somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপন্যাসের ইমেডিয়েট ছোট ভাই কিন্তু গল্পের বড়ঃ সমালোচনা চাই।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প- এ পায়েল, প-এ পায়েল

১।
ঝপ করে পানিতে কিছু পরার শব্দ হওয়ায় দোতলার বারান্দায় এসে দাড়ালেন রেহানা। বাড়ির পুকুরটাব্যাবহার করা নিষিদ্ধ অনেক বছর যাবত। কেউ সাহস করে এই নিষেধ অমান্য করে না। গোসল করা দূরে থাক খুব একটা কেউ পুকুর পাড়েও যায় না। মাঝে মাঝে আতাউর সাহেব পুকুর পাড়টায় বসে নিরিবিলি সময় কাটান। হুকো টানেন নয়তো একলা এমনিতেই বসে থাকেন। এমনকি বাড়ির সবচেয়ে সাহসী মহিলা রেহানারও পুকুর পাড়টায় যেতে সাহস হয় না। রেহানা পুকুরটার দিকে ভাল করে তাকায়। কেউ কি ঝাপ দিল নাকি কিছু পড়ল বোঝার চেষ্টা করে। পুকুরপাড়ে অসংখ্য নারকেল গাছের সারি। গাছের জন্য পুকুরটা দেখা যায় না ভালভাবে। এক ফাঁকে যা একটু দেখা যায় শুধু পানি মৃদু ঢেউ এর সাথে চারদিকে সরে যেতে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাছ থেকে নারকেল পড়েও শব্দ হয়। তবু আজকে একটু বেশি-ই যেন শব্দ হল। কিছু বুঝতে না পেরে রেহানা ডাক দিল রসুমিয়াকে। রসু এ বাড়ির বেশ পুরানো খেদমতগার। আতাউর সাহেবের বাবা রসুকে এনেছিলেন। তারপর থেকে এ বাড়িতেই থাকে। বাড়ির প্রায় সকল দ্বায়িত্ব রসুমিয়ার ওপর। খুব বিশ্বস্থ রসুমিয়াকে মাঝে মাঝে দেনাদাররাও টাকা পয়সা দিয়ে যান আতাউর সাহেব বাড়ি না থাকলে। রেহানা রসুমিয়াকে ডাক দিলে রসুমিয়া ছুটে আসে। ওপর থেকে রেহানা বলল, পুকুর পাড়ে গিয়া দেখো তো রসুমিয়া পানিতে কেউ নামছে নাকি? কিসের যেন শব্দ শুনলাম মনে হয়।

রসু মিয়া তারাতারি পুকুর পাড়ে গেল। পাড়ের কাছাকাছি যেতেই রসুমিয়া থমকে দাড়ালো। যা দেখল তাতে রসুমিয়ার রক্ত হিম হয়ে এল। কি করবে ভেবে পেল না একমুহুর্ত। পানিতে দাড়িয়ে থরথর করে কাপছে এক যুবক আর তার দিকে বন্দুক তাঁক করে রেখেছে আতাউর সাহেব।

কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ভয়ে পরি কি মরি করে দৌড় দিল রসু। হাপাতে হাপাতে রেহানার কাছে এসে বলল, "ভাবিসাব ভাবিসাব ভাইসাবের মন মেজাজ খারাপ। মানুষ মারতেছে। হাতে বন্দুক।" এই বলে রসুমিয়া বন্দুক ধরার মত করে হাত উঁচু করল। রেহানা ভয় পেয়ে গেল 'হায় আল্লাহ! কারে মারতেছে?' বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই রেহানা ‘লা ইলাহা ইন্না আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুমতু মিনাজোয়ালিমিন’ পড়তে পড়তে নিচে নেমে পুকুর ঘাটের দিকে ছুটে গেলেন। তার এই ছুটে যাওয়া দেখে নিচতলায় মনোযোগের সাথে কুতকুত খেলতে থাকা তার ছোট মেয়ে কুসুম ও ছেলে রবিউলও মায়ের পিছু পিছু দৌড়ে পুকুর ঘাটের দিকে গেল। ততক্ষনে পুকুর ঘাটে মাঝারি আকারের একটা জটলা তৈরি হয়েছে। বাড়ি ঝি-চাকর সহ সকলেই উপস্থিত। সবাই ভয়ে অস্থির। আতঙ্কগ্রস্থ চেহাড়া নিয়ে তাকিয়ে আছে আতাউর সাহেবের দিকে। বিশেষ করে তাঁর বন্দুকটার দিকে। পানিতে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটি একটু নড়লেই 'ঐক' বলে ধমক দিচ্ছে আতাউর। পাশ থেকে কেউ একজন রেহানাকে একটু ঠেলা দিল কিছু একটা বলার জন্য। এমনি সময়ে রেহানা আতাউরকে ভয় পান না একটুও কিন্তু মেজাজ খারাপ থাকলে ঘাটায়ও না। পাশ থেকে ঠেলা খেয়ে রেহানা ভয় খেয়ে গেলেন কেননা এই মুহুর্তে আতাউর সাহেব কে কিছু বলার জন্য মুখে রা সরবে না তার। কিন্তু এখন তাকে কিছু না বললেই না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে রেহানা বললেন, "এই যে শুনছেন?" সাথে সাথে আতাউর সাহেব গর্জে উঠলেন "চুপ থাকো।" আর কিছু বলার সাহস হল না রেহানার। আতাউর সাহেবের গুলি তাক করে আছে সোজা ছেলেটার বুকের বামপাশে যেন গুলি লাগার সাথে সাথে সে ছটফটও করতে না পারে, সাথে সাথেই যাতে খতম হয়। গুলি ধরা ও করার যাবতীয় কায়দা কানুন শিখেছেন তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে। আতাউর সাহেবের বাবা ছিলেন জাদরেল মানুষ, তার তিনভাগের মাত্র একভাগ রাগ আতাউর সাহেবের মধ্যে বিরাজ করে। তাতেই এই অবস্থা!
পানিতে পড়ে থাকা ছেলেটার জন্য সবাই দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করল। সবচেয়ে উচ্চ স্বরে দোয়া পড়ছেন রেহানা। এমন সময় ছেলে রবিউল কুসুমকে জিজ্ঞেস করল "আপা ছেলেটা কি করেছে?" কুসুম বলল, "ছেলেটা চুরি করছে। বাড়ির দেয়াল টপকে চুরি করতে ঢুকেছে রান্নাঘরে। তারপর একটা প্লেট নিল ভাত খাবে। ভাত পাতে বেড়ে ফেলেছে, যেই না তরকারি বাড়তে যাবে ওমনি রান্না খালা তাকে দেখে ফেলে দিল সেই চিত্কা র। তখনি বাবা বন্দুক নিয়ে বের হল। ছেলেটা ভয়ে দিল পানিতে লাফ ।" রবিউল বলল, "তুমি কিভাবে জানলে? তুমি তো আমার সাথে খেলছিলে।" কুসুম তখন চোখ চিকন করে রবিউলকে বলল, "আমি তো তোর মত গাধা না। ভাল করে চেয়ে দেখ ছেলেটা খালি গায়ে। চোররা খালি গায়েই থাকে। আর কি শুকনা। নিশ্চই অনেকদিন কিছু খায় নি তাহলে রান্নাঘরে চুরি করতে যাবে না তো কোথায় যাবে? আর রান্না খালার চিত্কানর আমি শুনিনি তবে আন্দাজ করেছি কেননা রান্নাখালা চিত্কা র না করলে বাবা জানবে কি করে রান্নাঘরে চোর এসেছিল। বাবা তো আর রান্না খালা না যে রান্না ঘরে থাকে। তুই-ই বল বাবা কি রান্নাখালা?" রবির কাছে এটা পৃথিবীর সেরা কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর জানে না ও। তাই সে মায়ের আচল ধরে টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল ''আচ্ছা মা? বাবা কি রান্না খালা? বলো না মা বাবা কি রান্না খালা?" এই কথা রেহানার কানে পৌছালো কি পৌছালো না, কিভাবে যেন আতাউর সাহেবের কানে পৌছে গেল। তিনি পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ জোরে ধমক দিলেন ছেলেকে "চোপ"। এই ধমক শুনে ভয়ে যে যেভাবে পারল পড়িমরি করে দৌড়ে পালালো। একা রয়ে গেলেন শুধু রেহানা।

কুসুম ও রবি দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের বড় বোন পায়েলের ঘরে চলে এল। হাপাতে হাপাতে কুসুম বলল, বুবু জানো? বাড়িতে চোর এসেছে। পায়েল একটা বই পড়ছিল। একবার ও মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ে চোখ নিবেশ করল। রবি কুসুমকে বলল, "আপা বুবুকে বলো। চোর কিভাবে এসেছিল?" কুসুম বলতে শুরু করল, “বাড়ির দেয়াল টপকে চোর চুরি করতে ঢুকেছে রান্নাঘরে। তারপর একটা প্লেট নিল ভাত খাবে। ভাত পাতে বেড়ে ফেলেছে, যেই না তরকারি বাড়তে যাবে ওমনি রান্না খালা তাকে দেখে ফেলে দিল সেই চিত্কা র। তখনি বাবা বন্দুক নিয়ে বের হল। ছেলেটা ভয়ে পানিতে লাফ দিল।” রবি আবারও বলল, “আপা বুবুকে বলো তুমি কিভাবে জানলে ছেলেটা চুরি করতে এসেছিল?” রেহানা আবারও শুরু করল, “বুবু তুমি দেখলেই বুঝবে। ছেলেটা খালি গায়ে, চোররা তো খালি গায়েই থাকে। আর কি শুকনা। নিশ্চই অনেকদিন কিছু খায় নি তাহলে রান্নাঘরে চুরি করতে যাবে না তো কোথায় যাবে? আর রান্না খালার চিত্কালর আমি শুনিনি তবে আন্দাজ করেছি কেননা রান্নাখালা চিত্কাবর না করলে বাবা জানবে কি করে রান্নাঘরে চোর এসেছিল। বাবা তো আর রান্না খালা না যে রান্না ঘরে থাকে। তুমি-ই বল বাবা কি রান্না খালা?" সাথে সাথে রবিও পায়েলকে জিজ্ঞেস করা শুরু করল, "আচ্ছা বুবু। বাবা কি রান্না খালা? বলো না বুবু বাবা কি রান্না খালা?" পায়েল ঠাস করে বইটা বন্ধ করে ওদের সামনে থেকে উঠে চলে গেল।

পুকুরপারে আতাউর তেমনি বন্দুক হাতে দাড়িয়ে আছেন তার পাশেই ভয়ে অস্থির হয়ে কাচুমাচু মুখে দাড়িয়ে আছেন রেহানা। ইতোমধ্যে তিনি মনে হয় আরো বেশ কিছু বকা খেয়েছেন। আর পানিতে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা ঠিক সেভাবেই ঠক ঠক করে কাঁপছে। পায়েল ওখানে গিয়ে সবাইকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল "বাবা তোমার বন্দুকটা দাও তো গুলি ভরে আনি।" একথা শুনে একমুহুর্তে সবাই নরেচড়ে উঠল। পায়েল গিয়ে বাবার কাছ থেকে বন্দুকটা নিয়ে নিল। আর ঠিক তখনি রেহানা মুখে খৈ ফোঁটালেন। ও আচ্ছা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। পায়েল মাকে চোখ দিয়ে ইশারা করল কথা না বলতে। কিন্তু তাতে রেহানা দ্বিগুন উত্সানহ নিয়ে বলা শুরু করল, "ভাব দেখে তো মনে হয়েছে সম্রাট আকবর"। পায়েল বলল, "আহা মা চুপ থাকো তো? আর শোন তুমি বললে না, সম্রাট আকবর। আকবর কখনো বন্দুক চালান নি। ওটা ছিল তলোয়ারের যুগ।" রেহানা ঝামটা মেরে বলল, "ঐ হলো। একই কথা।" পায়েল শান্ত গলায় বলল, "তাহলে তোমরা এতক্ষন ভয় পাচ্ছিলে কেন?" রেহানা তখন থতমত খেয়ে গেল। বলল, "ভয় পাচ্ছিলাম কোথায়? সবাই তো পালিয়ে গেল। আমি একাই তো দাড়িয়ে ছিলাম বীর শাহেন শাহর সাথে।" এতক্ষনে আতাউর সাহেবের মুখে বুলি ফুটল! তিনি ইতস্তত করে বললেন, "এই শোন বাজে কথা বলবে না।" পায়েল চোখ রাঙিয়ে দুজনকে থামিয়ে দিল। তারপর পানিতে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে বলল, আপনি কি এখানে দাড়িয়ে থেকে কাঁপাকাঁপি করবেন? যান নিজের ঘরে যান। ছেলেটা পানি থেকে উঠে পায়েলের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় খানিক থামল। তারপর পায়েলকে উদ্দেশ্য করে বলল, "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হয় ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত আর সম্রাট আকবরের শাসনামল শেষ হয় ১৬০৫ সালে। তাই বলা যায় আকবরের আমলে বন্দুকের প্রচলন ছিল না। তবে এটা ঠিক প্রথম বন্দুকের প্রচলন হয় চতুর্দশ শতাব্দিতে ইউরোপে। ভারতবর্ষে এটা অনেক পরেই দেখা যায়।" তারপর আতাউর সাহেবের চোখের দিকে তাকানোর পর আর কোন কিছু বলার সাহস হল না ওর। নিজ ঘরের দিকে চলে গেল।

কুসুম ও রবিউলের গৃহ শিক্ষক হিসেবে ছেলেটিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল গতকাল রাতে। আতাউর সাহেব শিক্ষক খুজছেন খবর পেয়ে ছেলেটি রাতে দেখা করতে আসে। ছেলেটিকে বসিয়ে রেখে আতাউর সাহেব পায়েলকে ডেকে পাঠালেন। পায়েল আসলে আতাউর সাহেব বললেন, “কুসুম রবির শিক্ষক হিসেবে সে কেমন একটু দেখ তো।” পায়েল অবাক হয়ে বলল, “এখানে দেখার কি আছে বাবা?” আতাউর সাহেব বিরক্ত হলেন। বললেন, “যা করতে বলেছি কর, ভাইভা নে।” পায়েল বলল, “ ভাইভা নেওয়ার কি আছে? আমি ভাইভা নিতে পারব না।” একথা শুনে আতাউর সাহেব চোখ বড় করলেন। তারপর বললেন, “তাহলে তুই আমার পাশে বস, আমি ভাইভা নেই।” পায়েল ভ্রু কুচকে বসে রইল। একজন গৃহ শিক্ষক রাখতে ভাইভার কি প্রয়োজন এটা তাঁর মাথায় ঢুকল না। পড়াতে পারে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। পড়াতে পারলে থাকবে নাইলে বিদায় হবে। সোজা হিসাব। আতাউর সাহেব একে একে প্রশ্ন করছেন, তোমার নাম কি?
ছেলেটি হাসি হাসি মুখ করে উত্তর করল, আমার নাম কাজল।
আগে পিছে কিছু নাই?
জ্বি না।
কি পাশ?
এম এ।
এম এ পাশ করে বাড়ি বাড়ি গিয়া পড়াও কেন? চাকরী করতে পার না?
পায়েল এমন সময় বাঁধা দিল। “আহ বাবা। এসব কি প্রশ্ন?”
আতাউর সাহেব পায়েলের কথা কান দিয়ে ঢুকালেন না। আবারও বললেন, এম এ পাশ করে বাড়ি বাড়ি গিয়া পড়াও কেন? চাকরী করতে পার না?
জ্বি আমি এখনও চাকুরী পাই নি।
পাইলে চলে যাবা?
জ্বি।
যদি কালকেই তোমার চাকরী হয় কালকেই চলে যাবা?
কাজল কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
তারপর-পরই কাজল কে গৃহ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন আতাউর সাহেব। কুসুম ও রবিউল আগে ভাগে ঘুমিয়ে যাওয়ায় তারা তাদের গৃহ শিক্ষকের কথা জানত না। রাতে রসুমিয়া কাজলকে থাকার ঘর দেখিয়ে দিল। রান্নাঘরের পাশেই দু ঘরের একটি টিনশেডের পুরানো বাড়ি। এ দু ঘরের একটাতে থাকে রসুমিয়া, অন্যটাতে জায়গা হল কাজলের।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কাজল ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের দিকে গেল। পিচিক করে বেশ কয়েকবার মুখ থেকে ছাই ফেলল পুকুরের পানিতে। ঠিক তখনি নিচ তলার বারান্দায় বসে সকাল বেলার মিষ্টি হাওয়া খাচ্ছিলেন আতাউর সাহেব। একসময় তাঁর চোখ পড়ল কাজলের ওপর। কাজলের এই পিচিক পিচিক করে ছাইয়ের থুথু পুকুরে ফেলা দেখে রেগে গেলেন তিনি। দৌড়ে ঘর থেকে বন্দুক এনে তাড়া করলেন কাজলকে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কাজল পড়ে গেল পুকুরে। একটা ডুব দিয়ে উঠে দেখে আতাউর সাহেব বন্দুক ঠিক তাঁর দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল কাজল। কোন মসিবতের জায়গায় এসে পড়ল ও কে জানে?


২।
পুকুর পাড় থেকে ফিরে এসে ঘরে বসে বসে এক হাতের আঙ্গুলের সাথে আরেক হাতের আঙ্গুল বারবার মেলাচ্ছেন আতাউর। পাশে বসে রেহানা ভ্রু কুচকে আতাউর সাহেবের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পান বানাচ্ছেন। হঠাৎ করে আতাউর সাহেব হাঁক ছাড়লেন, “রসুমিয়া, রসুমিয়া?” রসুমিয়ে দৌড়ে দরজার বাইরে এসে দাড়ালো, “জ্বি ভাইসাব?” আতাউর সাহেব একটু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, “মাস্টারের একটু যত্ন আত্মী করো।” এ কথা শুনে রেহানার চোখ কপালে উঠল। বোঝা গেল না হয়ত রসুমিয়ারও একই অবস্থা হল। তিনি বললেন, “শোন শীতের দিনে অনেক্ষন ছেলেটা পানিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ঠান্ডা টান্ডা লেগে যাবে। ঔষুধ পত্র খাওয়াইও। বুঝছো?” শেষের বুঝছো কথাটা একটু জোরেই বলল আতাউর সাহেব। রসুমিয়া বলল, “যত্নের কোন ত্রুটি হবে না। আমি ইতোমধ্যে উনাকে গরম পানি দিয়েছি গোছল করার জন্য।” আতাউর সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ে গেল এমন ভাবে বলল, “আর হ্যা শোন, ওকে বাড়ির নিয়ম কানুন বুঝিইয়া দিবা। পুকুরে থুথু, পানের পিক ফেলা এমনকি গোছল করাও নিষেধ।” রসুমিয়া “আচ্ছা” বলে চলে গেল। আতাউর সাহেব রেহানার সাথে কোন কথা বলছেন না। রেহানাও চুপচাপ। তিনি পান বানিয়েই যাচ্ছেন। আজকে তাঁর পান বানানো শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিকেলে কুসুম ও রবিউল পড়তে গেল কাজলের ঘরে। কুসুম চোখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে। সকালে আত্মবিশ্বাসের সাথে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো ভুল প্রমাণিত হওয়ায় এখন একটু চুপচাপ হয়ে গেছে ও। আন্তাজে কথা বলার স্বভাব কুসুমের। তবে তাঁর প্রেক্ষিতে যুক্তি দাড় করাতেও সময় লাগে না ওর। বিশেষ করে কিশোর উপন্যাস ও গোয়েন্দা বই পড়ে পড়ে এই অবস্থা। অবশ্য ব্যাপারটা যে খুব খারাপ তাও না। রবিউলকে ও বারবার করে অনুরোধ করে এনেছে যেন সে স্যারের সামনে চোরের ঘটনাটি না বলে দেয়। রবিউল সহজ সরল ছেলে। কুসুমের সাথে তাঁর ভাবই আলাদা। তবুও কুসুম একটু ভয় পাচ্ছে যদি রবি সব বলে দেয়!
কাজল পড়ার টেবিলে বসে ছিল। কুসুম আর রবি ঘরে গেলে ও ওদের দেখে হালকা হাসল। বলল, “কি নাম তোমাদের?” রবি তৎক্ষণাৎ উত্তর করল, “আমার নাম রবিউল।” কুসুম চুপ করে আছে। ওর চুপ করে থাকা দেখে রবিউল আঙ্গুল দিয়ে কুসুমকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওর নাম কুসুম আপা।”
কাজল হাসল। বলল, “বসো তোমরা। তুমি কোন ক্লাসে পড় রবিউল?” রবিউলের মনে হল ও কুসুমের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। খুশি হয়ে গেল রবিউল। বলল, “আমি ক্লাস টু তে পড়ি।” কাজল এবার কুসুমের দিকে তাকালো, “তুমি?” কুসুম চুপ করে রইল। রবিউল বলল, “ও ক্লাস সিক্সে পড়ে।”
“আচ্ছা” বলে কাজল রবির বই খোলা শুরু করল। কুসুম ওর বই বুকের সাথে ধরে রেখেছে। টেবিলের ওপর রাখছে না। রবি এটা দেখে কুসুমের হাত থেকে বই নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দাঁত বের করে হাসল। কাজল বলল, “কি হয়েছে কুসুম? তোমার কি মন খারাপ?” কুসুম মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কোন কথা বলল না। রবি বলল, “হ্যা ওর মন খারাপ।” কুসুম তৎক্ষনাৎ রবির দিকে তাকিয়ে ঠাস করে রবির গালে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। বলল, “তুই এত কথা বলিস কেন? আমি কথা বলতে পারি না? আমার মুখ নাই?” কাজল রবিকে টেনে নিজের কাছে এনে বসালো। রবির চোখে পানি আসতে গিয়েও আসল না। কাজল বলল, “ছিঃ কুসুম, এমন করেছো কেন?” কুসুম কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে রবিকে কাজলের কাছ থেকে টেনে নিয়ে আদর করে দিল। দুই ভাই বোনের কান্ড দেখে না হেসে পারল না কাজল। ও হা হা করে হেসে দিল। সাথে সাথে কুসুম আর রবিও হেসে ফেলল। তখন কুসুমের মনে হল কাজল স্যার পৃথিবীর সেরা ভাল ছেলে। না, তাঁর আগে ভাল ছেলে হচ্ছে রবি। রবিউল পৃথিবীর সেরা ভাল ছেলেমানুষ, কাজল স্যার পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা ভাল ছেলেমানুষ আর ওদের বাবা পৃথিবীর তৃতীয় সেরা ভাল ছেলেমানুষ। এতদিন বাবা ছিল দ্বিতীয় এখন বাবার স্থান দখল করেছে কাজল স্যার। কঠিন প্রতিযোগীতা। তবে রবিউলকে কেউ হারাতে পারবে না এ ব্যাপারে মুটামুটি নিশ্চিত কুসুম। পৃথিবীর সেরা মেয়ের তালিকার শীর্ষে আছে পায়েল বুবু। এখানে পায়েল বুবুর একার আধিপত্য, কেননা কুসুমের ধারণা মা এখনো এই প্রতিযোগীতায় অংশই নেই নি। অংশ নিলে বলা তো যায় না মা বুবুকে হারিয়ে দিয়ে একেবারে প্রথম স্থানে চলে আসতে পারে।
পড়া শেষ করে কাজল একটু বাইরে যায়। ঘরে তখনো বসে থাকে কুসুম আর রবি। রবি জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তাদের দোতলা বাড়ির এক কোণায় বুবুর ঘর। বুবুর ঘরের একটা জানালা দেখা যায় এ ঘর থেকে। রবি খেয়াল করে জানালার ধাঁরে বসে আছে পায়েল। কি যেন পড়ছে বসে বসে। বিকেলের রোদ এসে পড়েছে পায়েলের মুখে। রবির কাছে মনে হল তাঁর বুবু পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়ে। রবি কুসুমকে বলল, “দেখো আপা, বুবুকে কি সুন্দর লাগছে।” কুসুম জানালার ধাঁরে এগিয়ে যায়। পায়েলের ঘরের জানালার পানে তাকায়। কুসুমেরও মনে হয় সত্যিই তো বুবুকে অপূর্ব সুন্দরী লাগছে। তাদের বুবু দেখতে যে এত সুন্দর সেটা মনে হয় এই প্রথম আবিস্কার করল দু-ভাই বোন।

চলবে......

দ্বিতীয় পর্ব এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৫১
২২টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×