেন। কারুকাজ করা কাঠের পালঙ্ক, গদি আঁটা মখমলের সোফা আর বেলজিয়াম কাঁচের দেয়ালজোড়া আয়না-সব মিলিয়ে আলিশান রয়্যাল স্যুট। দেখে ইতস্তত করছি, ঠিক জায়গায় এসেছি তো?
‘হাঁ করে দেখছো কি, সরে জায়গা দাও তো আগে’। হেভি ডিউটি সুইসগিয়ার স্যুটকেসটা হাতে ফ্রান্সিসকা ঠেলেঠুলে ঘরে ঢুকে পড়লো। বুঝলাম, এই প্রাসাদ কক্ষের সেও একজন শরীক। ফ্রান্সিসকাকে আমরা ছোট করে ফ্রান্সি বলে ডাকি। লম্বা-চওড়া, নেতা গোছের ডাকাবুকো মেয়ে। ‘পর্তুগালটা একেবারে খারাপ না, কি বলো? ‘তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও, ওপেনিং সেশন ধরতে হবে’। জুতো জোড়ার দু’পাটি দু’দিকে ছুড়ে মেরে খোশমেজাজে বললো ফ্রান্সি। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ফ্রান্সির দেখাদেখি মোজা খুলে ডানে আর বামে ক্রিকেট বলের মত পাকিয়ে উড়িয়ে দিলাম। ‘পরিপাটি জার্মান মেয়ে’র বদলে নিজের মতই আগোছালো আর ছন্নছাড়া কাউকে পেয়ে অস্বস্তি হঠিয়ে মনে মনে বেশ একটা স্বস্তি পেলাম।
এলোপাথাড়ি জামা-জুতো, টুপি-মোজার প্রবল বর্ষনে একটু আগের রয়্যাল স্যুটের বারোটা বাজাতে ঠিক পাঁচ মিনিট লাগলো আমাদের। সফেদ বিছানায় এক গড়ান দিয়ে টানটান চাদরটা কুঁচকে তারও তেরোটা বাজাতে ভুললাম না। তারপর, আধখোলা ব্যাগপ্যাক আর লন্ডভন্ড স্য্যুটকেস ডিঙ্গিয়ে বগলে ল্যাপটপ, কাঁধে পোস্টার নিয়ে দু’জন দিলাম ছুট কনফারেন্স হল বরাবর।
৫.
হল ঘরের মঞ্চে বিশাল ব্যানারঃ ‘লাং সায়েন্স কনফারেন্স ২০১২’। বিজ্ঞান সম্মেলনগুলোতে উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত একটা ব্যাপার আছে। সেটা প্রকট হয় চা-বিরতিতে। হোমরা চোমরা বিজ্ঞানীদের দল তখন ইটালিয়ান মাফিয়াদের মত ঘোট পাকিয়ে ঘুরবে, চুকচুক করে কফি খাবে আর পিএইচডি ছাত্র দেখলে নাক কুঁচকে আরেকদিকে হাঁটা দিবে। মাঝেমাঝে অবশ্য বাড়াবাড়ি রকমের ইন্টালেকচুয়াল এক আধটা পিএইচডি-পোস্টডক ভাব নিয়ে মাফিয়া দলে ঝুলে থাকে। অতটা ধৈর্য্য বা শৌর্য কোনোটাই না থাকায় আমচু মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দলের বাকিরা যথারীতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। আবছা আলোর সারি সারি আসনের ভিড়ে তাদের ঠাহর করা মুশকিল। সুতরাং, সেই তো আবার দলছুট।
ঠিক এই সময়ে ত্রাতা হয়ে এগিয়ে এল প্রফেসর মরিশিও রোয়াস। ‘এ্যাই, কি খবর? ডঃ ইলদ্রিমের ছাত্র না তুমি?’ হকচকিয়ে গেলাম। মরিশিও রোয়াস আমেরিকার পিটসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পালমোনারি মেডিসিনের নামকরা অধ্যাপক। পঞ্চাশ পেড়োনো অমায়িক চেহারা। মিউনিখে আমাদের রিসার্চ স্কুলে কিছুদিন আগে লেকচার দিয়ে গেছে। তখন প্রস্ন-উত্তর সেশনে সামান্য আলাপ হয়েছিল। তবুও মাফিয়াদের একজন এগিয়ে এসে হ্যালো বললে সংশয় জাগে বই কি।
জড়তা জড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। নকল, দুই নম্বর আঁতেল সেজে হড়বড় করে বলে ফেললাম, ‘স্টেম সেল নিয়ে সেবার তোমার লেকচারটা খুব ভাল লেগেছিল। নাইস টু মিট ইউ এগেইন, প্রফেসর মরিশিও’। চওড়া হাসির সাথে জবাব এল, ‘আরে রাখো তো ওসব প্রসেফর-টফেসর। শুধু মরিশিওতেই চলবে। তা তোমার থিসিসের কাজ কেমন চলছে আর ক’টা ইঁদুর মারলে এ পর্যন্ত? হাহাহা...‘। এরপর কথা জমে যেতে আর সময় লাগলো না। মনে মনে ঠিক করলাম, বিজ্ঞানের কাঠখড় পুড়িয়ে একদিন যদি মাফিয়া বিজ্ঞানী বনেই যাই, তো মরিশিওর মত ফ্রেন্ডলি মাফিয়া হতে হবে। কুটিল, গ্যাংস্টার মাফিয়া হয়ে কাজ নেই।
৬.
এস্তোরিলের সন্ধ্যাটা টুপ করে নেমে গেল। আমাদের কনফারেন্সের পর্দাও সে বেলার মত গুটিয়ে ফেলা হল। আগামীকালের সেশনের জন্যে পোস্টার টাঙিয়ে বাকিদের সাথে ডিনারে বেরিয়ে পড়লাম। এই প্রথম চোখ মেলে এস্তোরিল দেখার ফুরসত পেলাম। কিন্তু সন্ধ্যার ঘুটুঘুটে আঁধার আর টিমটিমে ল্যাম্পপোস্ট সে আশায় জল ঢেলে দিল। শুধু বোঝা গেল, লিসবনের সাথে এস্তোরিলের একশো আশি ডিগ্রি ফারাক। অভিজাত হোটেল-দালানের ভিড় রাস্তার দু’পাশে। সাঁ সাঁই চলে যাওয়া কালো কাঁচে ঢাকা গাড়িগুলোর মডেল আন্দাজ করা যায় না এমনই সব দামী স্পোর্টস কার সেগুলো।
সব কৃত্রিমতা ছাপিয়ে অকৃত্রিম একটা নোনা বাতাস হানা দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, সামান্য দূরেই সৈকত আছে। কোস্টা ডি এস্তোরিল। আফসোস, সেখানে যাবার সময় হবে না সামনের দুই দিন। কনফারেন্সের শিডিউল ভোর থেকে রাত। তাই সমুদ্রের ঘ্রান নিয়েই খুশি থাকতে হলো।
বড় রাস্তা ছেড়ে সরু গলিতে ঢুকে পড়লাম। নোনা বাতাস তবুও পিছু ছাড়ে নি। আরো যোগ হয়েছে নীড়ে ফেরা পাখিদের কিচির মিচির। গাছে গাছে কচি পাতার নূপুর। পাতার ফাঁকে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে বোহেমিয়ান মনটা উদাস করে দিতে চাইছে খুব। অলিগলিতে না ঢুকলে বোধহয় শহর চেনা যায় না। এখানে শহর কিছুটা ‘অফ-গার্ড’ থাকে। এখানে হিসেব করে বসানো ইটকাঠের আড়ম্বর নেই, জৌলুস দেখিয়ে ভোঁ গাড়ি হাঁকানোর সুযোগ নেই। নিরিবিলির সুযোগে সন্ধ্যাটা তখন পাতার ফাঁকে চুপটি করে নেমে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
যাহোক, অনেক খুঁজে এক মাঝারি দামের পিজ্জারিয়া আবিষ্কার করে হল। হরেক রকমের পিজ্জা আর সালাদ চলে আসতে সময় লাগলো না। মুহূর্তেই বুভুক্ষের দল ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তবে জায়গাটা বড্ড অন্ধকার। আলোর ব্যাপারে এরা এত কৃপণ কেন। কি ঘরে, কি বাইরে। আর থেকে থেকে টেবিল-চেয়ারের নিচে কিসের যেন হুটোপুটির শব্দ ভেসে আসছে। বিড়াল টিড়াল হবেও বা-এই ভেবে পাত্তা দিলাম না। এদেশে এদের যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কিন্তু যেখানে বিড়াল, সেখানে যে ইঁদুরেরও আনাগোনা, তা কে জানতো।
খেয়ে দেয়ে তৃপ্তি নিয়ে ক্লান্ত পায়ে ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ মরিশিও চাপা উচ্ছ্বাসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সে বরাবরই আমাদের দলে মিশে ছিল। মরিশিওর মেলে ধরা মুঠো ফোনের অস্পষ্ট ছবিতে একটু আগের হুটোপুটি রহস্য পরিষ্কার হল। ছোট্ট কিন্তু গাট্টাগোট্টা এক ইঁদুর মশাই মুখে কামড়ে আর হাতে টেনে পাশের টেবিল থেকে রসালো এক টুকরো পিজ্জা সরাতে ব্যস্ত। অল্প আলোতে তার গোলাপি হাত দু’টো মেমপুতুলের হাত বলে ভুল হতে চায়। আর চোখ যেন কালো মুক্তার পুঁতি বসানো। সন্ধ্যা তারার মত ঝিঁকিয়ে উঠছে। ছবি তোলায় ভড়কে গিয়ে বাঁকাচোরা একটা হাসিও দিয়েছি দেখছি। ভীষন কিউট পিজ্জা চোরের রূপে সবাই একযোগে মাখনের মত গলে গেলাম। গলার সহজ কারনও আছে। দলের দশ জনের নয় জনই যে মেয়ে। দুষ্ট প্রফেসর মরিশিও বেশ দেখেশুনেই দলে ভিড়েছে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৪১