বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা ও এর ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমানো। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মাপকাঠিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং অসংখ্য জনজীবন হারাতে হয়। এ কারনে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অন্যতম চাহিদাময় বিষয় হচ্ছে দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়াবলী। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবমুখী ও গবেষণা নির্ভর দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। তেমনই একটি কোর্স হচ্ছে CERG-C, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনায় সুইজারল্যান্ড এর জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর এই স্নাতকোত্তর বিশেষ ডিপ্লোমা CERG-C প্রদান করে থাকে। ১ সেমিস্টারব্যাপী এই স্নাতকোত্তর কোর্সটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়ের উপরে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কোর্সটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়ের উপরে কর্মরত বিভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রীধারী পেশার মানুষজনের আইডিয়াকে সমন্বয় করে দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাদান করা। এই Postgraduate Specialisation Certificate on Assessment and Management of Geological and Climate Related Risk (CERG-C) কোর্সটি নিয়েই এই প্রবন্ধ।
উচ্চশিক্ষার দিক দিয়ে সারা পৃথিবীর মধ্যে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান রয়েছে প্রথম সারিতেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের Earth Science অনুষদের অধীনে প্রতিবছর এপ্রিল মাস থেকে এই কোর্সটি শুরু হয়। পাঁচটি প্রধান বিষয়ের উপরে ৩০ ক্রেডিট European Credit Transfer System (ECTS) শিক্ষা দেওয়া হয় যেখানে ইউরোপিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থায় ১ ক্রেডিট ECTS বলতে বোঝায় যে কোন একটি বিষয়ের উপরে ২৫ থেকে ৩০ ঘণ্টা করে ক্লাস ও পড়াশোনা করা। এই বিষয়গুলো হচ্ছে দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনা, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, আগ্নেগিরির আগ্নুতপাৎ এবং বন্যা ও জলবায়ুর পরিবর্তন। এই বিষয়গুলোর উপর দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর বাস্তবমুখী শিক্ষা দেওয়ায় হয়ে থাকে এই কোর্সটির প্রধান উদ্দেশ্য। এখন পর্যন্ত ১৯৮৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ পর্যন্ত ২৭টি ব্যাচ CERG-C কোর্সটি সম্পন্ন করেছে। এই কোর্সটিতে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি রয়েছে বাস্তবধর্মী ব্যবহারিক শিক্ষা যার মধ্যে ফিল্ড ট্রিপ, আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের সাথে কর্মশালা, সেমিনার ইত্যাদি। এই কোর্সটি মূলত দুইভাগে বিভক্ত, প্রথম ভাগে ৭ সপ্তাহে ৫ টি বিষয়ের উপর শিক্ষার দেওয়ার পর ২ সপ্তাহব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে ২য় অংশে থাকে গবেষণা, শিক্ষার্থীকে যে কোন একটি বিষয়ের উপরে ৪ মাসব্যাপী গবেষণার উপর উপস্থাপনা ও রিপোর্ট জমা দিতে হয়। এই কোর্সটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে প্রত্যেক বিষয়ের উপর ঐ বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, সম্পর্কিত দেশি বিদেশি গবেষণা সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাস নেওয়া যার ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবমুখী শিক্ষা অর্জন করে থাকে।
প্রতিটি কোর্সের Curricullam সাজানো হয়েছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আঙ্গিকে, প্রতিটি মডিউলে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহন। প্রথমেই আসা যাক ভূমিকম্প বিষয়টিতে, এই বিষয়টি দুইতি অংশে শিক্ষা দেওয়া হয় যার প্রথম অংশে রয়েছে Seismology, যেখানে ভূমিকম্পের উৎপত্তির কারণ ও ভূমিকম্প তরঙ্গ সঞ্চালনের প্রকৃতি, গতিপথ, সিস্মিক চ্যুতি ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয় ও ২য় অংশে Seismic Vulnerability, দালানকোঠা স্থাপনার ভূমিকম্প বলের ফলে কতটা দুর্বল বা শক্তিশালী সেটা নির্ণয় করা হয়। এই বিষয়ে জুরা পর্বত মালায় অদূরে ফ্রান্সের ভচে শহরের ‘ভচে সিস্মিক চ্যুতি পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক ফিল্ড ট্রিপে হাতে কলমে ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর উপরে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিভাবে ভূমিকম্পের ঝুকি কমাতে পুরাতন দুর্বল বিল্ডিং এ সিস্মিক Retroffiting (পুরাতন বিল্ডিং শক্তিশালী করণের বিশেষ পদ্ধতি) করা হয় সে বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের মন্থে শহরে Retroffiting করা হয়েছে এমন বিল্ডিং পরিদর্শন করে একদিনের কর্মশালা ও শহরের অবস্থিত বিল্ডিংএর উপর Seismic Vulnerability জরিপ করা শেখানো হয়। এই জরিপে অংশগ্রহণকারীরা শিখতে পারে কিভাবে একটা বিল্ডিং এর চারপাশে অল্প সময়ের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে তার Structural কাঠামো দেখে ভূমিকম্প হলে ঐ বিল্ডিং কি রকম আচরণ করতে পারে সে সম্পর্কে ধারনা করা যায়। এই ধরণের জরিপকে Visual Screening পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। এই ধরণের জরিপের মূল উদ্দেশ্য থাকে একই এলাকার মধ্য থেকে তুলনামূলক দুর্বল বিল্ডিং চিহ্নিত করা। সাধারণত দেখা যায় ভূমিকম্প সম্পর্কিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে কোন এলাকার সকল বিল্ডিং এর জন্য Detail Structural Assessment করা যেমন অনেক খরচের বিষয়, তেমনি সময় সাপেক্ষ। একারনে, যেকোন একটি অঞ্চলের বিল্ডিং গুলোর মান নির্ণয়ে ভূমিকম্প সম্পর্কিত জরিপে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই ধরণের জরিপ চালানো হয় যাতে করে ঐ অঞ্চলের তুলনামূলক বেশী ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা যায়। এই ধরনের জ্ঞান ভূমিকম্প সম্পর্কিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সবার থাকা উচিৎ। এছাড়া কিভাবে সহজেই অল্প খরচে নতুন বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে তৈরি করা যায় সে বিষয়ক খুঁটিনাটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই মডিউলে।
ভূমিধ্বস, বন্যা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ের উপর ফিল্ড ট্রিপে শেখানো হয় বন্যা ও ভূমিধ্বসে কিভাবে একটি অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং ঐ অঞ্চলের আঞ্চলিক সম্পদ ব্যবহার করে তা মোকাবেলা করা যায়। সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের পাদদেশে লেস ডেবলেরেস শহরে এক সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণে বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল চিহ্নিত করা, বিভিন্ন মাত্রার বন্যা সাপেক্ষে কি কি ধরণের সাম্ভব্য মোকাবেলা ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় তা সরেজমিন উদাহরণ ও ব্যাখ্যা করা হয়। সবশেষে শেখানো হয় Geographic Information System (GIS) ও Digital Image এবং ঐ অঞ্চলের পূর্ববর্তী বন্যা কিংবা ভূমিধ্বস ডাটাবেস ব্যবহার করে কিভাবে ভবিষ্যৎ বন্যায় সাম্ভব্য আক্রান্ত এলাকার ম্যাপ তৈরি করা যায়। এই ধরণের ম্যাপ পরবর্তীতে দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনায় অতীব জরুরী। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বসের কারণ, কিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সার্বক্ষণিক Monitoring, পূর্বাভাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়।
কোর্সটি চলাকালীন সময়ে সার্বিক দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষার অংশ হিসেবে রয়েছে জাতিসংঘের জেনেভা কার্যালয় ভ্রমন, জেনেভাতে অবস্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় (UNISDR, IFRC, Helvetia ইত্যাদি) কর্মরত বিশেষজ্ঞদের সাথে গোলটেবিল বৈঠক, Crisis Management এর অংশ হিসেবে জেনেভা পুলিশ দপ্তরে ১ দিনের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের United Nations Institute for Training and Research (UNITAR) এর প্রশিক্ষক দল কর্তৃক যেকোন দুর্যোগের সময় স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে কিভাবে আক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাস্তবচিত্র জানা যায় সে বিষয়ে ‘Rapid Response Mapping in Disaster Situatio’ শীর্ষক ট্রেনিং প্রদান করা হয়।
আগ্নেগিরির অগ্ন্যুৎপাত বিষয়টিতে আগ্নেগিরি সৃষ্টির কারন, অগ্ন্যুৎপাত সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত আছে। এছাড়া সাতদিনব্যাপী আগ্নেগিরির অগ্ন্যুৎপাত ও সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত অংশের ফিল্ড ট্রিপ আয়োজন করা হয় ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত ইতালির সিসিলির Aeolian দ্বিপরাজ্যে। এই সিসিলি রাজ্যের Aeolian দ্বীপমালা ইউরোপিয়ান ও আফ্রিকান এই দুই মহাদেশীয় সিস্মিক প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত, যার ফলে এই অঞ্চলটি পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় অগ্ন্যুৎপাত প্রবন এলাকা। এই সিসিলিতে তে অবস্থান করছে ইউরোপের সর্ববৃহৎ আগ্নেগিরি Mount Etna , এছাড়া রয়েছে Vulcano, Stromboli ইত্যাদি। পৃথিবীতে প্রধান যে পাঁচ প্রকারের অগ্ন্যুৎপাত হয়ে থাকে তার মধ্যে দুই প্রকারের নামকরন করা হয়েছে এই Vulcano ও Stromboli আগ্নেগিরির নামানুসারে। এই ফিল্ড ট্রিপের মধ্যে ২ দিন রয়েছে Vulcano ও Stromboli আগ্নেগিরির চুড়ায় আরোহণ করা, অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কিত প্রাথমিক ও সংশ্লিষ্ট Secondary Hazard এর বিষয়ক খুঁটিনাটি শেখানো হয়। এছাড়া বাকি দিন গুলোতে সার্বিক দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনায় অংশ হিসেবে Hazard Assessment, Social, Physical and Econimical Vulnerability Assessment, Risk Assessment, Risk Manageement, Loss Estimation এর উপর সার্বিক প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। একটা দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাথে যে সকল প্রশাসনিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষজন নিয়োজিত থাকে, দুর্যোগের সময় তাদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলে Table Top Exercise করা হয় যার ফলে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে কোন পেশার মানুষের দুর্যোগকালীন দায়িত্ব কি? । এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ মিডিয়া কর্মী দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিভাবে দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যাতে করে দুর্যোগ সম্পর্কিত বিষয়াবলী নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ভুল তথ্য পৌঁছে না যায়।
এই CERG-C কোর্সটির সাথে পার্টনার হিসেবে যুক্ত রয়েছে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যার মধ্যে ETH Zurich, University of Lausanne, Swiss Federal Department, UNISDR, UNOSAT, Wilsdorf Foundation, Solidarités International অন্যতম। পরিশেষে বলা যায় এই কোর্সটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুকি নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বাস্তবমুখী উচ্চশিক্ষার একটি আদর্শ মডেল। আমাদের মত দুর্যোগ প্রবন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজন এ ধরণের বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যাতে করে দুর্যোগ সম্পর্কিত শাখাগুলোতে আমাদের নিজস্ব জনশক্তি বৃদ্ধি পায়। এই কোর্সটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে http://www.unige.ch/hazards ওয়েব পেজটিতে।