প-এ পায়েল, প-এ পায়েল!!!
এখানে দ্বিতীয় পর্ব পড়িয়া নিন, নইলে খেই হারায়ে ফেললে লেখক দায়ী নন।
৪।
পুকুর পাড়ে বসে হুকো টানছেন আতাউর সাহেব। তাঁর পাশেই উবু হয়ে বসে আছে রসুমিয়া। আরাম করে হুকো টানার সময় আতাউর খুব একটা কথা বলেন না। রসুমিয়াও এ সময় আতাউর সাহেবকে বিরক্ত করতে চায় না। তবে রসুমিয়া আতাউর সাহেবের বিশ্বস্থ লোক। তাঁর নিজের দেখা কিছু ঘটনা আতাউর সাহেবকে না বললে বড্ড বেশি নেমকহারামী হয়ে যায়। ঘটনার সামর্ম বলে রসুমিয়া অপেক্ষা করছেন তাঁর করনীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পাওয়ার। আতাউর সাহেব হুকো ছেঁড়ে রসুমিয়ার দিকে তাকালেন। বললেন,
জামা কাপড় কিনে দিতে বলেছে?
জ্বি ভাইসাব। জামা আর প্যান্ট।
কয় সেট?
বলেছেন আপাতত দুই সেট।
সে কি করে জানল তাঁর জামা কাপড় নাই?
আমি জানি না ভাইসাব। বললেন যে এত শীতের মধ্যেও বাড়ির একটা লোক খলি গায়ে ঘুড়ে বেড়ায় দেখতে কটু লাগে। মনে হয় তাঁর জামাকাপড় নাই। টাকা দিচ্ছি দুই সেট জামা প্যান্ট কিনে দিও।
কত টাকা দিল?
পাঁচশ।
পাঁচশ তে হবে?
হবে মনে হয়।
আতাউর সাহেব পকেটে হাত দিলেন। পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে রসুমিয়ার হাতে দিলেন। বললেন,
এই নাও পাঁচশ। একহাজার টাকায় হয়ে যেতে পারে।
জ্বি আচ্ছা। এই বলে রসুমিয়া চলে যাচ্ছিলেন। আতাউর সাহেব ডাক দিলেন,
আর শোনো।
জ্বি।
মাস্টারকে বলবা না যে পায়েল এগুলা কিনে দিয়েছে। ar তাঁর দিকে খেয়াল রাখবা, পায়েলের সাথে যেন বেশি কথা বার্তা না বলে। জোয়ান ছেলে ঘরে রাখা ঠিক না। তাও ছেলে-মেয়ে দুইটার জন্য রাখা।
না ভাইসাব। ছেলে ভাল। তেমন কোন আচরণ কখনো চোখে পড়ে নি।
তোমার চোখে পড়ে নি, তবে তোমার ভাবিসাবের চোখে তো ঠিকই পড়েছে। কাল নাকি দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ হাসাহাসি করতেছিল?
আমি দেখিনি।
হুম। পায়েল মাস্টারের কাছ থেকে কি বই ও যেন নিয়েছে।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন আতাউর সাহেব। তারপর বললেন, মেয়ে আমার বড় হয়েছে চোখে পরে নাই। ভার্সিটিতে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। এত্তবড় হয়ে গেছে কখন জানলামও না।
রসুমিয়া একটু হাসল। আতাউর সাহেবও হাসলেন। তারপর বললেন,
একবার কদম ঘটককে খবর দিও তো, আমরা দেখতে থাকি। সুপাত্র পেলে ছাড়ব কেন, তাই না?
জ্বি। ঠিকই বলেছেন। গাও গেরামে এর চাইতেও ছোট মাইয়া বিয়ে দিয়ে দেয়।
আতাউর সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হলেন। বললেন,
নাহ। মাস্টারের দিকে নজর রাইখো। কাল তোমার ভাবিসাব ওদেরকে একসাথে দেখছে আর আজকে তোমাকে পায়েল টাকা দিয়েছে মাস্টারের জন্য জামা কাপড় কিনার। নজর একটু রাখা দরকার।
জ্বি আচ্ছা।
রসুমিয়া চলে গেলে আতাউর সাহেব আবারো হুকোতে মনোনিবেশ করলেন।
রাতে খাবার পাতে বসেছে বাড়ির সবাই। আতাউর সাহেব মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছেন। দু মেয়ের মধ্যে অনেক তফাত। বয়সেরও অনেক ফারাক। বড় মেয়েটা সাধারণত বেশ চুপচাপ থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে না। ছোটবেলা থেকেই একরকম। পড়াশুনায় মনোযোগী বরারবের মত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে থাকতে চেয়েছিল। মেয়েকে না দেখে থাকতে পারেননা আতাউর। হলে দেননি। এতদূর পথ মেয়েটা গাড়িতে করেই যাওয়া আসা করে। প্রথম প্রথম নিজেই পায়েলকে আনা নেওয়া করলেও, পরবর্তিতে শুধুমাত্র মেয়ের প্রয়োজনেই গাড়ি কিনেন আতাউর সাহেব। তাঁর নিজের ব্যাবসাপাতি বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় কখনো গাড়ির প্রয়োজন হয়নি। মেয়েটার ভার্সিটিতে যাতায়াতের কথা চিন্তা করেই গাড়ি কিনেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ে তাঁর এতটুকু বদলায় নি। নিজের গন্ডির ভিতরেই তাঁর বসবাস। সময়মত ক্লাসে যায়। আবার ঠিকঠিক ফিরেও আসে। বাড়তি এক দু ঘন্টা বন্ধুদের সাথে কথা বলেও কাটায় না। এত কম কথা বলা মেয়েটার সাথে কারো ভাব গড়ে উঠতে পারে এটা বিশ্বাস হতে কষ্ট হয় আতাউর সাহেবের। পরক্ষনেই এই চিন্তা ঝেরে ফেলে দেন তিনি। ভাবেন, মাস্টারের সাথে একদিন কথা বলেছে বলে কি সব আজে বাজে চিন্তা করছেন তিনি। মাস্টার শিক্ষিত মানুষ। হয়তো কোন পড়াশুনার বিষয়েই তাদের কথা হয়েছে। আর একটা মানুষের পরনের জামা না থাকলে তো সেটা কিনে দেওয়াই উচিত। তেমন কোন বিশেষ তাগাদা থাকলে নিশ্চই নিজেই কিনতে পারত রসুমিয়াকে কিনতে দিত না। এ আর এমন কিছু না। তাঁর পরপর-ই মুখে হাসি ফুটে ওঠে আতাউর সাহেবের। ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, “কুসুম মামুনি, মাস্টার পড়ায় তো ভাল?”
কুসুম একগাল হেসে বলল, “হুম খুব ভাল পড়ায়।”
রবি পড়া শিখে তো?
সাথে সাথে রবি উওর করল। আমি পড়া শিখি প্রতিদিন। কাজল স্যার বলেছেন আমি ভাল ছাত্র।
আতাউর হেসে উঠেন। খেয়াল করেন রবির কথা শুনে পায়েলও হাসছে। তাঁর মেয়েটার হাসি যে এত সুন্দর তা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন।
রাতের খাওয়া শেষ করে পায়েল নিজের রুমে চলে এল। আইন-ই-আকবরি বইটা এখন পর্যন্ত একবারও খুলে দেখা হয় নি। পায়েল বইটা নিয়ে বসল। মলাট এখনো বেশ নতুন। যে বইটা তিনবার পড়া হয়ে গেছে একজনের তা এত নতুন থাকে? নিজের বইয়ের সেলফের দিকে তাকালো পায়েল। তখন ওর মনে হল নাহ নতুনই থাকে। ওর বুক সেলফের সবকয়টা বই-ই বেশ যত্নে রাখা। ওগুলো তো শুধু একবার নয় সারা বছরে বেশ অনেকবারই পড়া হয়ে থাকে। নিজের মনেই হাসল পায়েল। ছেলে মানুষ আবার গোছালো হয় নাকি! কি মনে করে পর্দা উল্টিয়ে একবার দেখল কাজলের ঘরটা। জানালাটা বন্ধ। ভাবল, হয়তো ঘরে ঠান্ডা ঢুকবে বলে জানালাটা বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু হঠাত্ ই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায় ওর।
আতাউর ও পায়েলের দুটি ঘর বাড়ির ঠিক দু প্রান্তে অবস্থিত। পায়েল ইচ্ছে করেই এ ঘরটা বেছে নিয়েছে থাকবে বলে। ওর বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এ ঘরটা তালা বন্ধই দেখে আসছে। একদিন বাবাকে বলেছে ঘরটা ওর জন্য খুলে দিতে। দক্ষিনমুখী এ ঘরটাতেই থাকবে বলে জানায় ও। একবার আপত্তি করেছিলেন আতাউর কিন্তু মেয়ের আবদার ফেলার মত কঠিন তিনি নন। তাই খুলে দিয়েছেন। সুন্দর ছিমছাম ঘর। বিছানা, টেবিল চেয়ার
আলমারি সবকিছুই আছে। তবে সাজানো গোছানো এ ঘরটায় তালা মেরে রাখার কারণ ও কখনো বোঝে নি। ঘরে একটা আলাদা করা আলমারিও আছে তালাবদ্ধ। এটার চাবি থাকে আতাউর সাহেবের কাছে। বাবার প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র এখানে রাখা ভেবে কখনো এটা নিয়ে আলাদা কোন কৌতুহল হয় নি পায়েলের।
রেহানা ক্যাট ক্যাট করছে সারাদিন। আতাউর সাহেবের ওপর তার যাবতীয় ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলার সময় যেন এখনি। এত দূরত্বেও ওর ঘরে বসেই মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছে পায়েল। মায়ের চেঁচামেচি কি নিয়ে তা বুঝতেও ওর অসুবিধা হচ্ছে না। পায়েলের বিয়ে নিয়ে কেন ভাবছেনা আতাউর তাই নিয়ে রেহানার যত ক্ষোভ। পায়েল শুনতে পেল মা বলছে, কেমন বাপ আপনি? মেয়ের বিয়ে দিতে চান না। ওর বয়সী এ বংশে আর কোন মেয়ে আছে নাকি? ওর ছোট গুলোরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর আপনি কিনা ঘরে বসে আছেন। পাত্র তো আর পায়ে হেটে বাড়ি আসবে না। আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা কামালেই হয় না। মাথা অন্য সব দিকেই খাটাতে হয়। পায়েলের আবারো মন খারাপ হয়ে যায়। মা এভাবে কেন বলছে? ওর কি বিয়ের খুব বেশি বয়স হয়ে গেছে? পায়েল আবারো শুনল মা বলছে, আমি বাবা কুসুম কি নিয়ে এত আহ্লাদ করতে পারব না। ও মেট্রিক পাশ করবে সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দিব। আরো যদি পড়তে হয় জামাই বাড়ি গিয়ে পড়ো। পায়েল মনটা খট করে উঠল। মা ওকে আর কুসুমকে আলাদা করছে কেন। ওকে কি কেবল বাবাই ভালবাসে। মা কি ওকে ভালবাসে না। কিন্তু মায়ের আচরনে এমনটা কখনো লক্ষ্য করেনি পায়েল। ছোটবেলায় তো মা ওকে ঠিকই খাইয়ে দিত। চুলে বেনী করে দিত। মাঝেসাঝে একটু বকাঝকা করত কিন্তু মা-রা এমনটা করে থাকে আর এমনিতেই তো পায়েলের মা একটু বেশি রাগী। পায়েল মাথা থেকে কথাগুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইল। জানালার ধারে গিয়ে বসল ও।
মন ভালো করার মত একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। পায়েল আকাশপানে চেয়ে রইল অপলক চোখে। মন ভালো করা চাঁদটা কতটুকু ওর ভালো করতে পেরেছে বোঝা গেল না। কেননা ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা। হয়তো ও নিজেও জানে না কেন এই অশ্রু, কিসের জন্য।
জানালা খুলে কাজলও বসেছে চাঁদ দেখতে। চাঁদ দেখা ওর একটি প্রিয় কাজ। আকাশে চাঁদ উঠলে ও কখনই গৃহবন্দী থাকে না। তা সে চাঁদ যেমনি হোক। চাঁদ দেখতে বসে আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে কাজলের চোখ আটকে গেল পায়েলের জানালার দিকে। বিষাদ দৃষ্টিতে চাঁদ দেখছে মেয়েটা। একসময় কাজলের মনে হয় পায়েল ভীষন কষ্টে আছে। এত সুন্দর একটা মেয়ের মধ্যে কি কষ্ট থাকতে পারে ভেবে পেল না ও। হঠাত্ করেই নিজের
মধ্যেই বিষন্নতা অনুভব করে কাজল। চাঁদ দেখার ইচ্ছে বোধহয় এই প্রথমবারের মত মরে যায়। অপলক নয়নে ও শুধু তাকিয়ে থাকে পায়েলের দিকে।
চোখের পানি মুছে পায়েল জানালার ধার থেকে উঠতে যেয়ে কাজলের জানালার দিকে চোখ পড়ে ওর। কাজল ঠিক ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এক মুহুর্ত থমকে যায় পায়েল। ভাল করে তাকায় কাজলের দিকে। পায়েল তাকিয়ে আছে দেখেও কাজল চোখ সরালো না। বিষয়টা কি বোঝার জন্য জানালা থেকে সরে গিয়ে ঝটকা টানে পর্দা টেনে দিল পায়েল। তারপর চুপি চুপি পর্দাটা একটু সরিয়ে দেখল পায়েল। বেচাড়া কাজল নড়েচড়ে উঠেছে। এভাবে ঠাস করে পর্দা পড়বে ভাবতে পারেনি ও। তারপর দ্রুত জানালা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল কাজল। দৃশ্যটি দেখে খিলখিল করে হেসে ফেলল পায়েল।
চলবে.......[/sb
চতুর্থ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





