১
সাল ২০১১। মার্চ মাস।
নোটিশের কাগজটা হাতে পেয়ে ইলেকট্রিক শক খাবার মত ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। এক মাসের ভেতর হেল্মহোল্টজ রিসার্চ সেন্টারের গেস্ট ডর্মেটরি ছেড়ে দিয়ে নতুন ডেরা খুঁজে উঠে যেতে হবে। তিন মাসের বেশি বিদেশী ছাত্রদের এখানে নাকি থাকতে দেবার নিয়ম নেই। আমাকে দয়া করে আরেক মাস সময় বেশি দেয়া হয়েছে। তারপর দয়ার ভান্ড সরিয়ে ফেলা হবে। তারপর, কোন চুলোয় গিয়ে পড়ি তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা থাকবে না। কপালের ভাঁজে রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে ভর করলো।
গত মাসে তামিল ছেলে সুকুমারের তিন মাস ফুরিয়ে গেছে। ডর্মের স্টোরেজ রুমে সে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে ঠাসা স্যুটকেসটা জমা দিয়ে অর্ধেক রাত ম্যাকডোনাল্ডসে বার্গার চিবিয়ে কাটিয়েছে। আর বাকি রাতটা তাকে বাস স্টেশনের বেঞ্চিতে কাত হয়ে পার করতে হয়েছে। পরে অবশ্য এক বন্ধুর বাসায় গতি হয়েছিল।
জার্মানিতে আমার অমন বন্ধুও নেই যে বিপদে ঠাঁই দেবে। সুতরাং, শীতের রাতে ভূতের মত রাস্তায় শুয়ে বসে কাটানো না বোধহয় আর ঠেকানো যাবে না। দৃশ্যটা ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে এল। এদেশে পড়তে এসেছিলাম। কিন্তু তার বদলে বোধহয় অকূল পাথারে পড়তে যাচ্ছি। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো ডর্ম আছে বটে, কিন্তু সেখানে জায়গা পেতে নাকি দু-তিন বছর লেগে যায়। ততদিনে তো পাশ করে বেরিয়ে যাবো। তখন আর বাসা দিয়ে হবেটা কি।
তবুও এক কলিগের পাল্লায় পড়ে আবেদন একটা করেই ফেললাম। দুষ্টু কলিগ সামান্য অভিনয়ও শিখিয়ে দিয়েছে। ডর্ম অফিসে ডাক পড়লে একবারে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে নাকি কেঁদে পড়ে বলতে হবে, “জায়গা না দিলে আমি তোমাদের অফিসেই থাকা শুরু করবো। এই দেখো চাদর বিছিয়ে বিছানা পাতছি“। এই হুমকিতেও কাজ না হলে মামলার ভয় দেখাতে হবে। “বাসা খুঁজতে গিয়ে নাহক প্রচুর মানসিক ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। বিরাট ডিপ্রেশন কাজ করছে। এখন তোমাদের নামে হয়রানির মামলা করে দেবো ভাবছি”...ইত্যাদি।
দিন কয়েকের মাথায় ডাক পড়লো। কিন্তু ডাক সবারই পড়ে। খুব শিখে পড়ে গেলাম লাইনগুলো। কাঁধের ব্যাগটায় কাপড় পুরে বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এনেছি। যে কোনো মুহূর্তে ভ্যাক্ কান্নাপূর্বক অভিনয় ঝেড়ে দেবো। কিন্তু না, অবাক করে দিয়ে দশ মিনিটের মাথায় হাতে একটা জ্বলজ্বলে ঠিকানা এসে পড়লো। এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে ছুটলাম সেই ঠিকানা বরাবর।
২.
চার হাত বাই আট হাত আয়তাকার বাক্সটার ভেতর বসে ভাবছি, এই কফিনে থাকবো কি করে। দেয়ালে চারকোনা একটা ঘুলঘুলির মত আছে। ওটা নাকি জানালা। সেটা গলে এক রত্তি আলো ঘরে ঢোকার জো নেই। কবরের আঁধার বুঝি একেই বলে, বাবা রে...। আবার পাশের ঘরে কে যেন গলা ছেড়ে কার সাথে চ্যাঁচাচ্ছে। ভয়ংকর জার্মান গালিগুলো পলকা দেয়াল টপকে এদিকে উড়ে আসছে। আরো উড়ে আসছে বিচিত্র একটা ধোঁয়াটে ঘ্রান।
মানুয়েলা নামের মেয়েটা, যে কিনা মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছে, আর যার ছেড়ে দেয়া ঘরটাই আমার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে, সে এক গাল হেসে রহস্য করে বললো, “ঘ্রান নিয়ে ভাবছো? ছেলেপেলেরা মিলে একটু গাঁজা টানছে। নিত্যদিনের ব্যাপার। পার্ট অব ডর্ম কালচার, হাহা...”। বিটকেলে গঞ্জিকার যাচ্চেলে গন্ধে অস্থির আমি সেই হা হায় অংশ নিতে পারলাম না। মানুয়েলা হঠাৎ গম্ভীর মুখে বললো, “খালি উইকএন্ডে চোখ কান খোলা রাখবে। কেউ কেউ খুব ড্রিঙ্ক করে দরজায় দমাদম ঘাই দেয়। মনের ভুলে কিংবা ইচ্ছে করেই। একবার দরজা খুলে দিয়েছি আর দোতালার স্প্যানিশ ছেলেটা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ কান্নাকাটি জুড়ে দিল। পাড় মাতাল কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবে না, কেমন?“।
মানুয়েলার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কফিন-বাসা আর গাঁজাখোর প্রতিবেশী, কোনোটাতেই মন সায় দিল না। এ দেশে দেখছি ভাল বাসার বড় অভাব।
দিন কতক পর। ইন্টারনেটে এলোমেলো ঘাঁটতে গিয়ে পাওয়া এক বিজ্ঞাপনের বনামে আজকে আরেক ঠিকানা খুঁজে বাসা দেখতে এসেছি। পুরানো দালানটার বেশ বনেদী চেহারা। তিন তলার বারান্দা তো দেখছি রোদে ভেসে যাচ্ছে। নাহ্, আজকে কপালে একটা ভাল বাসা জুটেই যাবে মনে হচ্ছে। ষাট পেরোনো ভদ্রমহিলা অমায়িক হেসে দোর খুলে দিলেন।
জানালায় মোটা পর্দা ঝুলছে। ঘরের কোনায় ধীর লয়ে গান চলছে। জন লেনন নিচু স্বরে গেয়ে যাচ্ছে, “ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হ্যাভেন...”। সুবিশাল বৈঠকখানায় দেয়ালে জিম মরসনের পোস্টার। বেশ একটা সত্তরের দশকের আমেজ চারপাশে। ভালোই লাগছে এপর্যন্ত। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ২:১৩