আশিক যখন বাসা থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে তার মা আশিককে ডাকলো। "বাবা!, বাইরে যাচ্ছিস নাকি, আমার ওষুধকি আনতে পারবি?"
আশিক একটু বিরক্ত হলো। সে কোনো কথা বললো না। মেইন দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর তার মায়ের ঘরে ঢুকে তার মাকে বললো, "মা, আমি টিউশনিতে যাচ্ছি, আজ বেতন পাবার কথা, ওখান থেকে টাকা পেলে আমি ওষুধ আনবো, এছাড়া আমার কাছেতো আর কোনো পয়সা নেই।"
"তা তো জানি বাবা, আমি বুঝি তুই নিজেও অনেক কষ্টে আছিস, গত মাসে ওষুধের কথা তোকে বলিনি, কিছু টাকা নিজের কাছে ছিল সেটা দিয়ে কিনে ছিলাম।"
"আচ্ছা মা আমি আসি।"
মনে একগুচ্ছ হতাশা নিয়ে ঘর থেকে বের হলো আশিক। ঐ যে সে বিরক্ত হলো, বিরক্তটা হয়েছে তার মায়ের জন্য না, সে তার নিজের ওপরই বিরক্ত। দু'টা বছর হতে চললো সে মাস্টার্স পাশ করেছে অথচ আজো কোথাও একটা চাকরি মিললো না। মায়ের জন্য সামান্য ওষুধও কিনতে সে পারেনা, এটাই তার আফসোস, এই জন্যই সে তার নিজের ওপর বিরক্ত।
টিউশনি করাতে গেলো। সে যে স্টুডেন্টের বাসায় যায় সেই স্টুডেন্টের বাসাতেই আরো চারজন একসাথে পড়তে আসে। অর্থাৎ সে ৫জন ছাত্রকে পড়ায়। আজ তার সবার কাছ থেকেই বেতন পাবে। এতে আসিক মোটেও খুশি নয় কারণ ৫জন স্টুডেন্টের কাছ থেকে মোট পোনের হাজার টাকা পাবে। একেকটি ছাত্র তিন হাজার টাকা করে বেতন দেয়।
দুই ঘন্টা ধরে পড়ানো শেষে আশিক বসে আছে বেতনের অপেক্ষায়। ৫জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র দু'জন আজ বেতন দিলো। অর্থাৎ, ৬হাজার টাকা সে পেলো। বাকিরা বললো যে তাদের গার্জিয়ানরা আজ দিতে পারিনি টাকা, আগামীকাল বেতন দেবে। আশিকের আর কি করার আছে!! সে ঐ টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাসার কাছে একটি মার্কেট আছে সেখানের একটি ফার্মেসী থেকে সে তার মায়ের জন্য ওষুধ কিনবে, পথেই দেখা হয়ে গেলো তার বন্ধু কায়সারের সাথে। কায়সার আশিকের কাছ থেকে টাকা পায়। আশিককে টাকা ধার দিয়েছিল কারণ আশিকের চলতে কষ্ট হচ্ছিলো। আশিক টাকা ধার করেই কোনোমতে চলে। টিউশনির টাকা দিয়েতো আর চলে না। কায়সারকে কোনোভাবেই এড়ানোর উপায় ছিল না তার। কায়সার দেখা মাত্রই আশিকের কাছ থেকে টাকা চাইলো। আশিক বললো "বন্ধু, তোকে টাকাটা কাল দেই, মায়ের জন্য ওষুধ কেনা লাগবে?"
"কাল পরশু বুঝি না, তোকে এখুনি টাকা দিতে হবে, অনেকদিন হলো, আর তোকে তোর বাসাতেও পাওয়া যায়না।"
আশিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা। অবশেষে সে ৬ হাজারের মধ্যে ৪হাজার দিয়ে দিলো কায়সারকে। কায়সার ৪হাজার নেওয়ার সময় আশিককে বললো: "টাকা নেওয়ার সময় খেয়াল থাকেনা কেমনে দিবি? যাই হোক আরো বাকি আছে ১৬হাজার টাকা, আগামী মাসের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করবি!"
আশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে ফার্মেসীতে গেলো। তার কাছে বাকি ২হাজারের মধ্যে ১৫০০ টাকাই চলে গেলো ওষুধের ওপর। ওষুধ নিয়ে বাসার কাছাকাছি আসছে ঠিক তখনই কয়েকজন পুলিশ তার পথ আটকালো। ঐ পুলিশ অসিফারদের একজনকে সে চেনে যার নাম এস.আই.আকবর। এস.আই.আকবরকে দেখে আশিক বললো: "আকবর ভাই, কি অবস্থা, হঠাৎ, আপনারা।"
এখানে বলা বাহুল্য, এক পাওনাদার আশিকের কাছ থেকে ৫০,০০০ টাকা পাবে, যেটার বিপরীতে আশিক একটা চেক দিয়ে রেখেছিলো। সেই পাওনাদার সেটাকে তিনবার বাউন্স করিয়ে তার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করিয়েছে। গ্রফতারের কাজটি পড়েছিল আকবরের ওপর। তবে আকবর আশিককে আগে থেকে চিনতো দেখে সে এতোদিন সময়ক্ষেপণ করছিল। আজ এইভাবে কেনো এলো তা বুঝলোনা আশিক।
"আশিক, ভাই, উপর থেকে চাপ আসছে, আমার পক্ষে সামাল দেওয়াটা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এই দেখেননা আমার সাথে আরো কয়েকজন আসছে, আপনাকে থানায় নিয়ে যেতে হবে।"
কথাটা শুনে আশিকের মাথাটা ঘুরে দাঁড়ালো। সে সময় চাইলো, বললো তার বাড়িতে অন্তত যেতে দেওয়া হোক তার মাকে সে ওষুধগুলো দেবে।
"সেসবের কোনো সুযোগ নেই, ঠিক এই মূহুর্তেই থানায় যেতে হবে আমাদের সাথে।"
কোনো উপায় না দেখে আশিককে থানায় যেতে হলো। সারা রাত এখানেই থাকতে হবে। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তার মায়ের কি হবে, কে তার মা কে জানাবে যে তাকে যে থানায় ধরে আনা হয়েছে।
সারাটা রাত আশিক থানায় ছিল। কিছুক্ষন পর পর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছিলো। বাইরে থেকে বেশ কয়েকটি কুকুরের আর্তনাদ সে শুনতে পেলো। রাতের বেলায় কুকুরের কান্নাতো ভালো লক্ষণ নয়।
তার পরের দিন আশিককে থানা থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো হাতকড়া পড়িয়ে। নিজেকে খুব ঘৃণা করতে লাগলো সে। জামিন নিতে কোর্টে যাবে। কোর্টের বারান্দাতেই আশিকের সাথে দেখা তার বন্ধু জয়নালের। জয়নাল তার শৈশবের বন্ধুকে এইভাবে দেখে বেশ কষ্ট পেলো। আশিকের হয়েই সে মামলা থেকে আশিককে জামিন নেওয়ালো। আশিক জয়নালকে কি বলেযে ধন্যবাদ দেবে তা বুঝতে পারছিলোনা। এতো কিছু করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছে।
তার মায়ের কথা স্মরণ হলো। তার হাতে এখনো ওষুদের প্যাকেটটি রয়েছে। বাসে উঠে সে খুব ছটফট করছিলো। ১ ঘন্টার পথ অথচ মনে হচ্ছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা লাগছে পৌছাতে।
ঠিক মাগরীবের একটু পর সে বাসায় পৌছালো। দেখে লোকজনের ভীড়। তার সব আত্মীয়-স্বজনরা তার বাসাতে। সে কিছুই বুঝছিলোনা। সবাই তার বাসায় কেনো?
একজন এসে আশিককে বললো, "কোথায় ছিলে তুমি সারাটা দিন, তোমার মা ইন্তেকাল করেছেন আজ সকালে, কিছুক্ষণ আগেই তাকে দাফন করে আসলাম, তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছিলো সবাই।"
কথাগুলো আশিকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। সে মাটিতে বসে পড়লো। সে এতোটাই স্তব্ধ যে তার চোখ থেকে যে পানি পড়বে সেটাও পড়ছিলোনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:১৫