somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খগেন বাবুর পুষ্টি সমাচার

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
জালালুদ্দিনের বাড়ীতে টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে খানিক নিশ্চিত হলেন তিনি। সব কিছু ঠিক ঠাকই চলছে যেমন যেমনটি ভেবে রেখেছিলেন। পোষ্ট অফিস থেকে বাড়ী ঠিক হাঁটা পথ না হলেও, কেউ তাঁর অপেক্ষায় না থাকায় সব পথই আজকাল তাঁর হাঁটাপথ, সময়কে ধরবার তাড়াও তাঁর আর নেই। পৌষের মিঠেকাঁচা রোদ, আহ যেন সোনা! বুক ভরে দম নিয়ে কাশ্মীরি চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে, সাহেবি আমলের লাল ছোট পোষ্টাপিস থেকে রাস্তায় নেমে আসেন।
ছোট মহুকুমা শহর জেগে উঠেছে, কেজো লোকেরা বেরিয়ে গেছে কাজে কম্মে। রাস্তার ধারের রেস্তরাঁতে গরম তেলে সিঙ্গারা ভাজার চনমনে শব্দ আসছে। আগে হলে নিশ্চিত গোটা চারেক সিঙ্গারা আর পোয়াটাক জিলাপি খেয়ে নিতেন। কিন্তু আজকাল তাঁর পুষ্টি চিন্তাটা খানিক; না ঠিক খানিক না বরং বলা চলে বেশ বদলে গেছে। বিশেষত আমিষ বিষয়ক চিন্তাটা পুরোই বদলে গেছে!
লোভ যে হচ্ছে না তা নয় কিন্তু মন কে শাসন করে নিলেন। বাবার ছেড়ে যাওয়া গ্রে হাউন্ড চেকের উলেন কোটের পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে সময়টা দেখে নেন। কোটের মত পকেট ঘড়ি খানাও উত্তরাধিকার সুত্রেই পাওয়া। মনটা অস্থির লাগলেই পকেট থেকে ঘড়িটা দেখে নেন। যেন এভাবে পিতৃ দর্শন হয় খানিক। কোটের উপর চাদরটা ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে, রোদ বাড়ায় একটু চিলবিলানি গরম লাগতে থাকে উনার।
পিতা নগেন বাবুর উকিল হিসেবে বেশ নাম যশ ছিল। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল, কামাই রোজগারের বেশীর ভাগটাই তাই সঞ্চিত হয়েছে, নানা ভাবে। বড় বাজারে দুটি বড় আড়ত। পৌরসভার মার্কেটে তিন চারটে দোকান ঘর, আর ব্যাংক ও পোষ্টাপিস মিলে যা আছে, খগেন বাবুর বেশ ভালোই থাকবার কথা, বস্তুত থাকবার কথাই ছিল। কিন্তু সংসার ধর্ম না বুঝলে যা হয়। পিতা গত হবার পর এদিক সেদিক করে বেশ কিছু সম্পত্তি নস্যাৎ করলেন। ভালো এতদিন চাকরিটা ছিল। বছর খানেক হল অবসর হয়েছে। পেনশন আর দোকান ঘর গুলো থেকে যে ভাড়া আসতো তাতে চলে যাবার কথা ছিল ভালো মত, কিন্তু বেচারার নেশা হচ্ছে রাজ্যের পুরনো জিনিষ কেনা সাথে আছে আবার বিজ্ঞান। উনি পেশায় ছিলেন এখানকার কলেজের কেমিস্ট্রির ডেমনেস্ট্রেটর, তাই রসায়ন আর অম্ল ক্ষার ক্ষারক দ্রবণ এসব নিয়ে তার বেশ সময় চলে যায় সাথে অর্থও যায়। গান বাজনারও শখ আছে। যা হয় একা মানুষ, বিয়েথা করেন নি, শখ শৌখিনতা করবার মত সময় অর্থ দুই ই আছে।
এখন আর কাজ কি! সকাল বেলা প্রতিবেশী মাজেদ সাহেবের সাথে বাজার করা, আর সন্ধ্যার দিকে প্রেস ক্লাব কিংবা নারায়নের ফোটর দোকান প্রতিচ্ছবিতে গুল তালি মারা। আর বাকি সময়টা শুধু তার নিজের। মুল বাড়ী থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে একটা লম্বা ঘর করে ওটাকে উনার ল্যাবরেটরি বানিয়েনিয়েছেন, ওখানেই কাজ কম্ম করেন। গান শুনবার হিল্ম্যান রেডিওটা ওনার শোবার ঘরে থাকে, তাই একটা ছোট ট্রাঞ্জিস্টার কিনেছেন সম্প্রতি ও ঘরে এতেই গান শুনেন। মাঝে মাঝে ক্লোনটির তৈরি কড়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবেন, জীবনটা নেহাত মন্দ নয়!
মন্দ চলছিলো না কিন্তু একঘেয়েমি যেন চলে আসছিল জীবনে, একেই ছকে চলছে দিনের পর দিন। কখন মাছ, কখন মুরগী, কদাচ কচিত জল খাসি কি পাঠা এ ছাড়া তার জীবনে আর বইচিত্র নেই। এর মাঝে কিছু টাকা সুধে খাটিয়ে আর উদ্ধার করতে না পেরে বেশ খানিক আতান্তরেই পড়েছেন। আগে মাজেদ সাহেবের সাথে বাজারে গেলে, খগেনবাবু মানুষ একা হলেও বড় মাছটা তারই কিনা চাই। উনার অবশ্য কোন ছুঁৎমার্গ নেই বড় মাংসও চলে, বেশ কষে তেল মসলা দিয়ে যেদিন রান্না হয়, মাজেদ সাহেব কেও ডেকে খাওয়ান! কিন্তু এখন আর সেই রমরমা নেই, ট্যাংরা পুটি দিয়েই পুষ্টি সাধন করতে হচ্ছে, তাই মন বিশেষ ভালো নেই। নিজের পুষ্টি বিশেষত আমিষজাত পুষ্টি নিয়ে একটু চিন্তাতেই আছেন আজকাল! বিকল্প কিছু উপায় নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

সল্ট টেস্ট বা টাইট্রেশন করা আর সত্যি জৈব যোগ্য নিয়ে গবেষণা করার মাঝে যে বিস্তর ফারাক তা উনি বুঝে গেলেন অল্প কয়দিনেই! নানা রকম প্রাণীজ আমিষ থরে থরে সাজানো আছে ফরমালিন দেয়া জারে। আসলে উনার চিন্তা ছিল সস্তায় আমিষ কিভাবে পাওয়া যায়। চীনারা শুনেছেন সাপ ব্যাঙ্গ পোকা মাকড় সব খায়। ওই লাইনেও কিছুটা ট্রাই যে করেননি তা কিন্তু না! এমন কি উনার গিনিপিগ “এলিস” তারও সদ্গতি করে ছেড়েছেন কিন্তু বিশেষ সুখী হতে পারেননি। মাঝে মাঝে “লাইকা” কে নিয়ে ভাবেন কিন্তু এত দিনকার সম্পর্ক তাই কুচিন্তাটা ধামা চাপা দিয়ে রাখেন। মাঝে মাঝে ভাবেন কত পশু পাখি হেজে মরে থাকে ও গুলোর একটা বিলি ব্যবস্থা করতে পারলে বেশ একটা ভালো পুষ্টির যোগান পাওয়া যেত নিখরচায়। আসলে যেই আমিষই গ্রহণ করিনা কেন ভাঙলে তো সব এক, কিছু এদিক আর সেদিক! পুষ্টিটাই আসল। আচ্ছা এমন কি কিছু নেই বেশ সহজে পাওয়া যায় খরচা পাতিও নাই আবার পেতেও খুব বেশী কষ্ট না! মনে যা আসছে উঠি উঠি করে সেটিকে মস্তিষ্ক বিশেষ সায় দিচ্ছে না। মন তো মনই! কত কি না ভাবতে পারে!“আজকে আমার মনের ভিতর, ধাঁই ধপাধপ তবলা বাজে”। মনের কী! যা খুশি ভাবতেই পারে!

(২)
“অঘোর পন্থী সন্ন্যাসীরা শুনেছি নরমাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে! কিছু জানো নাকি?” সন্ধ্যার আড্ডায় খগেন বাবুর প্রশ্ন গঞ্জের বিশিষ্ট বুদ্ধিজিবি ফটোগ্রাফার বাবু নারায়নের প্রতি। হঠাৎ প্রসঙ্গ বিহীন এই প্রশ্নে আড্ডার লোকজন ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে যায়! নারায়ণ বাবু অবাক হয়ে বললেন ”হঠাৎ কি হল! তোমার তো দেব দ্বিজে বিশ্বাস বা ভক্তি কিছুই নেই, তোমার কেমিষ্টি গেল কোথায় হে ?! সন্ন্যাস নিচ্ছ নাকি, শেষমেশ কাপালিক হচ্ছ তাহলে!”
হেসে উঠে ইয়ার বন্ধুরা। থতমত খেয়ে যান খগেন বাবু! “না মানে একটা বই পড়ছিলাম আরকি!” আমতা আমতা একটা জবাব দিলেন তিনি!”বন্ধু শুধু তাই না আমি শুনেছি তাঁরা শব গমনও করেন! কি বিচিত্র! মানুষের মত এমন বিচিত্র প্রাণী আসলেই বিরল। এঁদের কথা খালি বলছ কেন? আন্দেজের বন্দী বইটা পড়নি!” “এখনো পড়া হয়নি, নাম শুনছি খুব বইটির, রাগবি খেলোয়াড়রা কিভাবে জান বাঁচাতে শেষে নিজেদের দলের মড়া খাওয়া শুরু করে, আন্দিজ পর্বতে আটকা পড়ে! সেটিই তো? নাকি!””সে বইটিই বটে”!
আড্ডায় বসতে আর ভালো লাগে না তাঁর। খানিক্ষন উসখুস করে উঠে পড়লেন। বন্ধুরা হাসতে হাসতেই বলছিলও, “কি এখনই সন্ন্যাস নিতে চল্লে নাকি?” উনি বিড়বিড় করতে কি বললেন কেউ আর বুঝলনা। আরেক রাউন্ড চা এর আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেই তিনি বেড়িয়ে গেলেন। মাথায় বিচিত্র ভাবনা, মন ঠেলে দিয়েছে মস্তিস্ককে, যে ভাবনা উনি উপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন তাই ফিরে ফিরে আসছে। কৌতূহল যেন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি!
নির্ঘুম রজনী, বিছানায় এপাশ ওপাশ করে গেল। পাপবোধ, সংস্কার, কুটিল মনবৃত্তি, নিঃসঙ্গতার অসুস্থ্য উত্তেজনা, সবের জোড় লড়াই হল, বিজ্ঞানের অনুসন্ধিতসু মনের দোহাইও এসেছে বার কয়েক। এক বিচিত্র দোলাচাল মনে। আসলে মানুষের গভীর চেতনে কিছু জান্তব স্মৃতি রয়ে যায়। সুদীর্ঘ জৈবিক সংকেতে রক্ষিত,সে সব। বহু পুরুষ আগের সেই সংগ্রাম মুখর বীভৎসতা, সুদীর্ঘ সভ্যতা সব কি আর ঘুচিয়ে দিতে পারে?! তাইতো কদাচ কচিৎ হলেও কাগজে কিছু সংবাদ আসে, সবাই স্তব্ধ হয়ে ভাবে, এমন মানুষও আছে! সহস্র বছরের অভিযোজিত এ মানব জাতির, কিছু দল ছুট নমুনা ঠিকই বেরিয়ে আসে সময়ে সময়ে। সে কালো কালো ছায়া ছায়া অন্ধকার গুলো বন্দী হয়ে থাকে, তবুও কোথাও কোথাও খুব সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে! নিয়তি কেন বাধ্যতে।
“কাকা, শইল খারাপ?!” জালালুদ্দিনের প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে তাকান, বেলা হয়ে গেছে অনেক, বিছানায় বসেই মুখ দেখেন আয়নায়, খানিক কৃশ দেখাচ্ছে, আঙ্গুল ঘষেন গালে চিবুকে দিন চারেকের খড়খড়ে দাড়ি লাগে হাতে। জালাল কে দেখেন, কি সতেজ সটান ছেলেটা! উনার হাসি ফুটে, হাসির মানে জালালের বোধের অনেক বাইরে।
“ছিল রাত্রে, এখন আর নেই, ভালো আছি, খুব ভালো!” জালালের প্রশ্নের উত্তর করেন! তারপর পায়ে চটি গলিয়ে বাথ্রুমের দিকে যেতে থাকেন, কি যেন একটা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে! জালাল ভাবে ভালো হলেই ভালো।
নিয়তি এক উর্ণনাভ তার সুক্ষ জাল বুনতে থাকে নিরবে!
ঠান্ডা জলে চান টান সেরে, আসলেই বদলে গেলেন। যেন খোয়ারি ভেঙে চনমনে হয়ে উঠেছেন। কড়া লিকারের চায়ে চুমুক দিয়ে জালাল কেই আজকে বাজার করতে বললেন, কি আনবে তার কথা শুনে জালাল বেশ খুশিই হয়ে উঠলো। “ফিস্টি হবে নাকি কাকা?!” খুশি মনেই বাজার গেল। যদিও এই সময়টা অন্যদিন তার কাকা বাজারে গেলে বেশ একটু ফাঁকা সময় পায়, আর তখন তখনই পিছের ঘন কচুবনের আড়ালে ভাঙ্গা পাঁচিল ঘেঁষে একটা মুখ উঁকি দেয়। সবুজ লাউডগার মত, ঘন কালো গভীর দুটি চোখ, নবিন কলাপাতার মতই চকচকে, আনন্দে, উত্তেজনায়। শিরিন পাশের বাড়ীতে সেও জালালের মতই, দুজনের দুটি সুখ দুঃখের কথা কিছু আশার কথা, কিছু স্বপ্ন দেখার সাহস, কখন কচিৎ খানিক স্পর্শ, সবার চোখের আড়ালে, এই তাদের ভালবাসাবাসি। আর ঝুম দুপুরে যখন একতলা বাড়ীর শ্যাওলা ধরা ছাদে কাপড় তুলতে বা আচার কি আমসত্ব গুলো উল্টে পাল্টে দিতে যায়, চোখ জোড়া উন্মুখ খুঁজে ফিরে জালাল কে, তার নীল শার্ট কি জংলী ছাপা শার্টটি উঠানের তারে মেলা থাকে অলস, গভীর মায়ায় তাকিয়ে তাই দেখে সে। ফ্যাকাসে নীল ফটক, হলুদ দালান, লাল মেঝে, ঘুলঘুলির শূন্যতা, সব খুঁজে ফেরে কলাপাতার মত সবুজ মেয়েটি! কখন নিচে কাপড় মেলবার তার ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে জালাল। “ঢং” বলে সেও হাসে। তাদের এ ভালবাসাবাসি দেখবার মত কেউ থাকে না, সে সময়, সে ঝুম দুপুরে, মনে হয় যেন এ বিশ্ব চরাচর শূন্য, কোথাও কেউ নেই, শুধু দুটি তরুণ প্রাণ জেগে আছে, উন্মুখ হয়ে!

(৩)
গত কিছুদিন হতাশা ছাড়া আর খগেন বাবুর কিছুই ছিল না! সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মনটা যতটা ফুর ফুরে হয়েছিলো, কিন্তু কাজটা এগুতে না পারাতে ততটাই হতাশ! তিনি অবাক হয়ে ভাবেন মানুষ কেন বুঝতে চাইছে না, এভাবে অপচয় করা, সব কিছু নষ্ট করা ঠিক না। কি সহজ সমাধান মানুষের কাছে অথচ মানুষ কত কষ্টই না করছে! কিসের পাপ কিসের সংস্কার! কত কিছুই বদলে গেছে, বদলাচ্ছে। যে ব্রিটিশ সম্রাজ্যে সূর্য ডুবত না, তাঁদেরও পাত্তাড়ি গুটোতে হল! কালে কালে কত কি হবে! এই তো বছর ছয়েক আগে মানুষ চাঁদে চলে গেছে! বদলাবে নিশ্চিত বদলাবে সব! মানুষ এভাবে সব অপচয় করা বন্ধ করবেই! তবে সহজে যে হচ্ছে না তা তিনি বুঝে গেছেন!
শ্মশান গোরস্তান হাসপাতাল কোথায় না চেষ্টা করেছেন একটা মড়া যোগার করবার জন্য! কাজের কাজ কিছু হল না, শুধু কিছু টাকা গেল! গবেষণার নামে এখানে সেখানে ধরনা দিয়েছেন বিশেষ লাভ হল না! হতাশা ছাড়া আর কিছুই নাই!
কিচ্ছু করবার নেই! যা চাচ্ছিলেন না, সে পথেই যেতে হবে! মানব কল্যাণ জীবনের চেয়েও বড়! কিছু একটা করতেই হবে! সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন! নিয়তি অমোঘ, সে যে পথেই হউক ঘুড়িয়েই হউক আর না ঘুরিয়েই হউক ঠিক যেখানে যাকে হাজির করবার সেখানেই নিয়েয় হাজির করায়!
জালালের বাবার টেলিগ্রামের কপি খানা থানার দারোগা বাবুর সামনে রাখেন, উনার টেলিগ্রাম করবার সংবাদটাও জানান! বাইরে রোদ উজ্জল, থানার হলুদ মোটা দেয়ালের খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সড়ক, কাচারি বাজার এর খানিকটা, হাড়ভাঙ্গা ডাক্তার এর চেম্বার! মাছের মত নিঃস্পৃহ চোখ করে বসে সব দেখছেন।
“খগেন বাবু, চা; ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে”।
অন্যমনস্কতা থেকে যেন ফিরে এলেন!”যা বলছিলাম, বাবা ছেলেটাকে নিয়ে এসছিলেন, কত হবে ছ’সাত বছর, শ্যামগঞ্জ ষ্টেশনে বসে কাঁদছিল, সেই থেকেই”... একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরোয় খগেন বাবুর, “আমাদের এখানেই মানুষ” তা আঠারো বিশ বছর তো হবেই, ও আসার বছর দুয়েক এর মাঝেই বাবা চলে জান, আমার দেখাশোনা বলতে গেলে, আমি কেন পুরো সংসারটা ওই দেখতও! জানেন কখন কখন ভাবি আমার ভালো মন্দ হয়ে গেলে ও এই যেন সব পায় সেই ব্যবস্থা করে যাবো! কিন্তু কি যে ঘটছে? কিছু ভালো লাগছে না, দারোগা বাবু! দেখুন কিছু করা যায় কিনা!”
“কিছু খোয়া গেছে মানে টাকা বা দামি কিছু?” দারোগার চাঁছাছোলা প্রশ্ন!
আকাশ থেকে পড়লেন খগেন বাবু!” ছিছিছি দারোগা বাবু, এসব কি বলছেন, সে আমার ভ্রাতা সম”!
“ভ্রাতা সম, ভ্রাতা তো আর নয়, একটু ভালো করে দেখুন সব, আপনার তো শুনেছি কিসব গবেষণার বিষয় আসয় আছে সেখানে নিশ্চয়ই দামি যন্ত্র টন্ত্র থাকতে পারে?”
“না, জালাল ওমন ছেলেই নয়! আপনি অন্যান্য ষ্টেশনে একটু খোঁজ নিন কোথাও রেলে কাটা পড়লো নাকি কেউ, বা অন্য কোন দুর্ঘটনা, আমি আসলে ছেলেটার কিছু হল কিনা সেইটে চিন্তা করছি, আপনি একটু জোড় তদন্ত লাগান, আমি উঠছি, আর ডাইরী তো হয়েই গেছে আমি উঠছি”।
দারোগা রব সাহেব বসে বসে খগেন বাবুর চলে যাওয়া দেখলেন, একটু যেন তাড়াহুড়ো করলেন যেতে?! মনে মনে বলেন পুলিশের মন! হাতে জালালের একখানা ফটোগ্রাফ সেটা দেখছেন, তেইশ চব্বিশ বছরের ছেলে হাসি হাসি মুখ, উজ্জল চোখ, বড়লোক বাড়ীর কাজের লোক, ভালো মন্দ খায় দেখতে মন্দ লাগছে না! পাশে খগেন বাবুর এক বন্ধু দাঁড়িয়ে, বছর তিনেক আগে একটা প্যান্টেক্স ক্যামেরা কিনেছিলেন তাই এই ছবিখানা তোলা হয়েছিলো, না হলে তো কোন ছবিও পাওয়া যেত না! রব সাহেবের মনটা একটু খারাপ হয়, একটা ছেলে, তরতাজা ছেলে নাই হয়ে গেল। তার ছোটভাইটির বয়সও এমনি ছিল, কাউকে না বলে যুদ্ধে চলে যায়, আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি! নাহ ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতেই হয়! নারী ঘটিত কিছু, নাকি জুয়া টুয়ার নেশা ছিল, ধার দেনায় ভাগতে হয়েছে?! আমি দারোগা এম ডি আর ও বি রব, তার সদ্য বানান করতে শেখা শিশু কন্যা এভাবেই উনার নামটা বলে, এত সহজে কিছু ছাড়ছি না!

সন্ধ্যা ঘনায়, বারান্দার হলুদ বাতিতে পোকারা পাক খেতে থাকে, পোকাদের ডাক, পাড়ার খোকাদের পড়া, সব যেন সুরে সুরে এক নৈশব্দ তৈরি করে। রাত গভীর থেকে গভিরতর হয়, খগেন বাবুকে অন্ধকারে ধীরে ধীরে বাড়ীর পিছে ল্যাবের দিকে যেতে দেখা যায়। বারান্দার আলো উঠোনে কিছু আলো ফেলে কিছু করে ছায়া! কুয়াশারা পাক খেয়ে যায়! তার অবয়বটি কে এক অশুভ অবাস্তব ছায়া মনে হয়। যান্ত্রিক নাকি এক জান্তব তাড়না তাকে টেনে নিয়ে চলেছে! কোন অনুতাপ নয় কোন অনুশোচনা নয়, আদিম মানব যেন, মন নেই, বিবেক নেই শুধু জান্তব তাড়না! কোন আদিম পিতার সংগ্রামের স্মৃতি বুঝি সংকেত মুক্ত হয়ে গ্রাস করেছে তাকে। কোন এক ছোট মহুকুমার নিরীহ সে খগেন বাবু নয় সে। বৈরি সময়ের কোন এক আদিম প্রাণ যেন জেগে উঠেছে, শুধু বেঁচে থাকা, টিকে থাকা, দৃষ্টিতে এক হারিয়ে যাওয়া সহস্র বছরের নৃশংসতা! তিনি নিজের এ অবয়ব কখন আয়নাতে দেখেননি, দেখলে ভয়ে আতঙ্কে বুঝি মূর্ছা যেতেন!

আরেকটি মুখ তেমনি ভয়ে ফ্যাকাসে ,অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে, কচু ঝোপের অন্ধকারের ওপাশে শ্যাওলা ধরা ভাঙ্গা দেওয়ালের ওপাশ থেকে। যে দৃষ্টি তার প্রিয় মানুষটিকে দেখবার জন্য উদগ্রীব, দিনমান উন্মুখ দৃষ্টি শুধু এ বাড়ীর আনাচে কানাচে, সে সতৃষ্ণ দৃষ্টি যেন, ভয় আর এক অজানা আতঙ্কে আজ কম্পিত! কি এক অচেনা ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠে! কেন ভয় কিসের ভয়, সে বুঝতে পারে না, শুধু কয়েকদিন ধরে প্রিয় মানুস্টিকে দেখছে না, তাই নানান অজানা আশঙ্কা মনে উঁকি দিচ্ছে। কখন তাকে না জানিয়ে দূরে কোথাও তো যাবার কথা নয় তার! সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে আছে বলেই সুযোগ পেলেই ভাঙ্গা প্রাচীর এর ফাঁকা দিয়ে উঁকি ঝুকি দেয়। আর তাই রাত্রি বেলায়ও শুতে যাবার আগে, শেষ একবার ঘুরে দেখে যেতে চাইলো, যদি দেখা মেলে তার।
আর তখনই সে এই অদ্ভুত দৃশ্যটি দেখে, এত রাত্রে ঘোর গ্রস্থ মানুষের মত খগেন বাবু থপ থপ করে পিছনের যন্ত্রঘরের দিকে যাচ্ছেন। তাঁর সিলুয়েট অবয়ব, তাঁর চলা, পায়ের আওয়াজ, আলো ছায়া সব মিলিয়ে শিরিন মেয়েটি ভয় পেয়ে যায়, দু’আ সুরা পড়তে পড়তে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে সে!

(৪)
মাজেদ সাহেবের হল্লায় ঘুম ভাঙ্গে খগেন বাবুর। উঠতে বেলা হয়ে যাচ্ছে আজকাল!
“কি দাদা, বাজার টাজার যাচ্ছেন না? এত পুষ্টি চিন্তা আপনার, আর এখন খালি মুড়ি চিবুচ্ছেন নাকি?” বিছানার পাশে মুড়ির টিন দেখে সহাস্য প্রশ্ন মাজেদ সাহেবের। “কি জালালের কোন পাত্তা পেলেন? ওর না আসা পর্যন্ত আপনাকে বললাম আমাদের ঘরেই খেতে আপনি শুনলেন না, পারুলের মা আমাকে নানা কথা শোনায়। আপনার জন্য আমাকে হেনস্তা হতে হচ্ছে, আজকে দুপুরে সোজা চলে আসবেন। ষোল মাছ এনেছি, কচি লাউ দিয়ে যা জমবে না। উঠে পরুন, উঠে পরুন, আর কত! আমি আসি! চলে এসেন সময় মত, নাহলে আমার কিন্তু বিপদ হবে”! নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হেসে উঠলেন!
খগেন বাবু হ্যাঁ হু করে বিদায় দিয়ে বিছানায় স্থাণু হয়ে বসে থাকেন! কি করবেন তিনি! নিজেকে নিজেই বুঝতে পারেন না! আয়নায় দেখেন ভাঙ্গা চোখ, যেন রাজ্যের ক্লান্তি, সহস্র বছরের ক্লান্তি! এক ক্ষমাহীন যাত্রায় ক্লান্ত হেরে যাওয়া এক আদি মানব যেন তিনি!
সবুজ ঢেঁকিশাক, কুঁচো চিংড়ি দিয়ে, সাথে গন্ধ লেবু, ধোঁয়া উঠা বোরো চালের ভাত। ষোল মাছ কচি লাউ দিয়ে ধনে পাতা, কাঁচা মরিচের চনমনে গন্ধ, সাথে পাঁচ ফোঁড়ন দেয়া টমেটোর টক, শেষ পাতে নতুন গুড়ে কাউনের চালের ক্ষীর! কিন্তু কিছুরই যেন স্বাদ পাচ্ছেন না তিনি, শুধু যেন খাওয়ার জন্যই খেলেন। মাজেদ সাহেব নিজের খাওয়া আর বউ এর রান্নার তারিফ করতেই ব্যাস্ত! খগেন বাবু কি খেলেন না খেলেন অত খেয়াল করলেন নাহ!
ওখান থেকে ফিরে ঘর ভাসালেন বমি করে! নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। জালালটা থাকলে কোন চিন্তাই ছিল না, সব সামলে নিত! নিজের ভাইয়ের মতই ছিল! খানিক অসহায় অশ্রু বুঝি দানা বাঁধে মনে!
লাইকা এসে কুই কুই করে বমি চাটতে শুরু করে, জোড় করে ওকে বের করে বারান্দায় পিলারের সাথে বেঁধে আসেন। ক্ষুধায় কুকুরটার পেট পিঠে লেগে গেছে। কিছু একটা দিতে হবে তো! মুখ ধুয়ে লাইকাকে নিয়ে ল্যাবরেটরি রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন, এত পুষ্টি তার দরকার নেই, কিছু লাইকাও পাক, নাহলে শেষ হবে না! পঁচবে গন্ধ ছড়াবে!

ফরমালিন ভেজা অচেনা মাংস খেতে বিশেষ আগ্রহী নয়, হাজার হলেও ভালো ব্রিডের কুকুর! কিন্তু ক্ষুৎপিপাসার কাছে মানুষই হার মানে আর এতো সামান্য পশু, হউক না উঁচু জাত! বিতৃষ্ণা আর বিবমিষা নিয়ে খগেন বাবু লাইকাকে দেখতে থাকেন। বোধহীন এক প্রাণ! আহ সেই বুঝি ভালো ছিল!

তিনি জানতে পারলেন না অবাক বড় বড় দৃষ্টি মেলে ভাঙ্গা দেওয়ালের অপার থেকে আরেকজন তাদের দেখছে। কি যেন হিসেব মিলছে না তার!। মানুষটা কই গেল? তারে মেলা নীল শার্ট বাইরে থাকতে থাকতে কুয়াশা আর রোদে ঝলসে ন্যাতাকানি হয়ে ঝুলে আছে তারের এক কোনে। কিন্তু লোকটা নেই। কোন বলা নেই কওয়া নেই হুট নাই! শেষ দেখা যেদিন, দুপুরে খাবার পর দুটো সন্দেশ দিয়েছিল ওকে! কোথাও যাবার কথা তো বলেনি। কি যেন একটা শঙ্কা, কি যেন একটা ভয়! বুকে থুথু দিয়ে নিঃশব্দে বাড়ীর দিকে ফিরে যায়, কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে, মেয়েদের কত ভয়!

রব সাহেব যখন এ পাড়ায় খোঁজ খবর করতে এলেন, তখন বিকেল প্রায় শেষ, কমলা রোদ বিছিয়ে আছে সারা রাস্তা জুড়ে, পত্র পল্লবহীন বৃক্ষরা দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ! রব সাহেব উদাস চোখে আলো দেখেন। মোটা গোঁফ, তেল চিক্কণ চেহারা, স্ফিত মধ্যদেশ এই পুলিশ অফিসার এর মনে যে কোমল আলো কি গাছেদের ছায়া কোন রেখা পাত করতে পারে কেউ কস্মিন কালেও ভাববেন না। গোল্ড ফ্লেইক সিগারেট খানায় কষে টান দিয়ে ফেলে দেন ছুঁড়ে!

পাড়ার মুদি ওয়ালা, ভাঙ্গারির দোকান, ভাজাভাজির দোকান কেউই কিছু তেমন বলতে পারলো না, সবারই কম বেশী এক কথা, ভালো ছেলে, কোনদিন কিছু এদিক সেদিক দেখনাই। তবে পাড়ায় তার একটি বান্ধবী আছে সে খবরটি মুদি ওয়ালার কাছ থেকে পেয়েছে, কেন না মাঝে মাঝে দু চারটে মেয়েলি জিনিষ এখান থেকে সে কেনে, কালো কালো হজমি, কি তেতুল, কখন কাজল রেখা কাজল। কিছু জিজ্ঞেস করলে রহস্য করত, কিন্তু বিশেষ কিছু বলতো না!

খগেন বাবুর বাড়ীর ফটকে যখন করা নাড়েন সন্ধ্যার আযান তখন দিয়ে দিয়েছে। ঝুপ করে আঁধার নামে শীতকালে! রব সাহেব বাইরে থেকে টের পেলেন কেউ আলো জ্বালাল বারান্দার, কুকুরের ঘেউ ঘেউ থামাতে অস্ফুট যেন কি বলল! তারপর কারো এগুনোর শব্দ! খগেন বাবুই দরজা খুললেন। দিন দুয়েক আগের ইনি আর আজকের ইনার মাঝে অনেক তফাৎ, ক্যামন প্রাণহীন ফ্যাকাসে!
“শরীর খারাপ নাকি? আহা এর মাঝে আমি আবার!” আন্তরিক ভাবেই লজ্জিত হলেন দারোগা বাবু!
“না না আসুন না, কোন খোঁজ পেলেন?”
বাড়ীতে ঢুকবার ফটক থেকে বারান্দা পর্যন্ত পথ টুকু হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিলো। “ নাহ! হুসেনপুর থানা থেকে জানিয়েছে আমায়, জালাল বাড়ী যায়নি, বা কেউ তাকে দেখেও নি। সপ্তাহ দশ দিন হল, কোন খুন জখম কি দুর্ঘটনার কোন রিপোর্টও কিছু পাইনি! আপনি বকা ঝকা করেছিলেন নাকি। রাগ টাগ করে ঢাকা বা বড় কোন শহরে চলে গেছে?” কথা বলতে বলতে শিকল বাঁধা কুকুরটির মাথায় গলায় আদর করে দিতে লাগলেন দারোগা বাবু, বন্ধু বানিয়ে ফেললেন সহজেই! আদরের শব্দ করতে লাগলো কুকুরটি!
“আরে না না কি বলেন, ও আমার ছোট ভাইয়ের মত, কখন বকা দেবার মত কিছু করতই না, সংসারটা তো ওরই ছিল, আমি তো ছিলাম অতিথ্‌-মেহমান, আমার খেয়াল নিয়ে, কাজ নিয়েই থাকতাম।“
“কারো সাথে কোন সম্পর্ক নাকি হয়েছিলো, সেখানে কোন কিছু হল নাকি, বলতে পারেন?" আনমনেই পকেট থেকে সিগেরেট বের করে ঠোঁটে ঝুলান!
“নাহ লাজুক ছেলে আমাকে কি এসব বলবে নাকি? আমার মনে হয় না সে এমন কোন সম্পর্কে জড়াবে হঠাৎ। আমি যতদূর জানি সামনের আশ্বিনে ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছে ওর বাড়ীর লোকেরা ওর জ্যাঠাত বোনের সাথে।“
“আই সি!” ফস করে দেশলাই জ্বালান ফসফরাস আর গল্ডফ্লেইক এর কড়া তামাকের গন্ধে গা টা গুলিয়ে উঠে খগেন বাবুর, ওঁর ঘ্রান শক্তি আবার প্রখর! দারোগা বাবু বুঝতে পারেন। “ওহ সরি, আমার আবার এটি ছাড়া চলেই না” বলে সিগারেটটা ফেলে দিতে চাইলে খগেন বাবু নিষেধ করেন। “না না ইটস ওকে, আমার শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছে নাতো আর আপনার তামাকটিও বড্ড কড়া”।
“বেশ বেশ আপনি বিশ্রাম করুন। আমি শুধু জালালের থাকবার ঘরটা দেখে চলে যাই। আরেক দিন এসে কথা বলা যাবে। শুধু বলেন ঘরটা কোনদিকে?”
“বারান্দা দিয়ে শেষ মাথায় গিয়ে কল ঘড়ের উল্টো দিকের ঘরটায় ও থাকতো। আসুন দেখিয়ে দেই”।
“না না আপনাকে আসতে হবে না, আপনি বসুন তো চেয়ারটাতে, আমি চট করে দেখে আসি, একটা রুটিন চেক আপ আরকি!”
দরজায় লাগানো শিকলটা খুলেন হুড়কো থেকে, আন্দাজে যেখানে ঘরের আলো জ্বালাবার সুইচ থাকবে আশা করেছিলেন, সেখানেই পেলেন সুইচ! আলো জ্বেলে দেখলেন মাঝারি একটা ঘড় একটা খাট পাতা, বালিস তোষক পরিপাটি। আলনায় ভাঁজ করা লুঙ্গি, একটা কালো বেল বট্ম প্যান্ট। একটা টেবিল, ড্রয়ারে একটা গানের বই, জনপ্রিয় বাংলা গানের কথা, সবুজ একটা আলোর দিশারি চটি নোটবুক, পাতা উল্টালেন, প্রায় নতুন, শূন্য পাতা, দুয়েক পাতা পর পর কাঁচা হাতে লেখা শিরিন প্লাস জালাল। “শিরিন কে বালবাসি”। ডাইরিটা পকেটে নিলেন তিনি! খাটের নিচে উঁকি দিলেন শূন্য সব! একটা তোবড়ানো চামড়ার স্যুটকেস, টেনে বিছানার উপর তুলে দুই পাশে চাবি টিপে বোতাম খুললেন, ভিতরে ইস্ত্রি করা কড়া মাড় দেয়া একটা পাঞ্জাবি, একটা রুমাল, একটা লাল ছোট কুরআন শরীফ, ভিতরের কুঁচি দেয়া পকেট থেকে বেরুলো তিনশ ছাপান্ন টাকা, সব নতুন নোট। আর ছোট একটি চিরকুট যত্ন করে ভাঁজ করা, ভিতরে লেখা ভালবাসি, ইতি শিরিন নিচে ইংরেজিতে লেখা এস প্লাস জে!। রব সাহেবের কেন যেন মায়া হয়! ভাবেন ছেলেটা বেশ সৌখিন আর গুছানো ছিল! কিন্তু বাড়ীতে গেলে তার কিছুই নিবে না, এটা ক্যামন কথা! নিশ্চয়ই এই শিরিনের সাথে রাগ করে বিবাগী হয়েছে। দেখি এই শিরিন মেয়েটা কে? তার সাথে একটু কথা বলতেই হবে!
রুম থেকে বের হয়ে খগেন বাবুকে আর বিশেষ বিরক্ত করলেন না। বিদায় সুচক কথা বলেই বের হয়ে আসলেন! লাইকাও লেজ নেড়ে নেড়ে ফটক পর্যন্ত এসে বিদায় দিয়ে গেল, এখন শিকল খোলা, আর রব সাহেবকেও তার বিশেষ পছন্দ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
শিরিন কে পেতে দুমিনিটও লাগলো না, মুদিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিলো। কোন বাসায় থাকে, সে নিজেও বেশ উৎসাহী হল ব্যাপারটা জানতে কিন্তু দারোগা সাবের সাথে কথা বলবার বিশেষ সাহস করে উঠতে পারলো না। আবার খানিক টা পথ উজিয়ে এসে খগেন বাবুর বাড়ী, পেরিয়ে পরের বাড়িটাতে আসতে হল, সেখানেই নাকি থাকে শিরিন, কাজের লোক হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে সে।
বাড়ীর লোকেরা পুলিশ দেখে একটু চমকেই উঠল! ঘর গেরস্তালি করা মানুষদের পুলিশে বড় ভয়! উনি দুয়েক কথায় বিষয়টি বললেন তাঁদের, শিরিনের সাথে একটু কথা বলবেন বলে উনি জানালেন। বাড়ীর লোকেরা মেয়েটিকে ডেকে আনল, উনিশ কুড়ি বছর হবে হয়ত বয়স! কৈশোর এখনো আটকে আছে। মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গেছে। ফ্যাকাসে মুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ। অত কাছ থেকে আগে কোন পুলিশ সে দেখেনি, সিগারেটের কড়া তামাকের গন্ধ নাকে আসছে।
বাড়ীর লোকেদের সরিয়ে একা একটু কথা বলতে চাইলেন তিনি, বাসার ঘর থেকে সবাই একে এক চলে গেলেন, কিন্তু পর্দার আড়ালে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকলে দারোগা সাহেব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,”আমি একা একটু শিরিন এর সাথে কথা বলতে চাই”। পর্দার নিচ থেকে সাদা সাদা পা গুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো!
শিরিন কে কোমল স্বরে বসতে বললেন। একটু বিব্রত হলেও অনভাস্যে আড়ষ্ট হয়ে চেয়ারে শক্ত হয়ে বসলো। “কোন ভয় নেই শিরিন, জালাল খুব ভালো একটা ছেলে, তুমি জানো ও কোথায়?” তার বড় বড় চোখে কান্না টলোমলো করে উঠে। ঠোঁট গুলি কেঁপে কেঁপে উঠে। তার অনেক কথা বলবার আছে।

(৫)
আদিম এক গুহামানব গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে, প্রশস্ত লোমশ বুক, চওড়া চ্যাপ্টা কপাল, শক্তিশালী বাহু, পাঞ্জা, ঝড় জলে ভয় নেই, ভয় শুধু এক ভয়ানক খুদার, ভয় কখন সে নিজেই অন্যের শিকার হয়। বোধ নেই। প্রেম নেই। শুধু এক জান্তব তাড়না, এক বেশুমার খুদা, আর রিরংসা চালিত করে তাকে, তার মত আরও আরও অনেক কে, সেই বেঁচে থাকে যে এই বৈরি বাতাসের সাথে যুঝতে জানে, মারো নয় মর। কে ভ্রাতা, কে পিতা কিছু আসে যায় না। যে হেরে যায়, যে মরে যায় সে হয়ে যায় পুষ্টি সাধনের উপাদান। কোন লজ্জা নেই, সমাজ তো শুধু নিজেদের নিরাপদে থাকার জন্য, শুধুই টিকে থাকার জন্য! পাহাড়ে পাহাড়ে আঁধার নামে। আশপাশে অচেনা চেনা পশুদের আশা যাওয়ার খচমচ শব্দ সে শুনতে পায়! দূরে রাতের পাখিরা ডানা ঝাপটায়, এক দীর্ঘ হিম রাত্রি, জমাট বাঁধতে থাকে অতলান্তিক আঁধারে।
সে এক কোন অতীতের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে, রক্তের কোন ক্ষীণ কোষে,কণায়,জিনে কোন সংকেত অবমুক্ত হয়ে উঠে থেকে থেকে! না সময় না স্থান সব যেন হারিয়ে যায় এক সুতীব্র নেশা তাকে গ্রাস করে। আহ!
ধীরে ধীরে আছন্ন এক অবয়ব এগিয়ে যায়, আলো ছায়ায় কুয়াশায়। পোকারা পাক খেতে থাকে হলদে আলোয়। নিঃশব্দ চরাচর। আদিম এক মানুষ যেন হিংস্র, উন্মাদ কেউ একজন। জান্তব এক লোভ তার জিহবা সরস করে, যেন বহু অপেক্ষার পর সে কিছু পেল, জার আস্বাদ রয়ে গিয়েছিলো কোন সুক্ষ কণায় গভীর গোপন এক সংকেতে।
ল্যাবরেটরি রুমের দরজা খুলেন তিনি,এক চেনা গন্ধ, সাথে খানিক বাসি মাংসের শুঁটকির মত গন্ধ, বদ্ধ বাতাসে আটকে আছে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, দরজা খোলাই থাকে ঘরের। হঠাৎ সব ছাপিয়ে একটা কড়া তামাকের গন্ধ নাকে আসে। যা কল্পনাতেও আসেনি, তাই যেন হয়। নিয়তি আহ নিয়তি! 


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×