ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দূর্যোগপ্রবণ দেশ। বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। প্রতি বছর বন্যা, ভূমিধ্বস, সাইক্লোন ইত্যাদি এ দেশের মানুষের জন্য অতি পরিচিত বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশ মধ্যম সারির ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। সৌভাগ্যের বিষয় বিগত ১০০ বছরে তেমন কোন বড় মাত্রার ভূমিকম্প এ অঞ্চলে আঘাত করেনি বলেই জানা যায়। যদিও বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে ছোট মাত্রার কিছু ভূমিকম্প নিয়মিতভাবে অনুভূত হয়। আর এই ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো আমাদেরকে পরবর্তী বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য সতর্ক বার্তা দেয়। আমাদের এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য মাত্রার বড় ভূমিকম্পের (রিক্টার স্কেলে ৮ বা তার বেশী) সময়কাল ১০০ বছরের ও বেশী অতিক্রম করেছে। ১৮৯৭ সালে ভারতের আসামে ৮.৭ রিক্টার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় যা এই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিল। ঐ ভূমিকম্পে আমাদের দেশের সিলেট শহরে অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ৫৫০ জন মানুষ মারা যায়। এছাড়া ঢাকা ও তার আশেপাশের অঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়। তাছাড়া আমাদের দেশের বেশীরভাগ বাড়িঘর ইটের তৈরী (Masonry) বিল্ডিং । এই Masonry বিল্ডিং সাধারণত ভূমিকম্পের সময় দুর্বল আচরণ করে থাকে। অপরদিকে, Concrete এর তৈরী অধিকাংশ বাড়িঘরই তৈরী হয়েছে ভূমিকম্প সহনশীল উপযোগীতা ছাড়াই। আর এ কারণে আমদের দেশ বা আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম এর মত শহরগুলোতে জনসংখ্যার ঘনবসতি বেশি হওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানির শংকা রয়েছে। এই শহরগুলোর রাস্তাঘাট অপরিকল্পিতভাবে তৈরী হওয়ায় যে কোন দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার কাজও অত্যন্ত দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। যদি দুর্যোগের সময়ে এই শহরগুলোর সরু রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যায় তবে তার আশেপাশের আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এ সকল কারণে ভূমিকম্প সম্পর্কিত বিষয়াবলী নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি মানুষ ছাড়াও জনসাধারণকে সচেতন থাকতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজন সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
ভূমিকম্প সৃষ্টির কারণঃ
ধরে নেয়া হয় হাজার বছর পূর্বে বিভিন্ন পদার্থের সমন্বয়ে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। ফিউশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন হয় এবং ধীরে ধীরে যখন পদার্থগুলো শীতল হয় তখন অপেক্ষাকৃত ভারী পদার্থ পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই পৃথিবীকে যদি মাঝ বরাবর দুই ভাগ করা যেত, তাহলে দেখা যেত ভূ-অভ্যন্তরের নিচের দিকে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ভারী পদার্থ। এই ভূ-অভ্যন্তরের কেন্দ্রে (Core) তাপমাত্রা (প্রায় ২৫০০° সেন্টিগ্রেড), চাপ (প্রায় ৪ মিলিয়ন বায়ুমন্ডলীয় চাপ) ও পদার্থের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশী। ভূ-অভ্যন্তরের উপরের স্তরকে Mantle বলা হয় এই স্তরের একটা বড় অংশ তরলের ন্যায় আচরণ করে। ভূ-অভ্যন্তরের সৃষ্ট তাপ ও চাপের কারণে এর উপরের দিকে Mantle এর মাঝে প্রবাহের সৃষ্টি হয় যার কারণে পৃথিবীর ভূ-ত্বক ভূ-অভ্যন্তরের উপরিভাগে বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দিকে চলতে থাকে। ভাগ হয়ে যাওয়া এক একটি অংশকেই বলা হয় “সিস্মিক বা টেকটনিক প্লেট” (চিত্র ২)। এই পৃথিবীতে সাতটি বড় মহাদেশীয় টেকটনিক প্লেট এবং ছোট ছোট অসংখ্য টেকটনিক প্লেট রয়েছে। এই প্লেটগুলো পাশাপাশি, একে অপরের দিকে বা বিপরীত দিকে চলতে থাকে তখন প্লেটগুলোর সংযোগস্থল বরাবর প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হয় এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে। সাধারণত এই প্লেটগুলো বছরে ২ থকে ১০ সে. মি. এর মত গতিতে ধাবমান। আবার এই পৃথিবীর ভূ-ত্বকের বড় অংশ শিলা (Rock) দিয়ে তৈরী। শিলা স্থিতিস্থাপক পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি এবং টেকটনিক প্লেটের আপেক্ষিক গতির কারণে শিলাসমূহ বিকৃত হয়ে এতে স্থিতিস্থাপক শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হতে থাকে। আবার দেখা যায় শিলাসমূহের মধ্যে থাকা পদার্থ অত্যন্ত্য ভঙ্গুর হয়। সুতরাং,যখন ভূ-ত্বকের দুর্বল অংশের শিলাসমূহ তাদের শক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় তখন হঠাৎ শিলাসমূহ থেকে বিশাল সঞ্চিতশক্তি উন্মুক্ত হয়ে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে এবং ভূমিকম্প তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ও ভুপৃষ্ঠে পৌঁছায়। একটি ভূমিকম্পের পর আবার শিলার মধ্যে স্থিতিস্থাপক শক্তি ধীরে ধীরে সঞ্চিত হতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই প্রক্রিয়াকে ‘Elastic Rebound Theory’ নামে অবিহিত করে থাকে
ছবির উৎসঃ EQTips, IITK
বাংলাদেশে ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাব্য উৎসঃ
কোন একটি অঞ্চলের ভূমিকম্প সৃষ্টির উৎস চিন্হিত করে ঐ অঞ্চলে নির্দিষ্ট কোন মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য পুনরায় ঘটার মধ্যবর্তী সময়কে পরিসংখ্যানের ভাষায় “রিটার্ন পিরিয়ড” বা “পুনর্ঘটন সময়” বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের এই অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য যে সম্ভাব্য রিটার্ন পিরিয়ড আছে তার সময়কাল অতিক্রম করেছে। এ কারণে ধরে নেয়া হয় আমাদের এই অঞ্চলের বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য ভূ-অভ্যন্তরে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চিত আছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষের জন্য প্রয়োজন ভূমিকম্প সম্পর্কিত সম্যক ধারণা রাখা ও নিজেদেরকে ভূমিকম্পকালীন সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখা। সাধারণত পৃথিবীর বেশীরভাগ ভূমিকম্প উৎপন্ন হয় টেকটনিক প্লেটগুলোর সীমানায় এবং এদেরকে বলা হয় আন্তঃপ্লেট ভূমিকম্প। আবার এই প্লেটগুলোর মাঝে অনেক স্থানে ফাটল বা চ্যুতি বিদ্যমান, অনেক ভূমিকম্প টেকটনিক প্লেটগুলোর সীমানা থেকে দূরে প্লেটের মধ্যেই ফাটল বা চ্যুতি বরাবর সৃষ্টি হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকম্পের সময় ফাটল বা চ্যুতির সীমানায় আকস্মিক স্থানচ্যুতি ঘটে (উলম্ব, আনুভূমিক ও পার্শীয় দিক বরাবর)। আর যেকোন অঞ্চল বা তার কাছাকাছি অবস্থিত সিস্মিক চ্যুতিই ভূমিকম্পের উৎস হিসেবে কাজ করে। একটা ভূমিকম্পের পরে ঐ ফাটল বা চ্যুতির ভূ-অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে শক্তির সঞ্চার হতে থাকে। বছরের পর বছর শক্তি জমা হয়ে ঐ অঞ্চলে আবার বড় ধরনের ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০৯ সালে একটি ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণা চালানো হয়েছে। ঐ প্রকল্পের অধীনে আমাদের দেশ ও তার আশেপাশের এলাকায় সম্ভাব্য ৫টি সিস্মিক চ্যুতির কথা বর্ণনা আছে যেখানে প্রতিটি চ্যুতি বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম। এই পাঁচটি চ্যুতি যথাক্রমে ১) মধুপুর সিস্মিক চ্যুতি, ২) সিলেটের অদূরে বাংলাদেশ ভারত সীমারেখা বরাবর ডাউকি চ্যুতি, ৩) দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে প্লেট সীমারেখা চ্যুতি-১, ৪) প্লেট সীমারেখা চ্যুতি-২ এবং ৫) উত্তর পূর্ব অঞ্চলে প্লেট সীমারেখা চ্যুতি-৩ (চিত্র ২ এর ন্যায়)।
ভুমিকম্প ঝুকি ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডঃ
ভূমিকম্প উৎপন্ন হওয়ার বা ভূমিকম্প প্রবণতার দিক দিয়ে আমাদের দেশ মাঝারি অঞ্চলে অবস্থিত হলেও ভূমিকম্প ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। একটি শক্তিশালীভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়া কিংবা একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়া মানেই কোন অঞ্চলের ঘর বাড়ি ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলা যায় না। ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণে অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে দালান কোঠা ভূমিকম্প সহনশীল কিনা কিংবা ভূমিকম্প বলের সাপেক্ষে কতটুকু দুর্বল তা যাচাই করা। আমাদের দেশে অধিকাংশ বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনশীল ভাবে ডিজাইন করা হয়নি। আর এ কারণে আমাদের দেশে যদি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও অনুভূত হয় তবে তা ঢাকা, চট্টগ্রামের মত বড় শহরগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের দেশে ভূমিকম্প প্রতিরোধী বিল্ডিং তৈরীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) রয়েছে। আমাদের দেশে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরী হয় BNBC-১৯৯৩ হিসেবে। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট (HBRI) থেকে পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এ কারণে ৯০ এর দশকের পূর্বে তৈরী হওয়া বিল্ডিংগুলোর ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধী উপায় প্রয়োগ করে তৈরী হয়নি বলেই বলা যায়। অন্যদিকে এই কোডের প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তেমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। বিল্ডিং কোড থাকলেও তা প্রয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিল্ডিং কোডের প্রয়োগের জন্য বিল্ডিং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও মালিক উভয়কেই সময়ের সাথে সাথে সচেতন হতে হবে। প্রথম BNBC-১৯৯৩ যখন প্রকাশিত হয়েছে তখনকার বিল্ডিং তৈরীর নীতিমালা সৃষ্টি হয়েছিল ঐ সময়ের ভূমিকম্প প্রতিরোধী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। বিগত বছরগুলোতে ভূমিকম্প সম্পর্কিত গবেষণা সারাবিশ্বে ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে এবং বিল্ডিং তৈরীর ধ্যান ধারণারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড অনুযায়ী একটি সিস্মিক মানচিত্র রয়েছে। সমগ্র দেশটিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে তৈরী ঐ মানচিত্রে দেখা যায় যে বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চল সবচেয়ে বেশী এবং দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল সবচেয়ে কম ভূমিকম্প প্রবণ। ২০০ বছর রিটার্ন পিরিয়ডে (পুনর্ঘটন সময়) হিসেব করে দেখা যায় যে ভূমিকম্প সৃষ্টি হলে মাটির কম্পনের ত্বরণ অভিকর্ষজ ত্বরণ “g”এর প্রায় সর্বোচ্চ ০.২৫ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে বিল্ডিং ডিজাইনে এখনও এই মানচিত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে যদিও এটি তৈরী করা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড সৃষ্টির সময় কালের লভ্য জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। পরবর্তীতে ভূমিকম্প সংক্রান্ত গবেষণা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। সম্প্রতিক সময়ে বর্তমান বিল্ডিং কোডের ভূমিকম্প সম্পর্কিত অংশ আপডেট করার জন্য হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিল্ডিং কোডের ভূমিকম্প সংক্রান্ত বিষয়াবলী আপডেট করা হয়েছে এবং নতুন বিল্ডিং কোডের খসড়া নীতিমালা ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জমা দেয়া হয়েছে। ঐ খসড়া কোড অনুযায়ী নতুন সিস্মিক মানচিত্রটি তৈরী করা হয়েছে ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড (পুনর্ঘটন সময়) ৪৭৫ থেকে ২৪৭৫ বছর হিসেব করে। নতুন এই মানচিত্রে সমগ্র দেশকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যেখানে মাটির কম্পনের সর্বোচ্চ ত্বরণ অভিকর্ষজ ত্বরণ “g” এর প্রায় ০.৩৬ গুণধরা হয়েছে যা পূর্বের প্রায় ১.৫ গুণ। বিল্ডিং ডিজাইন করার সময় আমাদের প্রকৌশলীদের আমদের এই ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে ডিজাইন করা অতিব জরুরী।