ইছোব মামা । আমাদের গ্রামের এক সময়কার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র । এটা আমি জানিনা । আমার মেজুদা আর আব্বার মুখে শুনা কথা এটি । অংক আর ইংলিসে যার দাপট ছিলো স্যারদের হিমশিম খাওয়ানোর মতো । ক্লাসে স্যারেরা আসলে তার ফ্রী স্পিকিং আর রাইটিং দেখে টাস্কি খেয়ে যেতো । এটা ১৯৭০ এর কথা । এখন তার বয়স প্রায় পঞ্চান্ন । তার সহপাঠী সমির কাকা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ কর্মকর্তা । বকুল কাকা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে এখন বিদেশি শান্তি মিশনে আছেন । ক্লাসে যে পিছনের বেঞ্চে এসে বসতো আব্দুল মান্নান, তিনি এখন এই আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য । সম্ভবত তিনি ধানমন্ডি ক্লাবের সম্মানীত সভাপতিও । আর আমার মেজুদা, ঢাকার এক ট্রাভেল এজেন্সির ছোটখাটো মালিক ।
ইছোব মামা মেট্টিকুলেশন পরীক্ষা দিতে পারেনি । অভাবের কারনে । তাই তার অবস্থান এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে খেটে খাওয়া মানুষের দলে । কৃষক । পালে তার তিনটা গরু । বিলে তার পাঁচ পাকি জমি । আর লাঙ্গল জোয়াল কাধে নিয়েই এখন সে সুখি মানুষ । তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তার সংসার । বড় মেয়েকে কলেজের পাঠ চুকিয়ে বিয়েদিয়েছেন এক প্রবাসির কাছে । মেজো মেয়েকে ক দিন আগে পাত্রস্থ করলেন সেনাবাহিনীতে চাকুরে ছেলের কাছে ।
ইছোব মামা টাকার অভাবে নিজের ভাগ্য বদল করতে পাড়েনি । কিন্তু তার মেয়েদের ভাগ্য বদল করে দিয়েছেন । তার পালের গাভীর দুধ খেয়ে,তার খেতে উৎপাদিত আলু,পটল আর চাষের ধানের ভাত খেয়ে ভাগ্য বদল হচ্ছে আমাদেরও ।
ঢাকা থেকে যখন গ্রামে যাই । বাস থেকে নেমেই ইছোব মামার সাথে সাক্ষাত হয়। পড়নে লুঙ্গি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবী । বাম পায়ের উপর ডান পা ফেলে আয়েশী ভঙ্গীতে চা খায় ফারুকের দোকানে । আজও একই রকম ভাবে দেখা হলো তার সাথে । কাছে গিয়ে সালাম দিলাম । আমি এই সালাম জিনিষটা দিলে উনি নেহায়েত অপ্রস্তুত হয়ে যান । ভাবখানা এমন করেন – আমি রাষ্টপতি হয়ে উনার সাথে সালাম বিনিময় করছি । যেটি একদমই উচিত না । উনি চা পুরোটা খেতে পারলেননা । রোদে পুড়ে যাওয়া মুখের দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে পকেট থেকে ন্যাশনাল আইডি কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, দেখেন তো মামা এইডা এহন কি করুম । কেনো কি হয়েছে ? আমার বাবার নাম শাফে আলী । এহানে লেখা আফে আলী । জমি রেজিস্ট্রী করবার গিয়া কিযে জামেলায় পড়লাম । এইডা অহন ঠিক করমো কেমনে । আমি তাকে পাঁচ মিনিটে নাম সংশোধনের একটা লেকচার শুনালাম । উনি মাথা ঝুকা লেন । কিন্তু কিছু যে বুঝলেননা সেটা বুঝলাম তার পরের কথায় । মামা হুনেন এই সব শিক্ষিত মানুষের কাজ কারবার । আমরা চাষি মানুষ এই গুলা আমাগো মাথায় ধরবো না । আপনি নিয়া যান । আমারে ঠিক কইরা দিয়েন । আমি বিনীত মস্তকে কার্ডটি নিয়ে চলে আসলাম ।
জাতীয় আইডি কার্ড আনুযায়ী আজ ইছোব মামার জন্মদিন । ইছোব মামা হয়তো জানেনা তার জন্মদিন কবে । ইছোব মামারা এসব জন্মদিন টন্মদিনের ধারও ধারেনা । গাভীটা পাঁচ কেজি দুধ দিলেই তাদের ইনাফ । দুধ বেচে সকালের বাজারটা করতে পাড়লেই হলো ।
ইসোব মামারা দীর্ঘজীবী হোন । আপনারা না থাকলে যে আমাদের ফরমালিন খেয়ে মরতে হবে । হয়তোবা ফরমালিনও কপালে জুটবেনা